মাঠে খালেদা : খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসছেন নেতাকর্মীরা
ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দল সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নেমেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। দলের হাইকমান্ড মাঠে নামায় দীর্ঘদিন পর খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসছেন নেতাকর্মীরা।
তিন মাসেরও অধিক সময় সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে যে সব নেতাকর্মী আত্মগোপনে গিয়েছিলেন ধীরে ধীরে তারা উজ্জীবিত ও সাহসী হয়ে উঠছেন বলে মনে করছে বিএনপি।
বাংলা বর্ষবরণের দিন দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া নিজেই জনসম্মুখে আসেন। সেদিন তিনি তার দলের সাংস্কৃতিক অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) আয়োজনে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আসেন। নববর্ষ উপলক্ষে তিনি দেশবাসী ও সকল বাংলাভাষীকে শুভেচ্ছা জানান। একই সঙ্গে সিটি নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত মেয়র ও কমিশনার প্রার্থীদের ভোট দিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের গুম, খুন, গ্রেফতার নির্যাতনের বিরুদ্ধে নীরব বিপ্লব ঘটানোর জন্য তিনি জনগণকে আহ্বান জানান।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে ১ বৈশাখের ওই অনুষ্ঠানে হাজারো নেতাকর্মী আসেন। অনেক নেতাকর্মী সেখানে ছিলেন যারা তিন মাসের অধিক সময় জীবনের ভয়ে আত্মগোপনে ছিলেন।
আত্মগোপনে থাকা ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা রাকিবুল ইসলাম রয়েল বলেন, ‘ম্যাডামের আসার সংবাদ পেয়ে আর থাকতে পারলাম না। যা থাকে কপালে, তিন মাস পর পার্টি অফিসে এসে পড়লাম।’
তিনি আরও বলেন, ‘ম্যাডাম মাঠে থাকলে আমরা কোনো কিছুতেই ভয় পাই না। তিনি মাঠে এসেছেন, তাই আমিও এসেছি।’
কয়েকদিন বিরতি দিয়ে হঠাৎ করেই শনিবার ঢাকা উত্তরের মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের পক্ষে প্রচারণায় নেমেছেন খালেদা জিয়া। এদিন তিনি দলের ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান ও মহিলা দলের কয়েকজন নেত্রীকে সঙ্গে নিয়ে গণসংযোগ শুরু করেন।
হঠাৎ করে দলীয় প্রধানের নির্বাচনী মাঠে নেমে পড়ায় ‘উজ্জীবিত’ হন নেতাকর্মীরা। খালেদা জিয়া গুলশান-২ এলাকার পিংক সিটি ও ডিসিসি মার্কেটের সামনে তাবিথ ও স্থানীয় ওয়ার্ডের বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে সাধারণের কাছে ভোট চান ও লিফলেট নিয়ে প্রচারণা চালান।
দলীয় প্রধানের মাঠে নামার কথা গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে মুহূর্তেই হাজার হাজার নেতাকর্মী সেখানে হাজির হন। এরপর তিনি রাত ৯টা পর্যন্ত গুলশান-১, বাড্ডা, মহাখালী, হাতিরঝিল, নিকেতন এলাকাসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে গণসংযোগ চালান।
বিএনপি চেয়ারপারসনের নির্বাচনী মাঠে নামায় নেতাকর্মীদের সঙ্গে মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালও অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
খালেদা জিয়া নির্বাচনী প্রচারণায় নামার জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রবিবার তাবিথ আউয়াল বলেন, ‘ম্যাডাম খালেদা জিয়ার বিপুল-বিশাল জনপ্রিয়তা। তিনি প্রচারণায় নামায় নির্বাচন ও গণসংযোগে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। মানুষ আরও বেশি আমার পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে এবং বিপুল সমর্থন দিচ্ছে। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হলে আমি জয়ী হব।’
রবিবার বিকেলে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচনী প্রচার চালাতে গুলশানের বাসভবন ফিরোজা থেকে বের হন। একপর্যায়ে খালেদা জিয়া রাজধানীর উত্তরার দিকে যান। সেখানে যাওয়ার মুহূর্তে উত্তরা ১ নং সেক্টরের ৬ নং রোডের মাথায় বিকেল পৌনে ৫টার দিকে উত্তরা থানা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এস এম তোফাজ্জল ও সাধারণ সম্পাদক হাবিব হাসানের নেতৃত্বে কয়েক শ’ নেতাকর্মী খালেদা জিয়ার গাড়িবহর ঘেরাও করে স্লোগান দিতে থাকে। তারা খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে বিভিন্ন ‘কটূক্তিমূলক’ স্লোগান দিতে থাকেন।
তবে এ বাধায় মোটেই বিচলিত হননি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ক্ষমতাসীন দলের বাধার তোয়াক্কা না করে একটু সামনে গিয়েই তিনি উত্তরার ইনফিনিটি প্লাজায় প্রবেশ করে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন।
এদিকে নির্বাচনী প্রচারণায় আওয়ামী লীগের বাধার সংবাদ শুনেই মুহূর্তে সেখানে হাজার হাজার বিএনপি ও ছাত্রদলের নেতাকর্মী ওই এলাকায় যান।
মুহূর্তেই নেতাকর্মীদের ঢল নামে উত্তরায়। বিএনপি চেয়ারপারসন অনেকটা ভাবলেশহীন অবস্থায় তাবিথের পক্ষে বাস মার্কায় প্রচারণা চালিয়ে যান। সেখান থেকে তিনি বেরিয়ে আমির কমপ্লেক্সে গিয়ে প্রচারণা চালান।
সন্ধ্যায় উত্তরার নর্থ টাওয়ার থেকে নির্বাচনী প্রচারণা শেষে খালেদা জিয়া বের হলে তার গাড়িবহর আটকানোর চেষ্টা করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় বিএনপি নেতাকর্মীরাও পুরো এলাকা স্লোগানেমুখর করে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরের পাশে অবস্থান নেয়।
শতাধিক মোটরসাইকেলে বিএনপি ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা খালেদা জিয়ার গাড়িকে ঘিরে রাখে। নেতাকর্মী পরিবেষ্টিত খালেদা জিয়ার গাড়িবহর এ সময় মিরপুরের উদ্দেশে রওয়ানা দেয়। তবে খিলক্ষেত এলাকায় গাড়িবহর গেলে ওই এলাকাতেও দুই দলের নেতাকর্মীরা মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে নিজ নিজ দলের পক্ষে স্লোগান দিতে থাকেন। সরকারি দলের নেতাকর্মীদের ‘মারমুখী’ অবস্থান সত্ত্বেও দলীয় প্রধানের অনড় মনোভাবের পরিচয় পেয়ে সাধারণ নেতাকর্মীরাও ‘উজ্জীবিত ও সাহসী’ হয়ে ওঠেন।
উত্তরা এলাকায় এ সময় অনেকে নেতাকর্মীকে দেখা যায়, যাদের বিগত তিন মাসে একবারের জন্যও মাঠে বা প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।
মহানগর যুবদল উত্তরের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান দলীয় প্রধানের নির্বাচনী প্রচারে ক্ষমতাসীনদের বাধার খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান। তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো সন্ত্রাসীকে পরোয়া করি না। ম্যাডামের নির্দেশে আমরা আমাদের প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করে যাবই।’
দলীয় প্রধানের নির্বাচনের মাঠে নামায় সাধারণ নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হয়ে উঠছেন বলেই মনে করছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘দেশের বৈরী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নেতাকর্মীরা ছিলেন দিক-নির্দেশনাহীন। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দলীয় মানসিকতার কারণে তারা প্রতিদিনই নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গত কয়েক মাসের আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ইতোমধ্যেই আমাদের অনেক নেতাকর্মী জীবন হারিয়েছেন। গণগ্রেফতারের শিকার হয়েছেন। গুম-খুন ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সঙ্গত কারণেই সাধারণ নেতাকর্মীরা ছিলেন ভীত। যদিও এখনও ভয়-ভীতি, আতঙ্ক কাটেনি।’
সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মাহবুব বলেন, ‘দীর্ঘদিন পর দলীয় প্রধানকে রাজনীতির মাঠে পেয়ে নেতাকর্মীরা স্বাভাবিকভাবেই উজ্জীবিত হয়েছেন। হওয়ারই কথা।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান বলেন, ‘বিষয়টি অত্যন্ত পরিষ্কার। ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) আমাদের সকলের ঐক্য ও আস্থার প্রতীক। তিনি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের একমাত্র রক্ষাকবচ। তিনি যখন রাস্তায় নেমেছেন, এ কথা জানতে পেরে সকল ভয়-ভীতি, আতঙ্ক দূরে ফেলে নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হয়ে উঠবেন এটিই স্বাভাবিক।’
এ্যাডভোকেট আযম বলেন, ‘সিটি নির্বাচনে আমাদের প্রার্থীদের প্রচার চালাতে বাধা দিচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসী ক্যাডাররা। বিভিন্ন এলাকায় আমাদের কর্মীদের মারধর করা হচ্ছে। পোস্টার ছিঁড়ে ফেলছে। আজকে ম্যাডামের নির্বাচনী প্রচারে বাধা দিয়ে আওয়ামী লীগ আবারও প্রমাণ করল তারা সন্ত্রাসী দল।’
তিনি বলেন, ‘ম্যাডাম তিন বারের প্রধানমন্ত্রী, সাবেক রাষ্ট্রপতি ও সেনা প্রধান এবং বীরউত্তমের স্ত্রী। তাকে সরকারের উস্কানিতে ক্ষমতাসীন সন্ত্রাসীরা বাধা দিয়েছে। যা শুধু আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীতেই বিরল। আমি এ সন্ত্রাসী ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। অবিলম্বে এ সব ঘৃণ্য সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনারও দাবি করি।’
আযম আরও বলেন, ‘ম্যাডাম মাঠে নামায় নেতাকর্মীরা ভয়-ভীতি দূর করে শত বাধার মুখেও আমাদের প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছে। এটি ম্যাডামের দৃঢ় মনোবলের কারণেই সম্ভব হয়েছে।’