কামারুজ্জামানের মামলার শুরু থেকে শেষ
মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে চূড়ান্ত রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মামলার কার্যক্রম প্রায় পাঁচ বছরে সমাপ্ত হয়েছে।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগের মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একই বছরের ২ আগস্ট ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের আবেদনের ভিত্তিতে তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।
ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তা মো. আব্দুর রাজ্জাক খান কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত করেন। তদন্ত শেষে তিনি ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর প্রসিকিউশনের(রাষ্ট্রপক্ষ) কাছে চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। এরপর ৫ ডিসেম্বর কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) ট্রাইব্যুনালে জমা দেন প্রসিকিউশন। তবে সেটি সঠিকভাবে বিন্যস্ত না হওয়ায় অভিযোগগুলো আমলে না নিয়ে প্রসিকিউশনের কাছে ফিরিয়ে দেন ট্রাইব্যুনাল।
পরবর্তীকালে ২০১২ সালের ১২ জানুয়ারি প্রসিকিউশন কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে পুনরায় ৮৪ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন এবং ৩১ জানুয়ারি তা আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল-১।
এরপর ২০১২ সালের ১৬ এপ্রিল চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর আবেদনের প্রেক্ষিতে কামারুজ্জামানের মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ট্রাইব্যুনাল-২-এ স্থানান্তর করা হয়।
কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের বিষয়ে ১৬ মে আসামিপক্ষ এবং ২০ মে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা শুনানি শেষ করেন।
উভয়পক্ষের শুনানি গ্রহণ করে ২০১২ সালের ৪ জুন কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে একাত্তরে হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, দেশত্যাগে বাধ্য করাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সাতটি অভিযোগে অভিযোগ গঠন করা হয়।
এরপর ২ জুলাই কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ৮১ পৃষ্ঠার ওপেনিং স্টেটমেন্ট (সূচনা বক্তব্য) উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর এ কে এম সাইফুল ইসলাম ও নুরজাহান বেগম মুক্তা।
একই বছরের ১৫ জুলাই থেকে ২০১৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) আব্দুর রাজ্জাক খানসহ রাষ্ট্রপক্ষের মোট ১৮ জন সাক্ষী তাদের সাক্ষ্য প্রদান করেন।
অপরদিকে কামারুজ্জামানের পক্ষে ২০১৩ সালের ৬ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত মোট ৫ জন সাফাই সাক্ষী তাদের সাক্ষ্য প্রদান করেন। তারা হলেন— মো. আরশেদ আলী, আশকর আলী, কামারুজ্জামানের বড় ছেলে হাসান ইকবাল, বড় ভাই কফিল উদ্দিন এবং আব্দুর রহিম।
উভয়পক্ষের সাক্ষীদের বিপরীত পক্ষের আইনজীবীরা জেরা করেছেন।
এরপর ২০১৩ সালের ১৭ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত ৪ কার্যদিবস যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ, এ্যাডভোকেট সৈয়দ হায়দার আলী, এ্যাডভোকেট এ কে এম সাইফুল ইসলাম ও এ্যাডভোকেট নুরজাহান বেগম মুক্তা।
আসামিপক্ষে ৩ ও ৪ এপ্রিল যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয়। এরপর কামারুজ্জামানের পক্ষে ১৫ এপ্রিল তৃতীয় ও শেষ দিনের মতো যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন ডিফেন্সের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক।
এরপর ১৬ এপ্রিল আদালতে প্রসিকিউটর হায়দার আলী ও ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ আসামিপক্ষের দেওয়া যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের বিপরীতে পাল্টা যুক্তি পেশ করেন।
রাষ্ট্রপক্ষের পাল্টা যুক্তি উপস্থাপন শেষে মামলাটির রায় যে কোনো দিন ঘোষণা করা হবে মর্মে একই দিনে সিএভিতে রেখে দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় কামারুজ্জামানকে ২০১৩ সালের ৯ মে ফাঁসির আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। তার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনীত ৭টি অভিযোগের মধ্যে ৫টিই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হওয়ায় এ রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল। এ ছাড়া বাকি দু’টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি মর্মে তাকে খালাস দেওয়া হয়।
এরপর ২০১৩ সালের ৬ জুন ট্রাইব্যুনাল-২ এর দেওয়া ফাঁসির আদেশ থেকে খালাস চেয়ে আপিল করেন কামারুজ্জামান। আপিলে ২৫৬৪টি মূল ডকুমেন্ট, ১২৪টি গ্রাউন্ডসহ সর্বমোট ১০৫ পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট জমা দেওয়া হয়।
আপিলে উভয়পক্ষের শুনানি গ্রহণ শেষে গত বছরের ৩ নভেম্বর কামারুজ্জামানকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর দেওয়া ফাঁসির আদেশ বহাল রেখে সংক্ষিপ্ত আকারে চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন আপিল বিভাগ।
কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে বিচারিক আদালতে আনীত তিন নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল ও আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন।
এরপর গত ১৮ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি (বর্তমান প্রধান বিচারপতি) এস কে সিনহার নেতৃত্বে চার বিচারপতির বেঞ্চ কামারুজ্জামানের আপিল মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন।
এরপর রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি ট্রাইব্যুনালে পৌঁছলে ১৯ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ তিন বিচারপতি কামারুজ্জামানের মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর করেন। অন্য দুই বিচারপতি হচ্ছেন— বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহীনুর ইসলাম।
এরপর ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার মুস্তাফিজুর রহমান মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে আইজি (প্রিজন) বরাবরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠানো হয়।
আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে গত ৫ মার্চ রিভিউ আবেদন দাখিল করেন কামারুজ্জামানের আইনজীবীরা। মোট ৭০৫ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনে ৪৪টি যুক্তি দেখিয়ে কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ বাতিল ও তার খালাস চেয়েছিল আসামিপক্ষ।
গত ৬ এপ্রিল সোমবার সকাল ৯টা ৫ মিনিটে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বিভাগের বেঞ্চ কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদন খারিজ করে দিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় ঘোষণা করেন।
এরপর গত ৮ এপ্রিল রিভিউয়ের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর তা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠানো হয়।
সকল প্রকার আইনী প্রক্রিয়া শেষে কামারুজ্জামান রাষ্ট্রপতির নিকট ক্ষমা চাইবেন কিনা, সে ব্যাপারে তিনি গভীর চিন্তা-ভাবনা করেছেন।
কামারুজ্জামান রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কিনা, তা জানতে শুক্রবার সকাল ১০টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রবেশ করেন ম্যাজিস্ট্রেট মাহফুজ জামিল ও তানভীর মো. আজিম। বেলা ১১টা ৩৮ মিনিটে তারা কারাগার থেকে বের হন। এ সময় সাংবাদিকরা তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও তারা কোনো কথা না বলেই দ্রুত গাড়িতে উঠে কারাগার ত্যাগ করেন।
সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে শনিবার রাত ১০টা ৩০ মিনিটে কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করেছে জেল কর্তৃপক্ষ। এরই মাধ্যমে কামারুজ্জামান অধ্যায়ের সমাপ্তি হল।