নেতাকর্মীদের ভয় আর হতাশায় ফেলতে খালেদার ওপর হামলা
সরকারবিরোধী জোটের ভেতরে আতঙ্ক ছড়ানো ও নেতাকর্মীদের চাপে ফেলা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার মূল উদ্দেশ্য। খালেদার নির্বাচনী প্রচারণা বাধাগ্রস্ত করা বা তার প্রচারণায় ভীত হয়ে এ হামলা হচ্ছে না।
এর মধ্য দিয়ে সারাদেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের কাছে বার্তা পৌঁছানো— যেখানে খালেদার উপরই হামলার ঘটনা ঘটছে, সেখানে তৃণমূল বা অন্যরা বিবেচনায় নেই সরকারের কাছে।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানোর একটি পরিকল্পনা রয়েছে বলে দলটির নীতিনির্ধারণী সূত্রে আভাস পাওয়া গেছে, সেটি ব্যর্থ করাও এ হামলার একটি কারণ।
নির্বাচনী প্রচারণায় খালেদার গাড়িবহরে হামলার মূলেই রয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এ-সব কৌশল।
বিএনপির আন্দোলন ঠেকাতে এই কৌশল থাকলেও প্রকাশ্যে এ হামলার দায় তাদের ওপর দিয়েই পার পেতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এমন তথ্যই জানিয়েছেন।
এ সব হামলা বন্ধে দলটির পক্ষ থেকে নেতাকর্মীদের প্রতি কোনো নির্দেশনা আসবে কিনা জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনার পেছনে যেহেতু আওয়ামী লীগের বা সরকারের সম্পৃক্ততা নেই সেহেতু বন্ধের জন্যেও নির্দেশনা আসার সুযোগ নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরাতো বলেছি এর সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততা নেই, বিক্ষুব্ধ জনগণই এ সব ঘটনা ঘটাচ্ছে।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে প্রচারণা থেকে বিরত রেখে বিএনপি নেতা-কর্মীদের ভয় আর হতাশায় ফেলতেই গত কয়েকদিন তার গাড়িবহরে হামলা চালানো হয়েছে। এ ছাড়া নতুন সপ্তাহের শুরু থেকেই বিভিন্ন মামলায় বিরোধী জোটের সন্দেহভাজন নেতা-কর্মীদের গতিবিধি আরও নজরদারিতে আনা হবে। ক্ষমতাসীনদের দাবি নির্বাচন নির্বিঘ্ন করতেই এমন ব্যবস্থা।
আওয়ামী লীগ নেতাদের মতে, বিএনপি নেত্রীর ডাকা টানা তিন মাসের হরতাল-অবরোধে পেট্রোলবোমায় মানুষের করুণ মৃত্যু আর অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতির কারণে খালেদা জিয়া মূল ধারার রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন। সিটি নির্বাচনের সুযোগ কাজে লাগিয়ে তার জনসম্পৃক্ত হওয়ার এবং সিটি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার সুযোগ না দেওয়ার এখনই মোক্ষম সময়। তাদের ভাষায় ব্যর্থ সহিংস হরতাল অবরোধ খালেদা জিয়ার রাজনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সিটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে খুব সহজেই মূলধারার রাজনীতিতে তাকে ফিরতে দিতে রাজি নয় আওয়ামী লীগ।
তারা মনে করেন, খালেদা তার অতীত কৃতকর্মের জন্যে এখনো দুঃখ প্রকাশ করেননি। তারা বলছেন আগে মানুষ পোড়ানোর ঘটনায় খালেদা জিয়াকে ক্ষমা চাইতে হবে।
এমন রাজনৈতিক কূটকৌশলের কারণেই খালেদা জিয়ার পথ রুদ্ধ করতে তার গাড়িবহর লক্ষ্য করে শাসক দল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ছে।
আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী কয়েকটি সূত্র জানায়, খালেদা জিয়াকে জনস্রোতে মিশতে না দেওয়ার পাশাপাশি বিএনপির নেতাকর্মীদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে নির্বাচনী মাঠ থেকে দূরে রাখতেই বিভিন্ন অজুহাতে খালেদা জিয়ার সিটি নির্বাচনী প্রচারণার গাড়িবহরে হামলা করা হয়েছে।
এদিকে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মী অনেককেই খালেদার গাড়িবহরে হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়ার স্থিরচিত্র ও ভিডিওচিত্র পাওয়া যাচ্ছে। এর দায় অস্বীকার করতে চান না দলীয় নেতারা। দলের একটি অংশ বরং এটিকে স্বীকার করে নিয়েছেন।
তারা বলছেন, খালেদার গাড়িবহরে হামলায় যাদের উপস্থিতি ছিল তাদের শুধু দলীয় পরিচয় দেখলেই হবে না। তারা সমাজের মানুষও। রাজনীতি করে বলে স্বতঃস্ফূর্ত কোনো কর্মকাণ্ডে তারা থাকতে পারবে না, এটা হয় না।
বিব্ধুব্ধ জনগণ খালেদার গাড়িবহরে হামলা করছে দাবি করে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এটি স্বতঃস্ফূর্ত এখানে আওয়ামী লীগ বা সরকারের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’
কিন্তু ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতাকর্মীদের হামলাগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ততা তো রয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন- ছাত্রলীগ, যুবলীগ যারা করে তারা কি সমাজের মানুষ নয়? এরাও তো সমাজেরই মানুষ। খালেদার তিন মাসের অবরোধে এদেরও আত্মীয়-স্বজন ভাই বন্ধু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সংগঠন করে বলে তারা প্রতিবাদ করতে পারবে না, এটাতো হতে পারে না।
সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পদক্ষেপ নিয়ে জানতে চাইলে খালিদ মাহমুদ বলেন, ‘খালেদার নির্বাচনী প্রচারণা চোরাগোপ্তা। তিনি বের হওয়ার আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবহিত করলে সেইক্ষেত্রে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপর এর দায় বর্তায়।’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘আমি মিটিংয়ে আছি।’ এর পরে তিনি আর ফোন ধরেননি।
এদিকে হামলার ঘটনা অব্যাহত থাকলেও বিষয়টিকে পাত্তাই দিচ্ছে না ক্ষমতাসীনরা। বিক্ষুব্ধ জনতার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ এটি উল্লেখ করে বিষয়টিকে সহজ করে তুলতে চায় শাসক দল। নির্বাচন বানচাল ও প্রশ্নবিদ্ধ করতে এটা খালেদার ‘নাটক’বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় আওয়ামী লীগ নীতি-নির্ধারণী মহল।
এদিকে সরকারের বা আওয়ামী লীগের কোনো মহলের ইন্ধনে নির্বাচনী প্রচারণায় খালেদার গাড়িবহরে হামলার কথা অস্বীকার করে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ বলেন, ‘গত ৩ মাসে খালেদা দেশে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছেন এখন তারই ফল পাচ্ছেন। এরসঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’ গণমাধ্যমে ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাদের নাম, পদ-পদবীসহ এসেছে- এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কিছু পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল সরকারের বিরুদ্ধে রয়েছে। এ সব তাদেরই কাজ।’
আওয়ামী কয়েকটি সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্দেশেই দলটির নেতা-কর্মীরা এমন ধাওয়া ও হামলার ঘটনা ঘটাচ্ছেন।
এ ঘটনায় বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায় হামলার মূল নেতৃত্বে ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। এর মধ্যে মাহমুদুল হাসান টিটু ও মশিউর রহমান রুবেল ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, লিটন শাহবাগ থানা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, দারুস সালাম শাকিল বঙ্গবন্ধু হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি, আশিকুল পাঠান সেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের পরিকল্পনা ও কর্মসূচি বিষয়ক সম্পাদক। পেছনে পিস্তলসহ যে ছবিটি ছাপা হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সেটি ঢাকা কলেজের এক ছাত্রলীগ নেতার বলে বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে। তাদের অধিকাংশই ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলমের অনুসারী। ঘটনাস্থলের পাশেই ছিল ছাত্রলীগ সম্পাদকের বাসা।