৭ মাত্রার ভূমিকম্পই সহনশীল নয়: রাজধানীর সাড়ে ৫ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের দায় কার
রাজধানীতে ঝূঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা কত তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই সরকারের কাছে। ঢাকায় সেবা প্রদানকারী প্রধান দুই সংস্থা ঢাকা সিটি করপোরেশন ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাছে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য। আর যে সব ঝূঁকিপূর্ণ ভবনের তথ্য রয়েছে সেগুলোর দায়দায়িত্ব নিতেও অপরাগতা প্রকাশ করছে সংস্থা দুটো।
২০০৪ সালে পুরান ঢাকার শাখারী বাজারে ভবন ধসে ১৭ জনের মৃত্যু হলে ঢাকা সিটি করপোরেশন কারিগরি জরিপের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন শনাক্ত ও তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। প্রথমে ১১৩টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের পাইলট প্রকল্প হিসেবে এই কারিগরি জরিপ শুরু করা হয়। পরে ২০০৫ সাল থেকে সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিতের কাজ শুরু করে সংস্থাটি। তবে পর্যাপ্ত কারিগরি সহায়তা ও অর্থের সংকুলান না হওয়ায় মাত্র সাড়ে পাঁচ হাজার ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে সিটি করপোরেশন। পরবর্তীকালে এ সব ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (রাজউক) একটি চিঠিও দেয় সিটি করপোরেশন।
অন্যদিকে ঢাকার উন্নয়ন, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা প্রধান সংস্থা রাজউক রাজধানীতে মোট ৪ হাজার ৯৭টি নকশা বহির্ভূত ভবন শনাক্ত করে একটি তালিকা প্রকাশ করে। এর মধ্যে মাত্র ৬০টি ভবনের অবৈধ অংশ উচ্ছেদ করেছে সংস্থাটি। একই সঙ্গে রাজউক রাজধানীতে মোট ৩১২টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে এ সব বাড়ির ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ঢাকা সিটি করপোরেশনের কাছে তালিকা পাঠালেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি দুই সিটি করপোরেশনের কোনোটিও।
এদিকে রাজধানীর অধিকাংশ ভবনেরই নির্মাণ ত্রুটি রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এক গবেষণার প্রতিবেদন অনুযায়ী রাজধানীতে ৬৭ থেকে ৭০ ভাগ ভবনই রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল নয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘২০০৪ সালে পাইলট প্রকল্প হিসেবে পুরান ঢাকার শাঁখারী বাজার এলাকায় ১১৩টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে আমরা শনাক্ত করি। কিন্তু ২০০৯ সালে পুরান ঢাকার এ সব এলাকাকে ঐতিহ্যবাহী এলাকা হিসেবে রাজউক ঘোষণা করায় এ সব ভবনের ব্যাপারে কিছুই করা সম্ভব নয়।’
তিনি বলেন, ‘ওই বছর বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহায়তায় আমরা একটি কারিগরি টিম গঠন করে পুরো ঢাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করার কাজ শুরু করি। কিন্তু পর্যাপ্ত টেকনিক্যাল সাপোর্ট ও বাজেট না থাকায় আমরা পুরো কাজ শেষ করতে পারিনি। তবে এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে সাড়ে পাঁচ হাজার ভবনের তালিকা রয়েছে। এ সব ভবনের অধিকাংশই রাজউকের অনুমোদিত নকশায় করা।’
সিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘রাজউকের অনুমোদিত নকশায় করা ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হোক বা নকশার ব্যত্যয় ঘটুক সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব রাজউকের। এগুলো আমাদের কাজ না। আইন অনুযায়ী ভবনের অনুমোদন দেয় রাজউক এবং নিয়ন্ত্রণও করে রাজউক।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ মো. দিলবাহার আহমেদ বলেন, ‘ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগ হওয়ার আগে আমরা যে সাড়ে পাঁচ হাজার ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে শনাক্ত করেছি সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার বা দায়িত্ব আমাদের নেই। আমরা রাজউককে এই তালিকা দিয়েছিলাম ভবনগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু তারা ব্যবস্থা নিয়েছে কি নেয়নি, সেটা আমরা জানি না।’
এ ব্যাপারে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাজউকের পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক সদস্য প্রকৌশলী শেখ আব্দুল মান্নান বলেন, ‘রাজউকের প্রধান দায়িত্ব হল তার আওতাভুক্ত এলাকায় ভবন নির্মাণে নকশার অনুমোদন দিবে এবং অনুমোদন দেওয়া ভবনগুলো নির্মাণ চলাকালে তা নিয়ন্ত্রণ করবে। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ ভবন শনাক্ত করার দায়িত্ব রাজউকের না। আর এ সব ভবন শনাক্তের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। রাজউকের দায়িত্ব অননুমোদিত ভবন শনাক্ত করা এবং অননুমোদিত অংশ উচ্ছেদ করা।’
এ ব্যাপারে রাজউকের উন্নয়ন বিভাগের সদস্য মো. নাঈম আহমেদ খান বলেন, ‘রাজউক এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ৯৭টি ভবনকে শনাক্ত করেছে যেগুলো অনুমোদনহীন ও অনুমোদিত নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মিত। এ সব ভবনের বিরুদ্ধে আমরা ধারাবাহিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। কিন্তু পর্যাপ্ত জনবল ও কারিগরি ব্যবস্থা না থাকায় ধীরগতিতে এ সব কাজ চলছে। তা ছাড়া বেশ কিছু ভবনের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারছি না। কারণ এ সব ভবনের মালিক উচ্চ-আদালত থেকে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ নিয়ে এসেছে। এ সব মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আমরা কিছু করতে পারছি না।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্মসম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘রানা প্লাজা ধসের পর বুয়েট রাজধানীর ধানমণ্ডি ও মোহাম্মদপুর এলাকায় একটি টেকনিক্যাল সার্ভে চালিয়েছে। ওই সার্ভের সঙ্গে আমি যুক্ত ছিলাম। সার্ভেতে দেখা যায় ধানমণ্ডি এলাকাল ৬৭ ভাগ ভবনই ৭ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল নয় আর মোহাম্মদপুর এলাকায় তা ৭০ ভাগে উন্নীত হয়েছে।’
ইকবাল হাবিব বলেন, ‘এখন যদি পুরান ঢাকা ও বাসাবো, খিলগাঁও, শাজাহানপুর এলাকায় এই সার্ভে করা যায় তাহলে আমাদের আশঙ্কা প্রায় ৮০ ভাগ ভবনই ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা দীর্ঘ দিন ধরে বলে আসছি রাজধানীতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো সঠিকভাবে কাজ করছে না। নিজেদের দায়িত্ব নিজেরা পালন না করে অন্যের উপর দায় চাপাতে তারা ব্যস্ত। এতে করে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না বরং সাধারণ জনগণকে পড়তে হচ্ছে ঝুঁকিতে।’
ইকবাল হাবিব বলেন, ‘রাজউক নামে যে একটি সংস্থা আছে তাদের কাজ কি সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। একটি ভবনের অনুমোদন দিয়েই রাজউক খালাস। এরপর ওই ভবনটি কীভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে সেটা কে দেখবে। আবার সিটি করপোরেশনকেও ল্যাংড়া করে রাখা হয়েছে। সেও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। এটা কোনো রাজধানীর চিত্র হতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের উচিত হবে পোশাক শিল্পের মতো আবাসিক ভবনগুলোকেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কমপ্লাইন ঘোষণা করা। তা না হলে সাড়ে ৬ থেকে ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প ঢাকাকে গুঁড়িয়ে দিতে পারে। রানা প্লাজার চাইতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কয়েক হাজারগুণ বেশী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমরা একেকটা পিকিং বোমের উপর বসে আছি।’
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি স্থপতি আবু সাইদ এম আহমেদ বলেন, ‘রাজধানীর অধিকাংশ ভবনই গড়ে উঠেছে রাজমিস্ত্রিদের নকশায়। এখানে কোনো আর্কিটেক ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারকে কাজে লাগানো হয়নি। অধিকাংশ ভবনেই নির্মাণ ত্রুটি রয়েছে। রাজউকের কাজ শুধু নকশা অনুমোদন না। রাজউকের বেশ কয়েকজন অথরাইজড অফিসার রয়েছেন। যাদের কাজ অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী নির্মাণ সাইট পরিদর্শন করে নির্মাণ কৌশল তদারকি করা। একই সঙ্গে যথাযথ নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে কিনা সেগুলোও তদারকি করা। কিন্তু তাদের সব সময় অফিসে বসে থাকতে দেখা যায়, অথচ একটি ভবনের নকশা অনুমোদন থেকে শুরু করে ব্যবহারের ছাড়পত্র দেওয়া পর্যন্ত তাদের দায়িত্ব রয়েছে। রাজউক জনবলের অভাবের যে অজুহাত দেখায়, তা যৌক্তিক না। কারণ রাজউকের একজন অথরাইজড অফিসার যদি দিনে ৫টি করেও নির্মাণ সাইট পরিদর্শন করে তাহলে সপ্তাহে ৩০টি ভবনের নির্মাণ তদারকি করা সম্ভব। রাজউকের এখন প্রায় ৮ জন অথরাউজড অফিসার রয়েছেন ওই হিসেবে প্রতি সপ্তাহে ২৪০টি এবং মাসে ৭০০টির উপরে ভবন নির্মাণ তদারকি করা সম্ভব। আর এই দায়িত্বটুকু পালন করতে পারলেই চলে। তাহলে কোনো ভবন আর ঝুঁকিপূর্ণ হবে না। ঝুঁকিপূর্ণ বা অননুমোদিত বিবেচনা করে উচ্ছেদের দরকারও হবে না।’