বিজ্ঞান ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতে ব্যর্থ!
নিঃশব্দে মৃত্যুর নির্মম থাবা ভূমিকম্প এগিয়ে আসছে। বিজ্ঞানীরা এখনও ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতে ব্যর্থ। কেবল ভূকম্পনের পর ভূগর্ভে শিলাচ্যুতি ও ফাটলের কারণে ঘরবাড়ি অবকাঠামো কত মাত্রায় কেঁপে ও দুলে উঠল তা রেকর্ড করা সম্ভব। অর্থাৎ ভূকম্পনে প্রাণ ও সম্পদ বিনাশ হওয়ার পর বলা যায়, প্রকৃতির নির্মমতার মাত্রা কত ছিল। সকল ভূকম্পন জীবন কেড়ে নিয়ে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত করে না। শুধু কয়েকটি ভূকম্পন রেখে যায় ধ্বংসের ভয়ঙ্কর চিহ্ন।
আধুনিক বিশ্বে এখন পর্যন্ত ভূমিকম্পের তীব্রতা পরিমাপ করা হয় রিখটার স্কেলে। ১৯৩৫ সালে মার্কিন ভূবিজ্ঞানী চার্লস এফ রিখটার এই স্কেল আবিষ্কার করেন। তার নামেই স্কেলটির নামকরণ হয়। ভূবিজ্ঞানীদের মতে বাংলাদেশ ভয়াবহ ভূমিকম্প জোনের মধ্যে পড়েছে। তার আভাস মাঝে মধ্যেই মিলছে। সর্বশেষ শনিবার দুপুরে দুই দফায় ভয়াবহ কম্পন (দুলে উঠেছিল সকল অবকাঠামো স্থাপনা, কেঁপে উত্তাল ঢেউ সৃষ্টি করেছিল পুকুর ও জলাশয়ের পানি) সতর্ক বার্তা দিয়ে গেল। এই ভূকম্পনের উৎপত্তিস্থল নেপাল।
ভূতাত্ত্বিকরা জানান, হিমালয়ান চ্যুতির অভ্যন্তরে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়েছে। হিমালয় পর্বতমালার আশপাশে প্রায় ২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভূমিকম্পের সূত্রপাত হয়ে মাত্রা রিখটার স্কেলের ৮ দশমিক ৩ পর্যন্ত হতে পারে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, হিমালয় পর্বতমালার নিচে ইন্ডিয়ান প্লেটটি ইউরেশিয়ান প্লেটের নিচে প্রবেশ করায় সেখানে একটি টেকনোটিক লকের সৃষ্টি হয়েছে। প্লেট দু’টির চাপে লকটি যখনই খুলে যাবে তখনই ঘটবে মহাবিপর্যয়।
ভূবিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন প্রতি একশ’ বছরে একবার ইন্ডিয়ান প্লেটটি ইউরেশিয়ান প্লেটের নিচে চলে যায়। ইতোমধ্যে একশ’ বছর অতিবাহিত হয়েছে। শনিবার যে ধাক্কাটি দিল তাতে কখন কী ঘটবে বলা যায় না। এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় কম্পন এটি। ভূমিকম্পের পূর্বাভাস এখনও যা মেলে তা সম্পূর্ণ প্রকৃতি নির্ভর, আধুনিক বিজ্ঞান নির্ভর নয়। তারপরও প্রকৃতির পশু-পাখি-কীটপতজ্ঞ কম্পনের সামান্য আগে জানান দেয় সম্মুখেই প্রলয়। পশু-পাখিরা কিভাবে তা জানতে পারে এখনও তা নিয়ে গবেষণা চরছে। কোন কিনারা করতে পারছে না বিজ্ঞানীরা।
চীন ও জাপানের মানুষ এখনও প্রকৃতি নির্ভর পূর্বাভাসের মাধ্যমে সতর্ক ব্যবস্থা নেয়। ওই দুই দেশের মানুষ কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য করেÑ হাঁস-মুরগি অস্থির হয়ে ডাক ছেড়ে ছাদে ও গাছের ডালে উঠছে কি না! মাঠে অথবা গোয়ালে গরু দড়ি ছিড়ে বেরিয়ে আসার জন্য ছুটোছুটি করছে কি-না। পোষা কুকুর ছুটোছুটি করে মাটিতে কান পেতে গন্ধ নেয়ার চেষ্টা করছে কি-না! মাটির নিচে বাসা বাঁধা পিঁপড়ে মুখে ডিম নিয়ে বেরিয়ে আসছে কি-না! এসব সিম্পটম দেখা মাত্রই লোকজন ফাঁকা মাঠে গিয়ে মাটিতে কান পেতে কম্পন দপদপ ও শোঁ শোঁ শব্দ শোনার চেষ্টা করে। হিসাব মিলে গেলে ঘর থেকে বের হয়ে খোলা মাঠে আশ্রয় নেয়।
বাংলাদেশে দিনে দিনে নগরায়নের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মাটি ও প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগও দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। তারপরও রয়েছে সচেতনতার অভাব। যে কারণে ভূমিকম্প হয়ে যাওয়ার পর কত মাত্রার কম্পন হলো শুধু এই তথ্যটুকু নিয়ে সন্তুষ্ট (!) থাকতে হয়। রিখটার স্কেল অনুযায়ী ২ দশমিক ৫ কম্পাঙ্কের ভূমিকম্পে শক্তি থাকে ১০ টু দ্যা পাওয়ার ১৭ আর্গসের নিচে। অর্থাৎ ৩ হাজার ৮শ’ লিটার বা একশ’ গ্যালোন গ্যাসোলিন পোড়ালে যে শক্তি পাওয়া যায় কম্পনের শক্তি তারই সমান। এই মাত্রার কম্পন ছোট মাপের। মৃদুও বলা যায় (হিসাব করে নিন মৃদু কম্পনেরই শক্তি এই)।
ভূকম্পনপ্রবণ এলাকাগুলোতে মাঝেমধ্যেই এই মাত্রার কম্পন ঘটে। ৪ দশমিক ৫ কম্পাঙ্কের ভূমিকম্প ১০ টু দ্য পাওয়ার ২০ আর্গসের। এটি মাঝারি ভূমিকম্প। কম্পনে একটা গা ঝাড়া দেয়। জীবন ও সম্পদহানি ঘটে ৬ কম্পাঙ্কের ভূমিকম্প থেকে। সারাবছরে বিশ্বে এ ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা থাকে একশ’টি। ৭ কম্পাঙ্কের (১০ টু দ্যা পাওয়ার ২৫ আর্গস) ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি হয় বেশি। এ পরিমাপের ভূমিকম্প বিশ্বে বছরে ২৫ বার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। রিখটার স্কেলে ৮ এবং এর চেয়ে বেশি কম্পাঙ্কের ভূমিকম্প ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পের হিসেবে পড়ে। বছরে দুই একবার এই ধরনের ভূকম্পন হতে পারে।
রিখটার স্কেল বিশ্লেষণে বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীর কোন একটি ভূকম্পন এলাকায় ৬ মাত্রার ভূকম্পন হয় বছরে একবার। ৭ মাত্রার ভূমিকম্প পাঁচ বছরে একবার। ৮ বা ৮ এর অধিক মাত্রার ভূমিকম্প হয় পঁচিশ বছর পর পর। এটাই সাধারণ হিসাব। তবে এর ব্যত্যয়ও ঘটে। জাতিসংঘের ডিজাস্টার রিলিফ অর্গানাইজেশনের এক হিসাবে বলা হয়েছে পৃথিবীতে ভূমিকম্পে এ যাবত প্রায় ৯ কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
বিশ্বে যত ভূমিকম্প হয় তার প্রায় ১৫ শতাংশ ঘটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তবে ৮ এবং তার ওপর মাত্রার ভূমিকম্প বেশি হয় এশিয়া মহাদেশে। চীনে বেশ কয়েকবার ৮ এবং ৮ এর বেশি কম্পাঙ্কের ভূমিকম্প হয়েছে। সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প হয় ১৯৫০ সালে। যে মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৬। বিশ্বের কোথাও ভূকম্পন হলে তা নানা স্থানে ছড়িয়ে থাকা ভূকম্পন কেন্দ্রে সূক্ষ্ম সংবেদী যন্ত্রে ধরা পড়ে। মাটির নিচে পোঁতা থাকে সংবেদী হেলিকর্ডারের একটি প্রান্ত। এ থেকে ভূস্তরের সূক্ষ্মতম কম্পন গ্রাফের আকারে বের হয় তাপ সংবেদী বিশেষ ধরনের কাগজে। বিজ্ঞানের ভাষায় সিসমোগ্রাফ। এ গ্রাফের বিশ্লেষণ হয় রিখটার স্কেলে। এরপর গাণিতিক পদ্ধতিতে নির্ণয় করা হয় কম্পনের কেন্দ্রবিন্দু বা এপিসেটার। বাংলাদেশে যত ভূকম্পন অনুভূত হয় সবই টেকটোনিক বা ভূগর্ভে শিলাস্তর ও খনিজ পদার্থের পরিবর্তনে।
সৌজন্যে: জনকণ্ঠ