ওপরের নজর কাড়তেই খালেদার গাড়িবহরে ছাত্রলীগ-যুবলীগের হামলা
দলের শীর্ষ নেতাদের নজর কাড়তেই আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের নেতারা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা চালাচ্ছেন। হামলাকারী ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের এ নেতারা সংগঠনের অভ্যন্তরে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করতে এমনটি করছেন।
সামনে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সম্মেলন। সম্মেলনে পদ বাগিয়ে নিতে খালেদার গাড়িবহরে হামলাকে একটি সুযোগ মনে করছেন কেউ কেউ। কারো কারো ইচ্ছা সংবাদ শিরোনাম হওয়ার। এর ফলে বাণিজ্যিক সুফল আসে বলে ধারণা তাদের। এ সব ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার ‘সুফল’ হিসেবে টেন্ডারবাজিসহ আয়-রোজগারের পথ প্রশস্ত হয়। খালেদার গাড়ি বহরে হামলায় জড়িত এ সব সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। অভিযোগ রয়েছে, হামলাকারীদের পেছনের শক্তি ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় সংসদ সদস্যরা।
খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলায় আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের নেতাদের অংশগ্রহণে উৎসাহী হওয়ার পেছনের অন্যতম কারণ এগুলো। এ পর্যন্ত ৪ দফা খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা হয়েছে। এর প্রত্যেকটিতে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছে। খালেদা জিয়ার প্রচারণার প্রথম দিন উত্তরায় কালো পতাকা দেখিয়ে বাধা দেওয়া হয়। এতে থানা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সহযোগী সংগঠন, দ্বিতীয় দফায় কারওয়ান বাজারেও ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা। তৃতীয় দফায় ফকিরাপুল ও চতুর্থ দফায় বাংলামটরের পরীবাগে হামলায় নেতৃত্ব দেয় ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতারা। যদিও আওয়ামী লীগ ও সরকারের একাধিক মন্ত্রী এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাদের দাবি, গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় যারা জড়িত তারা সবাই কোনো না কোনোভাবে খালেদার অবরোধে ক্ষতিগ্রস্ত। হরতাল-অবরোধে ক্ষতিগ্রস্তরাই এ সব অনভিপ্রেত ঘটনার সূত্রপাত করেছে।
এ ছাড়া বিএনপি নেত্রীর গাড়িবহরে হামলার ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার বহর থেকেও উসকানি দেওয়া হয়েছে বলে শাসক দলের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সর্বশেষ গত বুধবার বিকেলে দলীয় মেয়র সাঈদ খোকনের নির্বাচনী প্রচারণায় পরীবাগ এলাকায় ছিল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এদের একটি অংশ খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলায় অংশ নেয়। তাদের অভিযোগ, বিএনপি চেয়ারপারসনের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সিকিউরিটি ফোর্সের (সিএসএফ) একটি গাড়ির ধাক্কা লাগে প্রচারণারত এক ছাত্রলীগ কর্মীর গায়ে। পরে বিক্ষুব্ধ জনতাকে সঙ্গে নিয়ে ছাত্রলীগ নেতা খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা চালায়। এর আগে ফকিরাপুলে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী সাঈদ খোকনের প্রচারণা চালাচ্ছিল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। খালেদা জিয়া ভোট প্রার্থনা করছিলেন বিএনপি সমর্থিত ঢাকা দক্ষিণের প্রার্থী মির্জা আব্বাসের জন্য। প্রচারণা চালাতে চালাতে মুখোমুখি হয়ে যায় দুই দলের নেতাকর্মীরা। প্রথমে বোতল ছোড়াছুড়ি হয়। পরে সরকার সমর্থকরা খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা চালায়। তবে প্রথম দিন উত্তরায় প্রতিরোধের জন্য বিক্ষুব্ধদের দায়ী করেন আওয়ামী লীগ নেতারা। এর পরদিন কারওয়ান বাজারের হামলায়ও বিক্ষুব্ধদের কথা বলছেন ক্ষমতাসীনরা। যদিও বিক্ষুব্ধদের মধ্যে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের দেখা গেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী সম্পৃক্ত হলেও সরকারের এড়িয়ে যাওয়ার মনোভাব হামলাকারীদের উৎসাহিত করছে। এ প্রসঙ্গে ড. আকবর আলী খান বলেন, দায় এড়িয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি অপরাধীদের উৎসাহিত করে। এটা শুভ নয়।
আওয়ামী লীগ ও সরকারের মন্ত্রীরা তাদের দলের নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করলেও এ ঘটনায় বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায় হামলার মূল নেতৃত্বে ছিল ছাত্রলীগের বিভিন্ন পদস্থ কেন্দ্রীয় নেতা। এর মধ্যে মাহমুদুল হাসান টিটু ও মশিউর রহমান রুবেল ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, লিটন শাহবাগ থানা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, দারুস সালাম শাকিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) বঙ্গবন্ধু হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি, আশিকুল পাঠান সেতু ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের পরিকল্পনা ও কর্মসূচি বিষয়ক সম্পাদক, শাহবাগ থানা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক জাকির হোসেন ও পেছনে পিস্তলসহ যে ছবিটি ছাপা হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সেটিও ঢাকা কলেজের এক ছাত্র নেতার বলে বিভিন্ন অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। সূত্র নিশ্চিত করেছে এদের অধিকাংশই ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলমের অনুসারী। ঘটনাস্থলের পাশেই ছিল ছাত্রলীগ সম্পাদকের বাসা। হামলায় অংশ নেওয়া বেশ কয়েকজনের সঙ্গে দ্য রিপোর্টের এ প্রতিবেদকের কথা হয়।
বাংলামটরের পরীবাগে খালেদার গাড়িবহরে হামলার সঙ্গে জড়িত ছাত্রলীগ নেতা ঢাবি বঙ্গবন্ধু হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি দারুস সালাম শাকিল সঙ্গে আলাপকালে হামলার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, সামনে ছাত্রলীগের সম্মেলন এ পরিস্থিতিতে ‘পারফরমেন্স’ শো করে যদি এগিয়ে যেতে পারি।
খালেদার গাড়িবহরে গত বুধবার হামলার পর পর কথা হয় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুল হাসান টিটুর সঙ্গে। ঘটনাস্থলে এ প্রতিবেদককে তার উপস্থিতির কথা জানান দিয়ে বলেন, সংগঠনে ‘লাইম লাইটে’ আসতে হলে এগুলোর সঙ্গে জড়িত থাকতে হয়।
অপর সাংগঠনিক সম্পাদক মশিউর রহমান রুবেল বলেন, বুধবার খালেদার গাড়িবহরে হামলার উদ্দেশ্যে আমরা সেখানে যাইনি। আমরা আমাদের মেয়র প্রার্থী সাঈদ খোকনের প্রচারণায় ব্যস্ত ছিলাম। একটু পরে দেখতে পাই খালেদার গাড়ি বহর আসছে। ওই বহরে থাকা তার নিরাপত্তাকর্মী সিএসএফের গাড়ি আমাদের দুইজন নেতার উপরে তুলে দেয়। তখনি সংঘর্ষ ঘটে। রুবেল বলেন, এটি আমাদের হামলা নয়, সাধারণ জনতার জনরোষের শিকার খালেদা।
ওইদিন হামলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন শাহবাগ থানা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক জাকির হোসেন। খালেদার গাড়িবহরে হামলার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাজনীতি করতে হলে এ সব ঘটনায় থাকতে হয়।
জানা গেছে, সংগঠনের কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতাদেরও ইঙ্গিত রয়েছে এ সব হামলার পেছনে। গত বুধবার বিএনপির চেয়ারপারসনের গাড়িবহরে হামলার আগে পরীবাগে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের জড়ো হওয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান ও সাধারণ সম্পাদক ওমর শরীফ তাদের কর্মীদের নির্দেশ দেন। নির্দেশ দেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলমও। তবে ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের সভাপতি মেহেদী হাসান তার নির্দেশের কথা অস্বীকার করেন। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাজমুলের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও সম্ভব হয়নি।
এ প্রসঙ্গে মূল্যায়ন জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বাহাদুর বেপারী বলেন, হামলার সঙ্গে ছাত্রলীগ জড়িত এটা ঢালাওভাবে বলা যাবে না। এখানে দেখতে হবে যারা জড়িত তাদের আত্মীয়-স্বজন কেউ খালেদার ডাকা অবরোধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিনা? যদি তাই হয় তাদের গণরোষ থাকতেই পারে।
তবে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলায় আওয়ামী লীগ বা দলটির সহযোগী সংগঠনের কারো সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। তিনি বলেন, ‘বিক্ষুব্ধ জনগণই এ সব ঘটনা ঘটাচ্ছে।’