মৃত্যুর প্রহর গুনছেন কামারুজ্জামান
প্রতিনিয়ত মৃত্যুর প্রহর গুনছেন মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামী সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মাদ কামারুজ্জামান। ঠিক কখন তার রায় কার্যকর করা হবে, এটা জানা নেই তার। তবে ফাঁসির দড়িতে যে তাকে ঝুলতেই হচ্ছে তা তিনি উপলব্ধি করছেন প্রতিনিয়ত।
এ কারণে বৃহস্পতিবার প্রতিনিয়ত তিনি মনে মনে আল্লাহর নাম, দোয়া ও কালাম জপেছেন। কারারক্ষী বা কারাগারের কেউ তার আশপাশে গেলেই তাদের কাছে নানা কিছু জিজ্ঞেস করেছেন, জানতে চেষ্টা করেছেন তার জন্য সরকার ও কারা কর্তৃপক্ষের পরবর্তী পদক্ষেপ প্রসঙ্গে। দিনভর তাকে খুব বিমর্ষ মনে না হলেও অনেকটাই চিন্তিত দেখা গেছে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সকাল ও বিকেল শিফটে দায়িত্বপালনকারী কয়েকজন কারারক্ষীর সঙ্গে আলাপ করে এসব জানা গেছে।
বৃহস্পতিবার সকাল ও বিকেলের শিফটে দায়িত্বপালনকারী একাধিক কারারক্ষী দ্য রিপোর্টকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কেন্দ্রীয় কারাগারের ৮ নম্বর কনডেম সেলের ৭ নম্বর রুমে রয়েছেন কামারুজ্জামান। এর ঠিক দক্ষিণ পাশে আনুমানিক ১৫ গজ দূরেই প্রায় পাশাপাশি রয়েছে দুটি ফাঁসির মঞ্চ। এর মধ্যে পুরাতন মঞ্চটিতেই কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা হবে। যেটিতে এর আগে জামায়াতে ইসলামীর আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল।
তারা জানান, তিনজন কারারক্ষী পালা করে এই ফাঁসির মঞ্চটি পাহারা দিচ্ছেন। প্রায় ২০-২২ বর্গ হাত আয়তনের ওই ফাঁসির মঞ্চটিতে বৃহস্পতিবারই লাইটিং করা হয়েছে। আর যাতে বৃষ্টিতে না ভেজে এ জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ফাঁসি কার্যকরের আগেই ফাঁসির মঞ্চের চারদিকসহ উপরে কাপড় দিয়ে শামিয়ানা টানানো হবে, এ জন্যও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছে কারাকর্তৃপক্ষ।
কারারক্ষীরা জানান, বৃহস্পতিবার সকালে আইনজীবীরা কামারুজ্জামানের সঙ্গে কারাগারের মেডিকেল অফিসারের রুমে সরাসরি (সামনাসামনি বসে) দেখা করে গেছেন। আইনজীবীরা যাওয়ার পর থেকেই নীরব হয়ে পড়েন কামারুজ্জামান। গোসল করে নামাজ আদায় করার পরপরই সিনিয়র জেলসুপার ফরমান আলী, জেলার নেসার আলী ও আরেকজন ডেপুটি জেলার কামারুজ্জামানের কাছে যান। তারা তার সঙ্গে কোনো বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। তবে কী আলোচনা হয়েছে তা জানা যায়নি। বিকেল ৫টার পরে আবারও কামারুজ্জামানের রুমে যান ফরমান আলী ও একজন ডেপুটি জেলার।
প্রত্যক্ষদর্শী কারারক্ষীরা আরও বলেন, ‘অধিকাংশ সময়ই কামারুজ্জামানকে বসে থাকতে দেখা গেছে। এ সময় মনে মনে দোয়া-কালাম জপেছেন তিনি। তাকে বেশ গম্ভীর দেখা গেছে। তার কাছে বা আশপাশে কেউ গেলেই আগ বাড়িয়ে কথা বলেছেন। এটাওটা জানতে চেয়েছেন। তবে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সঙ্গে যেহেতু কথা বলা নিষেধ, তাই বেশির ভাগই এড়িয়ে গেছেন।
বৃহস্পতিবার সকালে এ্যাডভোকেট শিশির মো. মনিরের নেতৃত্বে কামারুজ্জামানের পাঁচ আইনজীবী তার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের জানান, তিনি একটি যৌক্তিক সময়ের মধ্যে তার প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবেন। তিনি কিছুটা সময় চেয়েছেন।
এর পরপরই দুপুরে নিজ কার্যালয়ে এক প্রেসব্রিফিংয়ে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘যৌক্তিক সময় মানে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে যতটুকু সময় লাগে সেটিকেই বোঝায়।’ তার মতে, যৌক্তিক সময় মানে সাতদিন নয়। কারাবিধিতে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সময়সীমা সাতদিন হলেও এক্ষেত্রে কারাবিধি প্রযোজ্য হবে না।
প্রায় একই সময়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের জানান, কামারুজ্জামান প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না তা বৃহস্পতিবারের মধ্যেই সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। তিনি প্রাণভিক্ষার জন্য আবেদন করলে তা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে। অন্যথায় রায় দ্রুত কার্যকর করবে সরকার।
তিনি বলেন, ‘আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট তার কাছে যাচ্ছেন। তার বক্তব্য অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারাগারে ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট যাচ্ছেন বলে বার বার বিভিন্ন মহল থেকে শোনা গেলেও বৃহস্পতিবার শেষ পর্যন্ত আর যাননি।
এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে সিনিয়র জেল সুপার ফোরকান আলীর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘কেন ম্যাজিস্ট্রেট আসবেন তা আমার বুঝে আসে না। আমি অনেক আগেই কারাগার থেকে বাসায় চলে এসেছি। আজ আর কারাগারে যাব না।’ তবে বৃহস্পতিবার রায় কার্যকর হচ্ছে কি না এমন প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গেছেন তিনি।
এদিকে দুপুরের দিকে কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে পুলিশ ও র্যাবের বেশ কিছু সদস্যকে দেখা গেলেও বিকেল থেকেই তা কমতে থাকে। সন্ধ্যার দিকে অন্যদিনের মতই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনের নিরাপত্তা। তাই বৃহস্পতিবার যে কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হচ্ছে না তা অনেকটা স্পষ্ট হওয়া গেলেও এ ব্যাপারে দায়িত্বশীল কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার কামারুজ্জামানের রায় কার্যকর যেমন হয়নি, তেমনি শুক্র ও শনিবারও রায় কার্যকরের সম্ভাবনা কম। কারণ এ দু’দিনই সরকারি ছুটি। অতীতে এ দু’দিনে রায় কার্যকরের ইতিহাস নেই বলে সূত্রটি জানিয়েছে। তবে, যেহেতু এটি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এবং জেলকোড প্রযোজ্য হবে না, তাই এক্ষেত্রে সরকার চাইলে যেকোনো সময় রায় কার্যকর করতে পারে।
কারাসূত্রে জানা যায়, কামারুজ্জমান রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা না চাইলে ফাঁসি কার্যকর করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। সরকারের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী রায় কার্যকরে ব্যবস্থা নিবেন কারাকর্তৃপক্ষ। এ জন্য পাঁচজনের একটি জল্লাদের টিমও ঠিক করে রাখা হয়েছে। তারা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেই থাকেন। এর মধ্য থেকে তিনজন কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরে কাজ করবেন। তবে ফাঁসি কার্যকরের আগে শেষবারের মত কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্যরা সাক্ষাতের সুযোগ পাচ্ছেন বলে সূত্রটি নিশ্চিত করেছে।
এ ব্যাপারে কামারুজ্জামানের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য তার বড় ছেলে হাসান ইকবাল ওয়ামীর মোবাইলে দিনভর চেষ্টা করেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।
শেষ পর্যন্ত কামারুজ্জামান রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করবেন কি না এবং না করলে সরকার কখন বা কবে তার রায় কার্যকর করবে, এ জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে দেশবাসীকে।