ডিসিসি নির্বাচন বিতর্কিতরা পেলেন বিএনপির কাউন্সিলর টিকিট
আসন্ন ডিসিসি (ঢাকা সিটি করপোরেশন) উত্তর ও দক্ষিণ নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে বিএনপির টিকিট পেয়েছেন হত্যা মামলার আসামি, ক্ষুদ্র ঠিকাদারসহ অনেক বিতর্কিত ব্যক্তি। অন্য দল থেকে এসেও বিএনপির সমর্থন পেয়েছেন কেউ কেউ, এমন অভিযোগও উঠেছে। অন্যদিকে বাদ পড়েছেন বিএনপি সমর্থিত সাবেক অনেক কাউন্সিলর ও ত্যাগী নেতারা। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে যোগ্য প্রার্থী নির্বাচন কমিশনের বাছাইয়ে টিকলেও তাদের দলীয় সমর্থন স্থগিত রাখা হয়েছে। একটি ওয়ার্ডে প্রার্থী দিতে পারেনি বিএনপি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৭ নম্বর ওয়ার্ডে মো. শামছুল হুদা কাজলকে মানোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে তিনটি হত্যা মামলা রয়েছে। তারা তিন ভাই ‘কিলার বাহিনী’ হিসেবে অভিযুক্ত। এর মধ্যে এক ভাই নুরুল ইসলাম স্বপন জেলে আছেন। এ ছাড়া আরেক ভাই মাসুদ পলাতক আছেন। তাদের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসীর কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তারা এলাকায় যেতে পারে না। এমন পরিস্থিতিতে তাদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। অথচ সাবেক দুইবারের কাউন্সিলর এডিএম মোস্তফা বাদশাকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে কাউন্সিলর এডিএম মোস্তফা বাদশা বলেন, ‘এগুলো নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। এখন পলিটিক্স করার সময় নয়। এ সব নিয়ে কথা না বলাই ভালো। তবে আমি এ সবের মধ্যে নাই।’
দলীয় সমর্থন না পাওয়ার কারণেই কী নিজেকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করছেন— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘মনোনয়ন জমা দেওয়ার দরকার ছিল তাই দিছি। এখন আর আমি এর মধ্যে নাই। কোনো মতামত দিতে চাচ্ছি না।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ২০ দল সমর্থিত প্রার্থী মো. শামছুল হুদা কাজল বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা, মাদক সন্ত্রাস, চাঁদাবাজির অভিযোগ ভিত্তিহীন। এগুলো রাজনৈতিক অপ্রচার। কেউ যদি প্রমাণ করতে পারে যে কোনো শাস্তি মাথা পেতে নিবো।’
তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ৭টি মামলা আছে। সব রাজনৈতিক মামলা।’ নির্বাচিত হলে আধুনিক ওয়ার্ড গড়ে তুলতে মাদক, সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গড়ারও অঙ্গীকার করেন শামছুল হুদা।
ঢাকা দক্ষিণের ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা স্থগিত রাখা হয়েছে। এখানে সাবেক কাউন্সিলর মোজ্জাম্মেল হোসেন মনোয়ন জমা দিয়ে নির্বাচন কমিশনের চূড়ান্ত তালিকায় আছে। এখানে মোজ্জাম্মেল হোসেনকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম-আহ্বায়ক সালাহউদ্দিনের লোক মো. তোফায়েলকে মনোনয়ন দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া জাগপার সভাপতি শফিউল আলমের একজন প্রার্থী আছেন।
মোজ্জাম্মেল হোসেন বলেন, ‘আলোচনা চলছে, দুই-এক দিনের মধ্যে ঘোষণা আসবে। ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) জানতেন না এটা বিএনপির ওয়ার্ড ছিল। এ ছাড়া তোফায়েলের কথা বলা হচ্ছে, সে গতবার ৩৬০ ভোট পেয়েছিল।’
ঢাকা উত্তরের ১২ নম্বর ওয়ার্ডে সাবেক কাউন্সিলর রুনু আক্তারকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এখানে ঢাকা মহানগর বিএনপি ও দলের নিবার্হী কমিটির সদস্য এসএ খালেকের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ২০ দলের সমর্থন পেয়েছেন ক্ষুদ্র ঠিকাদার মো. বাবুল আকতার।
মো. বাবুল আকতার বলেন, ‘গত পাঁচ বছর ধরে আমার ব্যবসা বন্ধ রয়েছে। আমি গ্রিলের কন্ট্রাকটারি করি। কেউ যদি আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায় কিছুই করার নাই।’
এসএ খালেকের সমর্থনে মনোনয়ন পেয়েছেন এমন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এসএ খালেক ঢাকা মহানর বিএনপির সদস্য, দলের নিবার্হী কমিটির সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য। তিনি তো দলের বাইরের কেউ নন। তিনি কারও ব্যাপারে রিকমান্ড করতেই পারেন। তাছাড়া এসএ খালেকের সঙ্গে আমার ভাল সম্পর্ক।’
তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক গ্রুপিং থাকতেই পারে। অনেকেই আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে পারেন। জনগণই এর জবাব দিবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি বীরমুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাই। নির্বাচিত হলে নিজে দুর্নীতিমুক্ত থাকবো এবং নাগরিক সেবামূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখব।’
ঢাকা দক্ষিণের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে সমর্থন স্থগিত আছে। সাবেক কাউন্সিলর মোফাররফ হোসেন খোকনকে এখনো দলীয় সমর্থন দেওয়া হয়নি। এখানে কারাগারে আটক বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন পিন্টুর লোককে দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়াও ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডে সাবেক কাউন্সিলর বাদল সরকারকে বাদ দিয়ে যুবদলের সাবেক নেতা ইসহাক তালুকদারকে মনোনয়ন দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।
ঢাকা দক্ষিণের ২০ নম্বর ওয়ার্ডেও সমর্থন স্থগিত রাখা হয়েছে। সাবেক কাউন্সিলর নিখোঁজ চৌধুরী আলম এ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন। এখানে বাসেত মাস্টার ও জাহিদ হোসেন নবাবকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। দুইজনই যোগ্য প্রার্থী। ২২ নম্বর ওয়ার্ডও স্থগিত রাখা হয়েছে। কাউকে এখনো দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডেও সমর্থন স্থগিত রাখা হয়েছে। এখানে সাবেক কাউন্সিলর মোজাম্মেল হোসেন মনোনয়ন বাছাইয়ে টিকে আছেন। তবে তাকে দলীয় সমর্থন দেওয়া হয়নি। অন্য কাউকে দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।
ঢাকা দক্ষিণের ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডেও বিএনপি প্রার্থী দিতে পারেনি বলে জানা গেছে। এখানে শ্যারিকা সরকার বিনা সাবেক কাউন্সিলর। জানা যায়, মামলার কারণে তিনি নির্বাচনে আসেননি। ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডে ইয়াকুব সরকারকে বিএনপির সমর্থন দেওয়া হয়েছে। তার নামে হেরোইন, ফেনসিডিল, চোরাকারবারির অভিযোগ আছে। তিনি এক-এগারোর পর থেকে যশোরে থাকেন। কয়েক বছর এলাকায় আসেন না। মির্জা আব্বাস ও নাসির উদ্দিন পিন্টুর কাছের লোক হিসেবে পরিচিত। দলীয় সূত্রের দাবি ইয়াকুব সরকার ও তার ছোটভাই ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার রাজনৈতিক মামলার শিকার। চুরি, মাদক, সন্ত্রাসীসহ হেন কোনো মামলা নেই, যা এই দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে করা হয়নি। এই দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে প্রায় একশত মামলা রয়েছে।
ঢাকা উত্তরের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপি সমর্থিত আব্দুল লতিফ পিডিপির (প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টি) লোক ছিলেন। পরে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। পিডিপিতে থাকার বিষয়টি আব্দুল লতিফ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘এগুলো আমার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অপপ্রচার।’ তবে লতিফকে পিডিপি থেকে এসেছেন বলে জানিয়েছেন বিএনপি আরেক প্রার্থী রাবেয়া আলম।
ওই ওয়ার্ডে সংরক্ষিত ১ নম্বর আসনের সাবেক কাউন্সিলর রাবেয়া আলম এবার কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। দলীয় মনোনয়নের ব্যাপারে এখনও আশাবাদী তিনি।
রাবেয়া আলম বলেন, ‘গতবারও আমাকে দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি, তারপরও আমি বিজয়ী হয়েছিলাম। আশা করি এবারও আমি বিজয়ী হব। মাঠে এসে ভোটারদের সঙ্গে কথা বললেই দলের নেতাদের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। আমরা বিষয়টি নিয়ে দলের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। এ ব্যাপারে কিছুই বলার নেই।’
কথা বলার জন্য ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস ও সদস্য সচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাদের পাওয়া যায়নি।
ত্যাগী নেতাদের বাদ পড়া ও হত্যা মামলার আসামিদের দলীয় সমর্থন প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম-আহ্বায়ক আবু সাঈদ খান খোকন বলেন, ‘রাজনৈতিক মামলা থাকতে পারে। তবে হত্যা মামলার অভিযোগ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে অপরাধী বলা যাবে না।’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে যারা মনোনয়ন জমা দিয়েছেন তাদের দল থেকে সমর্থন দেওয়া হয়েছে, যারা বাদ পড়েছেন তারা বিগত দিনে আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন না। আন্দোলনে ছিলেন না এমন অনেককেই রাখা হয়েছে। মনোনয়ন দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের সিদ্ধান্ত ভুল কী সঠিক হয়েছে, তা ফলাফলের পর বুঝা যাবে।’
দলের ত্যাগী নেতা, সাবেক কাউন্সিলরদের বাদ দিয়ে হত্যা মামলার আসামি ও ঠিকাদারদের দলীয় সমর্থন দেওয়া হয়েছে এমন অভিযোগ সর্ম্পকে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান বলেন, ‘ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতারা আছেন, তারা মনোনয়ন দিয়েছেন। তারা কাকে দিয়েছেন তারাই বলতে পারবেন। এ বিয়য়ে আমি কিছুই বলতে পারব না।’
দলীয় সূত্রে জানা যায়, ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী বাছাইয়ে হিমশিম খেতে হয় নীতি-নির্ধারকদের। কারণ প্রতি ওয়ার্ডে গড়ে তিনের অধিক বিএনপির সাবেক কমিশনার, নেতাকর্মী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। ৯৩টি ওয়ার্ডে দলের সাবেক ৭৫ জন কমিশনারের মধ্যে যারা দলে এখনো সক্রিয় তাদের মধ্যে অনেকেই মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে বাছাইয়ে টিকে গেছেন। এ অবস্থায় বিএনপি নির্বাচন পরিচালনা এবং পর্যবেক্ষণের জন্য একটি কমিটি করে। সমন্বয় করতে কয়েকটি উপ-কমিটিও কাজ করেছে। তারা দলের চেয়ারপারসনের সঙ্গে আলোচনা করেই প্রার্থী ঠিক করেছেন।