মনে আলোর প্রত্যয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা
মনের অন্ধকারে আলো জ্বালার প্রত্যয়ে হল ১৪২২ সনের পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা। এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার স্লোগান ‘অনেক আলো জ্বালতে হবে মনের অন্ধকারে।’
মঙ্গলবার সকাল ৯টা ৮ মিনিটে শোভাযাত্রাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে শুরু হয়। এর পর শোভাযাত্রাটি হোটেল রূপসী বাংলা, শাহবাগ ও টিএসটি মোড় ঘুরে ফের চারুকলার সামনে গিয়ে সকাল ১০টায় শেষ হয়।
শোভাযাত্রায় আবহমান বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের প্রতীকী উপস্থাপনের নানা বিষয় স্থান পেয়েছে।
শোভাযাত্রায় সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন স্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছেন। কঠোর নিরাপত্তার চাদরে মোড়ানো ছিল পুরো এলাকা।
ঢাক-ঢোল, বিভিন্ন ধরনের বাঁশির শব্দে পুরো শোভাযাত্রা মাতিয়ে রাখেন তরুণ-তরুণীরা।
এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রায় ছাগল, তোতা পাখি, হাট্টিমা টিম টিম, কাকাতুয়া, মাছ, বাঘ, পায়রা, হাতিসহ বেশ কয়েকটি বড় কাঠামো ছিল।
সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে রয়েছে ছাগল ও দুটি ছানা। সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রুখে দাঁড়ানোর প্রতীক হিসেবে শোভাযাত্রায় ছিল প্রায় ২০ ফুট লম্বা একটি মুষ্টিবদ্ধ হাত। যার আঙুলে একটি লাল রং। এই লাল রং সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রতীক। আর হাতটি দ্বারা বোঝানো হয়েছে দেশের শান্তিকামী মানুষ।
বিশেষ কাঠামো হিসেবে রয়েছে, হাতের থাবা দিয়ে মানুষের গলা চেপে ধরে আছে- এমন একটি প্রতীক, যা দিয়ে সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনাবলি বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
অসংখ্য মুখোশ ও হরেক রকম পুতুলের পাশাপাশি এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রায় কাগজ দিয়ে তৈরি পাখি, পুতুল দেখা গেছে।
থিমেটিক স্থাপনা-শিল্প হিসেবে ছিল টেপা পুতুল, মাছ, কাকাতুয়া, দুটি পায়রা, ঘোড়া এবং হাতি। এ ছাড়াও একটি টেপা পুতুলও ছিল। কলসি হাতে নিয়ে মা তার সন্তানকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এমন গ্রামীণ দৃশ্যও ছিল শোভাযাত্রায়।
এ ছাড়া ছিল মুখোশের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা রাজা-রানী, উজির-নাজির, বাঘ, পেঁচা, টেপা পুতুলসহ নানা আকৃতি ও বর্ণের প্ল্যাকার্ড।
সকাল থেকেই টিএসসি, দোয়েল চত্বর, শাহবাগ ও এর আশপাশের এলাকায় মানুষ জড়ো হতে থাকেন। নয়টার মধ্যেই পুরো এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। লাল-সাদা পোশাকে উচ্ছল নারীদের মাথায় শোভিত নানান রঙ্গের ফুলের টায়রা। লাল-সাদা পঞ্জাবী পরা তরুণদের ভেপুর শব্দ ছড়িয়ে পড়ছিল বহু দূরে।
তরুণরা লুঙ্গি, গেঞ্জির সঙ্গে শরীরে গামছা জড়িয়ে হুকো, লাঙ্গল হাতে বাংলার কৃষক-চাষা সেজে নেচে গেয়ে বেরিয়ে ছিলেন শোভাযাত্রায়।
শোভাযাত্রা ঘিরে ছিল কয়েক স্তরের নিরাপত্তা পুলিশ, র্যাবের সঙ্গে ছিল সোয়াত সদস্যরা। সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও তৎপর ছিলেন।
মোহাম্মপুর থেকে শোভাযাত্রায় আসেন মো. আকবর হোসেন। তিনি বলেন, ‘এইতো একটা দিন, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবার। এখানে এলে অন্যরকম একটা ভালোলাগার অনুভূতি কাজ করে। আমি প্রতি বছর আসি। আজ আমাদের প্রত্যাশা দেশটা ভালো থাকুক। আমরা সবাই ভালো থাকি।’
যাত্রাবাড়ীর বিবির বাগিচা থেকে সপরিবারে আসেন ব্যাংক কর্মকর্তা মনির হোসেন মিয়া। তার মেয়ের বয়স আড়াই বছর। তিনি বলেন, ‘আমি এবারই প্রথম এলাম। প্রাণে প্রাণে একাত্ম হওয়ার এমন আর কোন উদাহরণ তো আমি দেখি না।’
বাঙ্গালীর প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ সাল থেকে শুরু হয়েছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা। শুরু থেকেই চারুকলার শোভাযাত্রাটির নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা ছিল না। তখন এর নাম ছিল বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। ১৯৯৬ সালে এর নাম হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা।
বর্ষবরণ উপলক্ষ্যে আনন্দ শোভাযাত্রা চারুকলায় ১৯৮৯ সালে শুরু হলেও এর ইতিহাস আরও কয়েক বছরের পুরানো। ১৯৮৫ বা ১৯৮৬ সালে চারুপীঠ নামের একটি প্রতিষ্ঠান যশোরে প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলক্ষ্যে আনন্দ শোভযাত্রার আয়োজন করে। যশোরের সেই শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরানো বাদ্যসহ আরও অনেক শিল্পকর্ম। শুরুর বছরেই যশোরে সেই শোভাযাত্রা আলোড়ন তৈরি করে।
যশোরের সেই শোভাযাত্রার উদ্যোক্তাদের একজন মাহবুব জামাল শামীম মাস্টার্স ডিগ্রি নিতে পরে ঢাকার চারুকলায় চলে আসেন। পরবর্তীতে যশোরের সেই শোভাযাত্রার আদলেই ঢাকার চারুকলা থেকে শুরু হয় বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা।