মানবতাবিরোধী অপরাধ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে।
শনিবার রাত ১০টা ৩০ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর করেন নির্ধারিত জল্লাদরা।
কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন আহমেদ বলেন, রাত সাড়ে ১০ টায় ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। রাত ১০টা ১৮ মিনিটে ফাঁসির মঞ্চের কাছে যান প্রতিনিধি দল। এরপর ১০টা ৩০ মিনিটে কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
ঢাকা জেল সুপারের উপস্থিতিতে ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তার হাতে থাকা লাল রুমাল মাটিতে ফেলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জল্লাদরা ফাঁসি কার্যকর করেন। এর আগে কামারুজ্জামানের মুখ কালো কাপড় ও মাথা কালো টুপি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এরপর ফাঁসির দড়িটি তার গলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়।
ফাঁসির দড়িতে দীর্ঘক্ষণ ঝুলে থাকার পর কামারুজ্জামানের মৃত্যুর বিষয়ে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়ার পর তাকে দড়ি থেকে নামানো হয়। এরপর দায়িত্বরত সিভিল সার্জন আবদুল মালেক মৃধা তার ঘাড়, হাত ও পায়ের রগ কেটে মৃত্যু নিশ্চিত করেন।
এর আগে শনিবার সন্ধ্যা ৬টা ৫০ মিনিটে কারাগারে প্রবেশ করেন মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন। সন্ধ্যা ৭টার দিকে এ্যাডিশনাল আইজি (প্রিজন) বজলুল কবির কারাগারে প্রবেশ করেন। রাত আটটার পর আসেন লালবাগ জোনের ডিসি মফিজ উদ্দিন আহমেদ। এর পর পরই প্রবেশ করেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের পক্ষে উপ-পুলিশ কমিশনার শেখ নাজমুল আলম (ডিবি পশ্চিম)।
রাত নয়টার দিকে ঢাকা জেলা প্রশাসক তোফাজ্জেল হোসেন ও সিভিল সার্জন আবদুল মালেক মৃধা কারাগারে যান।
শনিবার বিকেলে স্ত্রী নূরুননাহার বেগম, বড় ছেলে হাসান ইকবাল ওয়ামীসহ পরিবারের ২১ সদস্য কেন্দ্রীয় কারাগারে কামারুজ্জামানের সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ করেন।
সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের রিভিউ খারিজের রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি বুধবার সন্ধ্যায় কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছায়। এরপর কামারুজ্জামানকে তা পড়ে শোনানো হয়। রাষ্ট্রপতির নিকট প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন কিনা, তা জানতে চাওয়া হয় কামারুজ্জামানের কাছে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে তিনি তার আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করার কথা জানান। তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় এ্যাডভোকেট শিশির মো. মনিরের নেতৃত্বে পাঁচ আইনজীবী তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎ শেষে তারা সাংবাদিকদের জানান, তিনি একটি যৌক্তিক সময়ের মধ্যে তার প্রাণভিক্ষা চাইবেন কিনা, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবেন। তিনি কিছুটা সময় চেয়েছেন।
কামারুজ্জামান রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কিনা, তা জানতে শুক্রবার সকাল ১০টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রবেশ করেন ম্যাজিস্ট্রেট মাহফুজ জামিল ও তানভীর মো. আজিম। বেলা ১১টা ৩৮ মিনিটে তারা কারাগার থেকে বের হন। এ সময় সাংবাদিকরা তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও তারা কোনো কথা না বলেই দ্রুত গাড়িতে উঠে কারাগার ত্যাগ করেন।
প্রসঙ্গত, ট্রাইব্যুনাল থেকে রায় ঘোষণার প্রায় দুই বছর পর জামায়াতের এ নেতার ফাঁসি কার্যকর হল। ফাঁসি কার্যকর করা মানবতাবিরোধী অপরাধের দ্বিতীয় আসামি হলেন কামারুজ্জামান।
এর আগে ৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কামারুজ্জামানের পরিবারের ১২ সদস্য তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
ওই দিন সকাল ৯টা ৫ মিনিটে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বিভাগের বেঞ্চ কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদন খারিজ করে দিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় ঘোষণা করেন।
বেঞ্চের অন্য তিন সদস্য হলেন— বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিয়া, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী।
৫ মার্চ আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় আপিল মামলার চূড়ান্ত রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন দাখিল করেন কামারুজ্জামানের আইনজীবীরা। মোট ৭০৫ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনে ৪৪টি যুক্তি দেখিয়ে কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ বাতিল এবং তার খালাস চায় আসামিপক্ষ।
১৮ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি (বর্তমান প্রধান বিচারপতি) এস কে সিনহার নেতৃত্বে চার বিচারপতির বেঞ্চ কামারুজ্জামানের আপিল মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন। এরপর রায়ের কপি ট্রাইব্যুনালে পৌঁছলে ১৯ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ তিন বিচারপতি কামারুজ্জামানের মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর করেন। অন্য দুই বিচারপতি হলেন— বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহীনুর ইসলাম। এরপর ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার মুস্তাফিজুর রহমান মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে আইজি (প্রিজন) বরাবরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠান।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় কামারুজ্জামানকে ২০১৩ সালের ৯ মে ফাঁসির আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
তার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটিই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হওয়ায় এ রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল। এ ছাড়া বাকি দু’টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি মর্মে তাকে খালাস দেওয়া হয়।
২০১৩ সালের ৬ জুন ট্রাইব্যুনাল-২ এর দেওয়া ফাঁসির আদেশ থেকে খালাস চেয়ে আপিল করেন কামারুজ্জামান। আপিলে ২৫৬৪টি মূল ডকুমেন্ট, ১২৪টি গ্রাউন্ডসহ সর্বমোট ১০৫ পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট জমা দেওয়া হয়েছে।
আপিলে উভয়পক্ষের শুনানি গ্রহণ শেষে গত বছরের ৩ নভেম্বর কামারুজ্জামানকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর দেওয়া ফাঁসির আদেশ বহাল রেখে সংক্ষিপ্ত আকারে চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন আপিল বিভাগ।
কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে বিচারিক আদালতে আনীত তিন নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল ও আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড দেন।
ওই অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ২৫ জুলাই ভোরে কামারুজ্জামানের পরিকল্পনা ও পরামর্শে রাজাকার, আলবদরসহ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার সোহাগপুর গ্রাম ঘিরে ফেলে। এরপর তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ১২০ পুরুষকে ধরে এনে হত্যা করে। এ সময় ধর্ষণের শিকার হন গ্রামের অনেক নারী।
দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, গোলাম মোস্তফাকে হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ কমিয়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন উচ্চ আদালত। এ অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৩ আগস্ট মাগরিবের নামাজের সময় গোলাম মোস্তফা তালুকদারকে ধরে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। কামারুজ্জামানের নির্দেশে তাকে সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়িতে বসানো আলবদর ক্যাম্পে রাখা হয়। মোস্তফার চাচা তোফায়েল ইসলাম কামারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করে তার ভাতিজাকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু ওই রাতে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা গোলাম মোস্তফা ও আবুল কাশেম নামের আরেক ব্যক্তিকে মৃগি নদীর উপর শেরি ব্রিজে নিয়ে গুলি করে। গুলিতে গোলাম মোস্তফা নিহত হলেও হাতের আঙ্গুলে গুলি লাগায় নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে বেঁচে যান আবুল কাশেম।