‘মনে হচ্ছিল মৃত্যু হলে দেশের মাটিতেই হোক’
জীবন-মৃত্যুর কঠিন হিসাব বুঝার বয়স হয়নি। কিন্তু বাস্তবতা অত্যন্ত নির্মম। বিরাট এক অর্জনের দ্বারপ্রান্তে থেকে উপভোগের প্রস্তুতি চলছিল তখন। এর পরের ঘটনা কতটা ভয়াবহ তার কিছুটা আঁচ করা গেছে বাংলাদেশ থেকেই।
বলা হচ্ছে বাংলাদেশের কিশোরী ফুটবলারদের কথা। যারা এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ গার্লস রিজিওনাল চ্যাম্পিয়নশিপ ফুটবল খেলতে নেপাল গিয়েছিল গত ১৯ এপ্রিল। গ্রুপ ও সেমিফাইনাল পেরিয়ে অপেক্ষা ছিল ফাইনাল খেলার। সেই দিনটি ছিল ২৫ এপ্রিল, শুক্রবার। সেদিন বিকা্লে নেপালের দশরথ স্টেডিযামে ফাইনালে মু্খোমুখি হওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশ ও স্বাগতিক নেপালের। কিন্তু তা আর হয়নি। প্রলয়ঙ্কারী ভুমিকম্পে তছনছ হয়ে গেছে নেপাল। ভুমিকম্পের তীব্রতায় হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে লাখ লাখ মানুষ।
ঢাকায়ই যখন হুড়োহুড়ি করে নিচে নামার তৎপরতা তখন নেপালে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ ছিল চিন্তা করলে হয়তো পুরোপুরি উপলব্ধি করা যাবে না। রিখটার স্কেলে ৭.৮ মাত্রার ভুমিকম্পের উৎপত্তিস্থল সেখানেই। একবার নয়, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ক্ষণে ক্ষণেই কেঁপে ওঠেছে সবকিছু।
এ অবস্থায় ফাইনাল খেলার ভাবনা নিশ্চয়ই মনে ছিল না মেয়ে ফুটবলারদের। প্রথমত জীবন যেন বাঁচে সেই প্রার্থনা বেরিয়ে এসেছে আপনা থেকেই। কিন্তু যখন সামনেই ভবন ধ্বসে মানব মৃত্যুর মিছিল তৈরি হচ্ছে, তখন বোধ হয় জীবনের মায়াও কিছুটা কমে এসেছিল।
শুধু একটাই প্রার্থনা ছিল; ‘মারা গেলে যেন দেশে গিয়েই মারা যাই। কারণ, নেপালের মাটিতে মারা গেলে দেশে লাশ নেওয়াও হয়তো সম্ভবপর হবে না। মৃতদেহটা পরিবারের দেখার সুযোগও হবে না।’- বলছিলেন বাংলাদেশ দলের সদস্য সানজিদা।
এই ছোট্ট ছোট্ট মনে যে ভীতি কাজ করেছে তা হয়তো কোনো দিনই মন থেকে মুছে যাবে না। তবে বড় একটা অভিজ্ঞতাও হয়েছে। ধ্বংসযজ্ঞের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েও কিভাবে বাঁচার জন্য সংগ্রাম করা যায়, সেই মানসিক দৃঢ়তা তারা অর্জন করেছে।
ভীতিকর সেই পরিবেশের বর্ণনা দিতে গিয়ে দলের আরেক সদস্য মার্জিয়া বলেছেন, ‘কি যে ভয় পেয়েছিলাম তা বর্ণনা করার মতো না। প্রথম ধাপে আমরা বুঝতে পারিনি। দ্বিতীয়বারের ঝাঁকুনিতে যখন বুঝলাম তখন হুড়োহুড়ি করে সবাই নেমে নিচে খোলা জায়গায় গিয়ে অবস্থান নিয়েছি। স্থানীয় এবং বিদেশী অনেকে সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কেউ কেউ তাবু খাটিয়ে সারারাত অবস্থান করেছেন।’
সেই উৎকণ্ঠার অবসানের পর দেশে ফেরার পর যেন নতুন জীবন পেয়েছে মেয়েরা। এক সপ্তাহের বেশি সময় পরিবারের সঙ্গে কথা করতে পারেনি। কোনো যোগাযোগ হয়নি। আর ভুমিকম্পের পর কথা বলা সম্ভবপর হচ্ছিল না। সেই বিষয়টি মানসিকভাবে পীড়া দিচ্ছিল কিশোরী ফুটবলারদের। দেশে ফিরে বাবা-মার সঙ্গে ফোনে কথা বলার পর যেন নতুন করে জীবন ফিরে পেয়েছে তারা।
সেই অনুভুতির কথা বর্ণনা করতে গিয়ে অধিনায়ক কৃষ্ণা রানী সরকার বলেছেন, ‘নেপালে যাওয়ার পর থেকে আমরা পরিবারের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। ফোনে কথা বলার সুযোগ ছিল না। আমরা যখন খেলায় ভাল করছিলাম, তখন বৃহত্তর স্বার্থে সেই দুঃখ ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু ভুমিকম্পের পর মন যেন আর মানছিল না। কখন যোগাযোগ হবে পরিবারের সঙ্গে। কিন্তু নেপালে থাকা অবস্থায় সেই যোগাযোগ আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। দেশে এসে বিমান থেকে নেমে ফোনে পরিবারে সবার সঙ্গে কথা হয়েছে। এরপর যেন মনে হয়েছে নতুন করে জীবন ফিরে পেলাম।’
২৫ সদস্যের খেলোয়াড় কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা আহসান আহমেদ অমিত। ছোট ছোট সেই বালিকাদের নিয়ে কিভাবে সময় পার করেছেন এর বর্ণনা দিয়েছেন দেশে ফিরে।
সেই দুর্যোগকালীন সময়ের পর দেশে ফেরার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আহসান আহমেদ অমিত বলেছেন, ‘বাংলাদেশ এয়ার লাইনসের বিমানে আসার কথা ছিল আমাদের। কিন্তু সেই বিমান অবতরণ করতে পারেনি। এতে আমরা কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ি। পরে বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ বিমান ২ দফা বিলম্বের পর ৫টার দিকে কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে অবতরণ করেছে। সেই বিমানে করেই সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় আমরা রওনা হই। রাত সাড়ে ৮টার কিছু পর ঢাকায় অবতরণ করেছি।’