ঢাকার চলচ্চিত্রে বৈশাখ
বাঙালী সংস্কৃতিতে অন্যতম দুই উৎসব চৈত্রসংক্রান্তি ও বর্ষবরণ উৎসব। বিশেষ করে বর্ষবরণ নিয়ে আমাদের উৎসাহ-উদ্দীপনার শেষ নেই। তার রেশ বিনোদন মাধ্যমেও দেখা যায়। চলচ্চিত্রকে বলা হয় সমাজের প্রতিচ্ছবি, জীবনের প্রতিচ্ছবি। তাই চলচ্চিত্রে বৈশাখের ছোঁয়া অতিপ্রত্যাশিত। কিন্তু বাংলা চলচ্চিত্রে সেভাবে ঠাঁই পায়নি পয়লা বৈশাখ। যতটুকু এসেছে তাতে ঘুরে ফিরে এসেছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। আসেনি গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী আয়োজন।
বাংলা নববর্ষ পালনের ছোঁয়া কিছুটা আছে এমন কয়েকটি চলচ্চিত্রের কথা নিচে তুলে ধরা হল—
গহীনে শব্দ
২০১০ সালের ২৬ মার্চ মুক্তি পায় ‘গহীনে শব্দ’। ইমপ্রেস টেলিফিল্মের চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন খালিদ মাহমুদ মিঠু। অভিনয় করেছেন ইমন, কুসুম শিকদার, আবুল হায়াত, সালিম সুলতান ও মাসুম আজিজ ।
‘গহীনে শব্দ’ চলচ্চিত্রের শুরুতেই দেখা যায় বর্ষবরণের পূর্বপ্রস্তুতির দৃশ্য। ইউনিভার্সিটির সামনে খোলামাঠে চলছে প্রস্তুতি। প্রতিকৃতি তৈরিতে ব্যস্ত কুসুম শিকদার ও ইমন। এরপরই দেখানো হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। বৈশাখের আবহের পর গল্প মোড় নেয় অন্যদিকে। ফুটে উঠেছে সামাজিক বাস্তবতার চিত্র। মূলত একজন পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার জীবনের গল্প ‘গহীনের শব্দ’। সেদিক থেকে বাঙালীর অন্যতম উৎসবের সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের একটি মিল খোঁজা যায়।
নারীর মন
২০০০ সালে মুক্তি পায় মতিন রহমান পরিচালিত এবং রিয়াজ, শাকিল খান ও শাবনূর অভিনীত ‘নারীর মন’।
এ চলচ্চিত্রে ‘জীবনে বসন্ত এসেছে’ গানটির চিত্রায়নে কয়েকটি দৃশ্যে পাওয়া গেছে বৈশাখের ছোঁয়া।
গানটির শুরুতেই দেখানো হয় মঙ্গল শোভাযাত্রার দৃশ্য। যদিও গানের কথা বলে অন্যকিছু। প্রথম লাইন হল— ‘জীবনে বসন্ত এসেছে, ফুলে ফুলে ভরে গেছে মন, ও বান্ধবী অনামিকা আজ তোমাকেই প্রয়োজন।’ কথা যাই হোক, চিত্রায়নে মিলেমিশে একাকার জীবনের বসন্ত আর প্রকৃতির বৈশাখ।
মনের মাঝে তুমি
‘সবাইকে শুভ নববর্ষ। আজ পয়লা বৈশাখ। আপনারা আমাকে ইনভাইট করেননি, এরপরও আমি কিন্তু আসতে ভুল করিনি।’ সংলাপটি ২০০৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত ‘মনের মাঝে তুমি’ চলচ্চিত্রের। পরিচালনা করেছেন মতিউর রহমান পানু। মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন রিয়াজ, পূর্ণিমা, যীশু সেনগুপ্ত ও তনু রায়।
চলচ্চিত্রের ওই অংশে একটি শহুরে পারিবারের নববর্ষ উদযাপন দেখানো হয়। এতটা চমৎকারভাবে অন্য কোনো চলচ্চিত্রে বর্ষবরণের দিনকে দেখানো হয়নি। যদিও ছিল না পান্তা-ইলিশ। দেখা যায় বিশেষ রান্নার আয়োজন ও পরিবারের সদস্যদের খুনসুঁটি। জনপ্রিয় এই চলচ্চিত্রটির বেনু আর অনুর কথা যারা এখনো ভোলেননি— এতক্ষণে নিশ্চয়ই তাদের চোখের সামনে ভাসতে শুরু করেছে দৃশ্যগুলো।
কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি
‘এই বৈশাখে লেখা প্রেমের চিঠি নির্জনে পড়ে নিও। জ্যৈষ্ঠের কোনো গরম দূপুরে তারই উত্তর দিও’— ২০০৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চিত্রনায়িকা মৌসুমী পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’ চলচ্চিত্রের গান এটি। বর্ষবরণ উৎসবে গানটি গাইতে দেখা যায় নায়ক রাজ রাজ্জাককে।
ফেরদৌস-মৌসুমী অভিনীত এই চলচ্চিত্রে বৈশাখের বর্ষবরণ উৎসবকে বেশ জাঁকজমকভাবে নাচ-গান ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে।
মৃত্তিকা মায়া
২০১৩ সালে নির্মিত গাজী রাকায়েত পরিচালিত ‘মৃত্তিকা মায়া’ চলচ্চিত্রের মূল বিষয়ই হল মাটি। মৃৎশিল্প ও বাঙালীর সবচেয়ে বড় উৎসব পয়লা বৈশাখকে বাঁচিয়ে রাখার তুমুল এক লড়াইয়ের গল্প। আর কুমোর ক্ষীর মোহন বাবু বৈশাখী মেলা থেকেই একটা শিশু কুড়িয়ে পায়, তার নাম রাখে বৈশাখ।
ক্ষীর মোহন বাবুর জমির উপর বিশাল এক বটগাছকে ঘিরে প্রতিবছর বৈশাখী মেলা বসে। সাত গ্রামের লোক জমায়েত হয় সেখানে। মোহন বাবুর দুই ছেলে সেই গাছ বিক্রি করে দিতে চায়। ছেলেদের ওপর রাগ করে মৃত্যুর আগেই কুড়িয়ে পাওয়া বৈশাখকে বাড়িঘর আর বটগাছওয়ালা জমি লিখে দিয়ে যান ক্ষীর মোহন। বলে যান প্রতিবছর আগের মতো বৈশাখী মেলার আয়োজন করতে।
‘মৃত্তিকা মায়া’ ছবিতে গ্রামীণ ঐতিহ্যকে গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপন করা হয়েছে। ১৭টি বিভাগে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-২০১৩’ জিতেছে ‘মৃত্তিকা মায়া’। এতে অভিনয় করেছেন তিতাস জিয়া, শর্মিমালা, রাইসুল ইসলাম আসাদ, অপর্ণা ঘোষ, মামুনুর রশিদ, ওয়াহিদা মল্লিক জলি, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।
এ ছাড়া তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ চলচ্চিত্রে চৈত্রসংক্রান্তি ও বৈশাখের আবহ পাওয়া যায়।