কড়া নাড়ছে ভূমিকম্প, ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

earthquake_bd_1---Homeভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। বার বার কড়া নাড়ছে মাঝারি ও ছোট আকারের ভূমিকম্প। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত টেকটনিক প্লেটের সংঘর্ষে ভূমিকম্প হয়। বাংলাদেশ এ ধরনের তিনটি প্লেটের মধ্যে অবস্থিত। এ ছাড়া দেশের মধ্যে থাকা চ্যুতি বা ফল্ট লাইনগুলো যেকোনো সময় ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ ভূমিকম্প।
শনিবার দেশে জোরালো ভূকম্পন অনুভূত হয়। আগারগাঁও ভূমিকম্প পরিমাপ কেন্দ্র থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে ৭৪৫ কিলোমিটার দূরে নেপালে ছিল ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল। কেন্দ্রস্থলে রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৯।
ভূবিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবী প্লেট ও সাব-প্লেট দিয়ে গঠিত। এ রকম দু’টি প্লেটের মাঝখানে যে ফাঁক থাকে তাকে বলা হয় ফল্ট লাইন। প্লেটগুলো গতিশীল। দু’টি চলন্ত প্লেটের ফল্ট লাইনে পরস্পর সংঘর্ষ হলে অথবা হঠাৎ ফল্ট লাইনে শূন্য অবস্থার সৃষ্টি হলে ভূমিকম্প হয়।
বুয়েটের (বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) গবেষকরা এরই মধ্যে এলাকাভিত্তিক ভূমিকম্পের ঝুঁকির মানচিত্র তৈরী করেছেন।
বাংলাদেশ ভারতীয়, ইউরেশীয় ও মিয়ানমারের টেকটনিক প্লেটের মধ্যে অবস্থান করছে। ভূ-তত্ত্ব বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ভারতীয় ও ইউরেশীয় প্লেট দু’টি (১৯৩৪ খ্রীষ্টাব্দের পর থেকে) দীর্ঘদিন ধরে হিমালয়ের পাদদেশে আটকা পড়ে আছে।
বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি ভূ-তাত্ত্বিক চ্যুতি এলাকা বা ফল্ট জোন সচল অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে মধুপুর চ্যুতি, বগুড়া চ্যুতি এলাকা, রাজশাহীর তানোর চ্যুতি এলাকা, ত্রিপুরা চ্যুতি এলাকা, সীতাকুণ্ড-টেকনাফ চ্যুতি এলাকা, হালুয়াঘাট চ্যুতির ডাওকী চ্যুতি এলাকা, ডুবরী চ্যুতি এলাকা, চট্টগ্রাম চ্যুতি এলাকা, সিলেটের শাহজিবাজার চ্যুতি এলাকা ও রাঙ্গামাটির বরকলে রাঙ্গামাটি চ্যুতি এলাকা।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর (১ জানুয়ারি থেকে ২৫ এপ্রিল) দেশে ২০টি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘ভারত ও বার্মা (মিয়ানমার) প্লেটের সংযোগ স্থলে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পূর্বাংশ বার্মা প্লেটের মধ্যে, পশ্চিমাংশ ইন্ডিয়া (ভারত) প্লেটের মধ্যে। এমন ভূ-তাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্যে ভূমিকম্প হবে এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। ভূমিকম্প আমাদের দরজায় আঘাত হানতে শুরু করেছে।’
এ সব অঞ্চলে যে ভূমিকম্পের উৎস রয়েছে সেখানে গত ৪০০ বছরে ৭-এর বেশী মাত্রায় অনেকগুলো ভূমিকম্প হয়েছে। ভূমিকম্পের উৎস দেশের ভেতরে রয়েছে, দেশের বাইরে উত্তর ও পূর্বেও রয়েছে বলেন তিনি।
সৈয়দ হুমায়ুন আরও বলেন, ‘দেশের বাইরে কাছাকাছি ও দেশের ভেতরে ভূমিকম্পের উৎস থাকায় যেকোনো সময় বাংলাদেশে ভূমিকম্প হতে পারে। আমাদের ঢাকা একটি অপরিকল্পিত ও জনবহুল নগরী। বড় ধরনের ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে ঢাকার অবস্থান ভূমিকম্পের উৎস থেকে ৫০ থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে হলে ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপক হতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তবে প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের প্রস্তুতি কেমন? আসলে আমাদের কোনো প্রস্তুতি নেই। আজ দেখা গেল ভূমিকম্পের কারণে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে নীচে নেমে এসেছে। মানুষের মধ্যে সেই সচেতনতা নেই, ভূমিকম্পের সময় কী করতে হবে। সরকার মানুষকে সচেতন করতে ব্যর্থ হয়েছে।’
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল তথা সিলেট ও তৎসংলগ্ন এলাকা প্রবল ভূমিকম্পপ্রবণ। ঢাকা ও রাজশাহী শহরও ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা বলে জানান ভূ-তত্ত্ব বিজ্ঞানীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. আ স ম উবাইদ উল্লাহ বলেন, ‘টাঙ্গাইলের মধুপুর ফল্টের কারণে ঢাকা ঝুঁকিপূর্ণ। এ ফল্টের বিস্তৃতি খুব বেশী নয় (১২০ কিলোমিটারের মতো), মনে করা হয় ৬ বা সাড়ে ৬ মাত্রায় ভূমিকম্প হতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সিলেটে ডাওকী ফল্ট রয়েছে। সেখানে ভূমিকম্প হলেও ঢাকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই সব সময় প্রস্তুত থাকতে হবে। বিল্ডিং কোড মেনে বাড়িঘর নির্মাণ করতে হবে।’
এ দু’টি ফল্টের কারণে অতীতে দেশে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হয়েছে বলেও জানান এ ভূ-তত্ত্ব বিজ্ঞানী।
চলতি বছর দু’টি ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল দেশের ভেতর। এর মধ্যে গত ৯ জানুয়ারি ৩ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে, এর কেন্দ্র ছিল ভৈরব বাজার। এ ছাড়া গত ৮ এপ্রিল ৪ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এর কেন্দ্র ছিল বাগেরহাটের শরণখোলা।
বুয়েটের গবেষকদের ভূমিকম্প ঝুঁকির মানচিত্রে দেখা যায়, বাংলাদেশের ৪৩ শতাংশ এলাকা ভূমিকম্পের উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে (জোন-১), ৪১ শতাংশ এলাকা মধ্যম (জোন-২) ও ১৬ শতাংশ এলাকা নিম্ন ঝুঁকিতে (জোন-৩) রয়েছে।
জোন-১-এর মধ্যে রয়েছে— পঞ্চগড়, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার সম্পূর্ণ অংশ এবং ঠাকুরগাঁও, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারের অংশবিশেষ।
রাজশাহী, নাটোর, মাগুরা, মেহেরপুর, কুমিল্লা, ফেনী ও ঢাকা রয়েছে জোন-২-এর অধীনে।
জোন-৩-এর মধ্যে রয়েছে বরিশাল, পটুয়াখালী এবং সব দ্বীপ ও চর।
ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পগুলো : ১৮৬৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ভয়াবহ বেশ কয়েকটি ভূমিকম্পের মুখোমুখি হয়। এর মধ্যে ৬ থেকে ৬ মাত্রার বেশী তিনটি ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল দেশের ভেতরেই।
আবহাওয়া অধিদফতরের পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ১৮৬৯ সালের ১০ জানুয়ারি ভারতে (কেন্দ্র) ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এরপর ১৮৮৫ সালে সিরাজগঞ্জে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়।
১৮৯৭ সালের ১২ জুন ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক’ ভারতবর্ষে আঘাত হানে। এটা আজও পৃথিবীর অন্যতম বড় ভূমিকম্প হিসেবে পরিচিত। এই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল ভারতের শিলং শহর। তবে এর প্রভাব বর্তমান বাংলাদেশসহ বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। সে সময়ের ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন মিশনারীদের বিল্ডিং ভেঙে পড়েছিল এই ভূমিকম্পের কারণে। এ ছাড়াও ঢাকায় প্রায় ৪৫০ জন মানুষ মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছিল।
এরপর দেশে ১৯১৮ সালের ৮ জুলাই ৭ দশমিক ৬ মাত্রার ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হয়। এর কেন্দ্র ছিল বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গল।
১৯৩০ সালের ২ জুলাই ভারতে (কেন্দ্র) ৭ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ১৯৫০ সালের ১৫ আগস্ট আসামে হয় ৮ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প। ১৯৫৪ সালের ২১ মার্চ ভারতের মণিপুরে ৭ দশমিক ৪ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল।
ভারতের আসামে (কেন্দ্র) ৬ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয় ১৯৭৫ সালের ৮ জুলাই। ২০১১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ভারতের সিকিমে ৬ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এ ভূমিকম্পের কেন্দ্র বাইরে হলেও তীব্র কম্পন অনুভব করে বাংলাদেশ।
১৯৯৭ সালের ২২ নভেম্বর চট্টগ্রামে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে ৫ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এ ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল বাংলাদেশের কক্সবাজারের মহেশখালী দ্বীপ।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend