২ কোটি টাকার বেশি সম্পদ ১০ হাজার ব্যক্তির
দেশে ২ কোটি টাকার ওপরে ঘোষিত সম্পদের মালিক রয়েছেন ১০ হাজার ১৫২ ব্যক্তি। তারা তাদের আয়কর রিটার্নে জমি, ফ্ল্যাট ও প্লটের মূল্যের পরিমাণ দেখিয়েছেন ২ কোটি টাকার বেশি। এ সব স্থাবর সম্পত্তির বিপরীতে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২০৮ কোটি টাকা সারচার্জ (সম্পদ কর) আদায় করা হয়েছে। যদিও প্রকৃত সম্পদশালীর সংখ্যা এর চেয়ে বেশি রয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
‘সারচার্জ’ বা ‘সম্পদ কর’ হচ্ছে এক ধরনের মাসুল। ব্যক্তির সম্পদের ভিত্তি মূল্যের ওপর এ মাসুল আদায় করা হয়। চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে অধিক বিত্তশালীদের কাছ থেকে বেশি কর আদায়ের জন্য সারচার্জের ৪টি স্তর নির্ধারণ করেছেন।
২ কোটি টাকার বেশি কিন্তু ১০ কোটি টাকার কম সম্পদশালীর জন্য নির্ধারিত করের অতিরিক্ত ১০ শতাংশ সারচার্জ হিসেবে আদায় করার নিয়ম করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ কোনো ব্যক্তির ২ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে কিন্তু বছরে তার আয় রয়েছে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। তাহলে ওই ব্যক্তিকে আয়ের ওপর ৩ হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে। সম্পদ ২ কোটি টাকার বেশি থাকায় নির্ধারিত করের অতিরিক্ত ১০ শতাংশ অর্থাৎ ৩০০ টাকা সারচার্জ দিতে হবে। অর্থাৎ সারচার্জসহ ওই ব্যক্তির করের পরিমাণ দাঁড়াবে ৩ হাজার ৩০০ টাকা।
একইভাবে ১০ কোটি টাকার বেশি কিন্তু ২০ কোটি টাকার কম সম্পদশালীদের জন্য ১৫ শতাংশ, ২০ কোটি টাকার বেশি কিন্তু ৩০ কোটি টাকার কম সম্পদশালীদের জন্য ২০ শতাংশ, ৩০ কোটি টাকার বেশি সম্পদশালীদের জন্য ২৫ শতাংশ সারচার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে।
যদিও সম্পদের মূল্য নির্ধারণ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ সম্পদের বিনিময় বা ভিত্তি মূল্যের ওপর সারচার্জ আদায় করা হয়। উদাহরণস্বরূপ এক ব্যক্তি ১৯৮৮ সালে ঢাকায় ১০ লাখ টাকা মূল্যে জমি কিনেছেন। বর্তমানে তার জমির মূল্য রয়েছে ১০ কোটি টাকা। বর্তমান আইন অনুযায়ী করদাতা হিসেবে ওই ব্যক্তিকে সম্পদের ওপর সারচার্জ দিতে হবে না। কিন্তু ওই জমি অন্য কোনো ব্যক্তি ১০ কোটি টাকায় কিনলে তাকে স্তর অনুযায়ী সারচার্জ দিতে হবে। ফলে একই স্থানে একই পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েও দ্বিতীয়জনকে সারচার্জ দিতে হচ্ছে, প্রথমজনকে নয়। এটাই সারচার্জের বৈষম্য।
আবার জমি বা ফ্ল্যাট কেনার সময় দলিল মূল্যকে সম্পদের ভিত্তি মূল্য ধরে সারচার্জ আদায় করা হয়। যদিও যে টাকায় জমি বা ফ্ল্যাট কেনা হয়, তার চেয়ে অনেক কম দেখানো হয় বলে কথা প্রচলিত আছে। এ কারণেও কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ সারচার্জ পাচ্ছে না সরকার। অবশ্য সরকার নির্ধারিত মৌজা হারের চেয়ে কম হারে জমি নিবন্ধনের কোনো সুযোগ নেই৷ কিন্তু এই মৌজা হার বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম৷ এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে জমি বা ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রির সময় দলিল মূল্য কম দেখিয়ে সারচার্জ থেকে পার পেয়ে যাচ্ছেন অনেকেই।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১০ হাজার ১৫২ ব্যক্তি সারচার্জ দিয়েছেন। এর বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২০৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকা, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ১৪৮ কোটি টাকা বেশি। সবচেয়ে বেশি সারচার্জ দিয়েছেন বৃহৎ করদাতা ইউনিট আয়করের করদাতারা। আর সবচেয়ে সারচার্জ দিয়েছে কর অঞ্চল-৬ এর করদাতারা।
২০১১-১২ অর্থবছরে সারচার্জ দিয়েছেন ৪ হাজার ৪৪৬ জন করদাতা। এর বিপরীতে এনবিআর কর পেয়েছে ৪৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা। অন্যদিকে ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫ হাজার ৬৬২ জন করদাতা ছিলেন, যারা তাদের সম্পদের ওপর ১০ ও ১৫ শতাংশ হারে সারচার্জ দিয়েছেন। এতে এনবিআরের রাজস্ব পেয়েছে ৬০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, বৃহৎ করদাতা ইউনিট আয়করের ২৮৮ করদাতা ৪৪ কোটি ৭৮ লাখ টাকা সারচার্জ দিয়েছেন। কর অঞ্চল-১ এর ৫০৪ জন করদাতা দিয়েছেন ৬ কোটি ২১ লাখ টাকা। কর অঞ্চল-২ এর ৫৭৬ জন করদাতা দিয়েছেন ১৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা। কর অঞ্চল-৩ এর ৩০৭ জন করদাতা দিয়েছেন ৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। কর অঞ্চল-৪ এর ৫৭৬ জন করদাতা দিয়েছেন ৪ কোটি ১৮ লাখ টাকা। কর অঞ্চল-৫ এর ৭১৩ জন করদাতা দিয়েছেন ৭ কোটি ২ লাখ টাকা। কেন্দ্রীয় কর জরিপ অঞ্চলের ২০৬ জন করদাতা দিয়েছেন ১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।
কর অঞ্চল-৬ অধিক্ষেত্রভুক্ত ধানমণ্ডি এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে ৭৫৬ করদাতা সারচার্জ দিয়েছেন ৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। পুরান ঢাকার ৪৮৫ করদাতার সম্পদ ২ কোটি টাকার বেশি। কর অঞ্চল-৭ অধিক্ষেত্রভুক্ত এসব করদাতা সারচার্জ দিয়েছেন ৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা।
কর অঞ্চল-৮ এর অধিক্ষেত্রভুক্ত আইনজীবী ও ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির পরিচালকদের মধ্যে ৫৮২ জন সারচার্জ দিয়েছেন ১৪ কোটি টাকা। কর অঞ্চল-১০ এর অধিক্ষেত্রভুক্ত ৫৪২ ডাক্তারের স্থাবর সম্পদ ২ কোটি টাকার বেশি রয়েছে। এর বিপরীতে তারা সারচার্জ দিয়েছেন ৫ কোটি ১৩ লাখ টাকা।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম কর অঞ্চল-১ এর ৪২০ করদাতা দিয়েছেন ১১ কোটি ৭৭ কোটি টাকা, চট্টগ্রাম কর অঞ্চল-২ এর ৪৩৯ করদাতা দিয়েছেন ৯ কোটি ৬০ কোটি টাকা, চট্টগ্রাম কর অঞ্চল-৩ এর ৪১৯ করদাতা দিয়েছেন ৮ কোটি ৯০ কোটি টাকা এবং চট্টগ্রাম কর অঞ্চল-৪ এর ৩৫৭ করদাতা দিয়েছেন ৪ কোটি ১৮ কোটি টাকা।
ঢাকার বাইরে খুলনা কর অঞ্চলের ৩০৬ করদাতা সারচার্জ দিয়েছেন ৫ কোটি টাকা, রাজশাহী কর অঞ্চলের ৭৩ করদাতা দিয়েছেন ১ কোটি ৩১ লাখ টাকা, রংপুর কর অঞ্চলের ৬৭ করদাতা দিয়েছেন ৩ কোটি ৩৩ টাকা, বরিশাল কর অঞ্চলের ৮৬ করদাতা দিয়েছেন ২ কোটি ২৯ লাখ টাকা, সিলেট কর অঞ্চলের ২৩৬ করদাতা দিয়েছেন ১ কোটি ৩১ লাখ টাকা, নারায়ণগঞ্জ কর অঞ্চলের ১৮৪ করদাতা দিয়েছেন ৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, গাজীপুর কর অঞ্চলের ১০৭ করদাতা দিয়েছেন ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা, কুমিল্লা কর অঞ্চলের ২৪১ করদাতা দিয়েছেন ১ কোটি ৭৪ লাখ টাকা, ময়মনসিংহ কর অঞ্চলের ৭০ করদাতা দিয়েছেন ৯৬ লাখ টাকা এবং বগুড়া কর অঞ্চলের ৫২ করদাতা দিয়েছেন ১ কোটি ৭৪ লাখ টাকা।
এ প্রসঙ্গে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বলেন, বাস্তব অবস্থার তুলনায় সারচার্জ আদায় একেবারেই নগণ্য। দুর্বল মনিটরিংয়ের কারণে সব সম্পদশালীকে করের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। আবার অনেকে কর ফাঁকি দিতে ইচ্ছাকৃতভাবে আয়কর রিটার্নে সম্পদ কম দেখান। মনিটরিং জোরদার করা হলে আরও বেশি সারচার্জ আদায় সম্ভব হতো বলে মনে করেন তিনি।