একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ: হাসান আলীর রায় যে কোনো দিন
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় পালাতক সৈয়দ মোহাম্মদ হাসান আলী ওরফে হাছেন আলীর মামলার কার্যক্রম শেষ। এ মামলায় যে কোন দিন রায় ঘোষনা করা হবে মর্মে অপেক্ষমান (সিএভি) রেখেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
হত্যা, অপহরণ, আটক,লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী ৬টি অভিযোগ আনা হয় হাসান আলীর বিরুদ্ধে। গতকাল সোমবার উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-১ মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন।
হাসান আলীর বিরুদ্ধে ৬টি অভিযোগে একাত্তরে কিশোলগঞ্জ এলাকায় ২৪ জনকে হত্যা, ১২ জনকে অপহরণ ও আটক এবং ১২৫টি ঘরে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রসিকিউশন দাবি করছে তারা সবগুলো অভিযোগ প্রমান করতে সক্ষম হয়েছে।
প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী বলেন, ৬টি অভিযোগের ভিত্তিতে হাসান আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন শুরু হয়েছে। আমরা ৬টি অভিযোগই প্রমান করতে সক্ষম হয়েছি। প্রসিকিউমনের পক্ষ থেকে আমরা হাসান আলীর সর্বোচ্চ শান্তি মৃত্যুদন্ড প্রার্থনা করছি। এক প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ আলী বলেন, হাসান আলী কোথায় আছেন আমাদের কাছে জানা নেই। তবে তাকে গ্রেফতারের সাথে সাথে দন্ড কার্যকর করা হবে। এ সময় প্রসিকিউটর আবুল কালাম আযাদ উপস্থিত ছিলেন।
আসামী পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আব্দুস শুকুর খান বলেন, আমার আসামী খালাস পাবে। কাগজ পত্রের তথ্যে গড়মিল থাকায় আমি আমার আসামীর খালাস দাবি করছি।
গত ২০১৪ সালের ১১ নভেম্বর হাসান আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচার কাজ শুরু হয়। আসামির অনুপস্থিতিতেই এ মামলার কার্যক্রম চলে। তবে আসামীকে গ্রেফতারে ট্রাইব্যুনাল গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন। এর আগে প্রসিকিউটর আবুল কালাম আজাদ ২০১৪ সালের ২১ অগাস্ট হাসান আলীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করেন। ২৪ আগস্ট ট্রাইব্যুনাল তা আমলে নেয়। এবং পলাতক এ রাজাকার কমান্ডারকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়ার আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। পরে তাকে হাজির হতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিও দেয়া হয়।
একাত্তরে কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থানার রাজাকার কমান্ডার ছিলেন হাসান আলী। সে সময় তিনি তাড়াইল থানা এলাকায় ‘রাজাকারের দারোগা’ নামে পরিচিত ছিলেন। তবে তিনি বর্তমানে কিশোরগঞ্জের তাড়াইলে না থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাছিহাতা গ্রামে বসবাস করছেন বলে জানা যায়।
হাসান আলীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থানার রাজাকার কমান্ডার ছিলেন তিনি। ওই এলাকায় তিনি পরিচিত ছিলেন ‘রাজাকারের দারোগা’ ও ‘রাজাকার ওসি’ হিসাবে।
সৈয়দ হাসান আলীর বাবা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দিন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান এবং কিশোরগঞ্জ মহকুমা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। বাবার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে অখণ্ড পাকিস্তানের ধারণা মাথায় নিয়ে তিনি রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল পাকিস্তানী বাহিনী কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থানা সদর দখল করে ক্যাম্প বসায়। হাসান আলী তাদের সব ধরনের সহযোগিতা দেন। পরে তিনি কিশোরগঞ্জ মহকুমার তাড়াইল থানায় রাজাকার কমান্ডার হিসেবে নিয়োজিত হন।
হাসান আলীর বিরুদ্ধে ছয় অভিযোগ:
অভিযোগ ১: একাত্তরের ২৭ এপ্রিল হাসান আলীর নির্দেশে তাড়াইল থানাধীন সাচাইল গ্রামের পূর্বপাড়ার হাছান আহমদ ওরফে হাচু ব্যাপারীর বসতবাড়ীর সাতটি ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা।
অভিযোগ ২: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ২৩ অগাস্ট হাসান আলীর নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা তাড়াইল থানাধীন কোনাভাওয়াল গ্রামের শহীদ তোফাজ্জল হোসেন ভূঁইয়া ওরফে লালু ভূঁইয়াকে হত্যা করে দুটি ঘরে লুটপাট চালানো হয় এবং আরো দুজনকে অপহরণ ও আটক করা হয়।
অভিযোগ ৩: একাত্তরের ৯ সেপ্টেম্বর তাড়াইল থানার শিমুলহাটি গ্রামের পালপাড়ায় অক্রুর পালসহ ১২ জনকে হত্যা এবং ১০টি ঘরে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে হাসান আলীর লোকজন। ওই গ্রামের পুরুষদের ধরে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হয়।
অভিযোগ ৪: একাত্তরের ২৭ সেপ্টেম্বর তাড়াইল থানাধীন ভোরগাঁও গ্রামের বেলংকা রোডে সতীশ ঘোষসহ ৮ জনকে হত্যা ও ১০ জনকে অপহরণ এবং এবং ২৫ হাজার টাকার মালামাল লুটপাটে নেতৃত্ব দেন হাসান আলী।
অভিযোগ ৫: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৮ অক্টোবর তাড়াইল থানাধীন আড়াইউড়া গ্রামের কামিনী কুমার ঘোষের বসতবাড়ী থেকে কামিনী কুমার ঘোষ ও জীবন চক্রবর্তীকে অপহরণের পরে হত্যা এবং ছয়টি ঘরে লুটপাট চালায় হাসান আলীর লোকজন।
অভিযোগ ৬: একাত্তরের ১১ ডিসেম্বর হাসান আলীর নেতৃত্বে তাড়াইল থানাধীন সাচাইল গ্রামের পশ্চিমপাড়ায় রাশিদ আলী ব্যাপারীকে হত্যা এবং ১০০টি ঘরে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।