ক্রয় আদেশ লঙ্ঘন করে ইউরিয়া আমদানি প্রসঙ্গে তোলপাড়
সরকারি ক্রয় আদেশ লঙ্ঘন করে ইউরিয়া সার আমদানিকে কেন্দ্র করে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। বিপুল পরিমাণ মজুদ থাকার পরও দফায় দফায় মেয়াদ বৃদ্ধি করে ব্যর্থ কোম্পানির মাধ্যমে ইউরিয়া সার আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে ক্রয় আদেশ পাওয়া এক কোম্পানির সার অপর এক কোম্পানির মাধ্যমে আমদানিকে কেন্দ্র করে। ফলে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ তুলে এ সার ক্রয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে মন্ত্রিসভা ক্রয় কমিটি। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এখন এই সার আমদানি করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি)।
এ বিষয়টি এখন বিসিআইসিতে ‘ওপেন সিক্রেট’।
লিফটম্যান থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা সর্বত্র আলোচিত বিষয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিসিআইসি ২৫ হাজার টন করে এক লাখ টন দানাদার ইউরিয়া সার আমদানির জন্য ২০১৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর চীনের মেসার্স রুইক্সিং গ্রুপ কর্পোরেশন লিমিটেডকে কার্যাদেশ দেয়। ওই সময়কার আন্তর্জাতিক বাজারদর অনুযায়ী প্রতি টন সারের দাম নির্ধারণ করা হয় ৩৭৯ মার্কিন ডলার। যার মোট মূল্য দাঁড়ায় তিন কোটি ৭৯ লাখ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ২৯৫ কোটি টাকা।
কিন্তু ওই চীনা কোম্পানি নির্দিষ্ট সময়ে সার সরবরাহ করতে পারেনি। ক্রয় নীতিমালা অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক টেন্ডারের নিয়ম হচ্ছে নির্দিষ্ট সময়ে মাল সরবরাহ করতে না পারলে ওই কোম্পানির ব্যাংক গ্যারান্টি বাজেয়াফত করতে হবে। এক্ষেত্রে ওই কোম্পানির ব্যাংক গ্যারান্টি বাজেয়াফত না করে বরং সময় বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু সময় বৃদ্ধির পরও ওই কোম্পানি সার সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
একাধিকবার সময় বৃদ্ধি করেই বিসিআইসি ক্ষান্ত থাকেনি, বরং মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের নামও পরিবর্তন করা হয়। মূল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান রুইক্সিং গ্রুপ কর্পোরেশনের পরিবর্তে ওই সার সরবরাহ করার জন্য কোম্পানিটির স্থানীয় এজেন্ট ব্রান্ড উইন ট্রেডিং কর্পোরেশনকে ক্রয় আদেশ দেয়া হয়। এ ক্রয় আদেশ দেয়া হয়েছে স্থানীয় ঋণপত্রের ভিত্তিতে। যা সরকারের ক্রয় নীতিমালার গুরুতর লঙ্ঘন।
নিয়ম হচ্ছে, কোন কোম্পানি পণ্য সরবরাহ করতে ব্যর্থ হলে তার ক্রয় আদেশ বাতিল করে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করতে হবে। এক কোম্পানি ব্যর্থ হলে ওই কোম্পানির কাজ কোন দরপত্র ছাড়াই অন্য কোম্পানিকে দিয়ে করানোর নিয়ম শুধু বাংলাদেশে কেন বিশ্বের কোন দেশেই নেই। কোন অবস্থাতেই কোন ক্রয় কাজে সরবরাহকারী পরিবর্তনের নিয়ম নেই। কিন্তু এক্ষেত্রে তা না করে বরং মূল কোম্পানি ব্যর্থ হওয়ায় তার স্থানীয় এজেন্টকে ইউরিয়া সার সবরাহ করতে আদেশ দেয়া হয়েছে। আবার সেটা করা হয়েছে ক্রয় কমিটিতে না জানিয়ে।
ক্রয় আদেশ দেয়ার পর মন্ত্রণালয় যখন ক্রয় কমিটিকে এ কার্যাদেশ অবহিত করতে গেছে, তখন ক্রয় কমিটি এতে ভীষণ আপত্তি জানায়। ক্রয় কমিটি ওই অনিয়মের দায়ভার নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ওই অবহিতকরণ প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠায়। ফলে এ সার আমদানি নিয়ে বেশ বিপাকে পড়েছে বিসিআইসি।
এদিকে এমন এক সময়ে বিসিআইসি নিয়ম লঙ্ঘন করে এ সার আমদানির ক্রয় আদেশ দিয়েছে, যখন বোরো মৌসুম অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে অতিক্রম করার পর দেশে প্রায় সাড়ে আট লাখ টন ইউরিয়া সার মজুদ রয়েছে। ইউরিয়া সারের ভরা মৌসুম শেষ হয়ে যাওয়ার পর এখন আর ডিলার সার কারখানা বা বাফার গুদাম থেকে সার উত্তোলন করতে চাচ্ছে না। তারা সার না তোলার জন্য বিসিআইসির কাছে আবেদন করছে। ফলে বিপুল পরিমাণ অবিক্রিত সার নিয়ে বিসিআইসি এমনিতেই বেশ বেকায়দায় আছে, তার ওপর আরও এক লাখ টন ইউরিয়া সারের বোঝা তাদের ঘাড়ে চাপতে বসেছে।
শুধু তাই নয়, এ সার এমন এক সময়ে আমদানির জন্য ক্রয় আদেশ দেয়া হয়েছে যখন আন্তর্জাতিক বাজারে ওই সময়ের চেয়ে ইউরিয়ার দাম প্রায় ৮০ থেকে একশ’ ডলার কমে গেছে। সাত মাস আগে যেখানে ইউরিয়া সারের দাম ছিল চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত প্রায় ৩৮০ ডলার। বর্তমানে তা ৩০০ ডলারের নিচে নেমে গেছে।
চীনের বিভিন্ন কারখানায় বর্তমানে দানাদার ইউরিয়া (৪৬ শতাংশ নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ) সার ২৮০ থেকে ৩০০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। আবার অনেক কারখানায় ২৪০ থেকে ২৫০ ডলারেও ইউরিয়া সার বিক্রি হচ্ছে। ফলে এ সার আমদানি করলে সরকারের প্রায় ৮০ লাখ থেকে এক কোটি ডলার ক্ষতি হবে। বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৬২ কোটি থেকে ৭৮ কোটি টাকা। এই বিপুল ক্ষতির দায়ভার যারা নিয়ম লঙ্ঘন করে এ সার আমদানির অনুমতি দিয়েছে তাদেরই বহন করতে হবে।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ক্রয় আদেশ পাওয়া পরিবর্তিত কোম্পানি ওই সার সররবাহের জন্য ঋণপত্র খুলেছে। ৩০ এপ্রিলের মধ্যে এ সার আনার জন্য চীন থেকে শিপমেন্ট করতে হবে। পরিবর্তিত কোম্পানি সে প্রচেষ্টাই চালাচ্ছে। তবে বিসিআইসি চাচ্ছে কোন কারণে যাতে ওই কোম্পানি নির্দিষ্ট সময়ে সার আমদানি করতে ব্যর্থ হয়। সেক্ষেত্রে তারা আর সময় বাড়াবে না। এভাবে বিসিআইসি এ গুরুতর অনিয়ম থেকে রক্ষা পাওয়ার অপেক্ষায় আছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিসিআইসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইকবাল বলেন, ‘আমরা বিসিআইসির পক্ষ থেকে আপ্রাণ চেষ্টা করেছি সব কিছু নিয়মের মধ্যে করতে। আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপও ছিল নিয়ম মাফিক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা নিয়ম রক্ষা করতে পারিনি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা রাষ্ট্র ও সরকারের জন্য বিব্রতকর কিছু করব না। আমরা চাই সবকিছু স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মধ্যে করতে।’
সৌজন্যে: জনকণ্ঠ