ঢাকায় ৬৫ ভাগ এলাকা বহুতল ভবনের উপযুক্ত নয়
রাজধানীর ৬৫ শতাংশ এলাকার মাটির গুণগত মান বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য উপযুক্ত নয়। এসব এলাকার মাটির মান এতই নিম্নমানের যে, বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে যেকোনো সময় ওইসব এলাকার ভবন ভেঙ্গে পড়তে পারে। এমনকি নিচেও দেবে যেতে পারে। বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরের গবেষণায় এমন চিত্র উঠে এসেছে। তারপরও ওইসব এলাকায় একের পর এক বহুতল ভবন গড়ে উঠছে। মাটির গুণাগুণ পরীক্ষার রিপোর্ট ফাঁকি দিয়েই এসব এলাকায় ভবন নির্মাণ হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে গতকাল আবারও দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এবার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে। রিখটার স্কেলে ৫.৩ মাত্রার এই ভূমিকম্পের উত্পত্তিস্থল ছিল বাংলাদেশের পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া সীমান্তের নিকটবর্তী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার মিরিকের ভূপৃষ্ঠের প্রায় ৬৭ দশমিক ১ কিলোমিটার গভীরে। শিলিগুঁড়ি থেকে স্থানটির দূরত্ব মাত্র ৪৭ কিলোমিটার। মার্কিন জিওলজিক্যাল সার্ভের তথ্যমতে, সন্ধ্যা স্থানীয় সময় ৬টা ৩৫ মিনিটে সংঘটিত এই ভূমিকম্পের প্রভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার কম্পন অনুভূত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ঝাঁকুনি অনুভূত হয়েছে পঞ্চগড়সহ দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে। তবে কোন ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।
রাজউকের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ও নগর পরিকল্পনাবিদ এমদাদুল ইসলাম বলেছেন, মাটির মান খারাপ হলেও বহুতল ভবন নির্মাণ করা যায়। সে ক্ষেত্রে পাইলিংয়ের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে হবে। যেখানে ২০০ ফুট পাইলিং করা প্রয়োজন, সেখানে ৪০ ফুট পাইলিং করে ভবন তোলা হচ্ছে। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিএনবিসি (বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড) অনুসরণ করা হচ্ছে না।
ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, তারা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার অনেক নিচের মাটি সংগ্রহ করে গুণগত মান পরীক্ষা করেন। এতে প্রতিটি স্তরের মাটির ভূতাত্ত্বিক অবস্থা, ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, গঠন প্রকৃতি পর্যালোচনা করা হয়। মাটির মানকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়। এতে দেখা যায়, ৩৫ শতাংশ এলাকা ছাড়া বাকি এলাকার মাটিই নিম্নমানের। সর্বোচ্চ মানসম্পন্ন মাটি রয়েছে কোতয়ালী, মতিঝিল, সায়েদাবাদ, কমলাপুর, সেগুনবাগিচা, কাকরাইল, ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, উত্তরখান, উত্তরার অংশবিশেষ, মিরপুর ১, মিরপুর ২, মিরপুর ৩, মিরপুর ৬ ও মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায়।
অন্যদিকে খুবই নিম্নমানের মাটি রয়েছে মেরাদিয়া, সাতারকুল, বাড্ডার অংশবিশেষ, ভাটারা, মিরপুরের ১৪ নম্বর এলাকা, বোটানিক্যাল গার্ডেনের আশপাশের নিম্নাঞ্চল, কল্যাণপুর ও মোহাম্মদপুরের অংশবিশেষ, পল্লবীর নিম্নাঞ্চল, কালাপানি এলাকাসহ আরো কিছু এলাকায়। এসব এলাকায় ভবন নির্মাণ করা উচিত নয়। খুব প্রয়োজনে ডুপ্লেক্স বা কাঠের বাড়ি নির্মাণ করা যেতে পারে।
ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফর সূত্র জানায়, রাজধানীর অনেক জলাশয়, ডোবা ও নিচু এলাকা ভরাট করা হয়েছে। ওইসব এলাকায় মাটির নিচে পিট জমে আছে। ওই পিট শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে যায়। বর্ষা মৌসুমে পানি পেয়ে ফুলে ওঠে। এ ধরনের মাটির ওপর বহুতল ভবন তৈরি করা যাবে না, এমন নয়। দেখতে হবে ওই পিটের নিচের মাটির গুণগত মান কেমন। বিশেষ করে মধুপুর ক্লে (লালমাটি) পাওয়া গেলে বহুতল ভবন তৈরি করা যেতে পারে। রাজধানীতে এ ধরনের নিরেট লালমাটির এলাকা ৩৫ ভাগের বেশি হবে না। এসব এলাকায় একশতলা ভবন নির্মিত হলেও কোনো সমস্যা নেই। তবে নির্মাণকাজ হতে হবে মানসম্পন্ন। এছাড়া কিছু এলাকায় সামান্য লালমাটির স্তর আছে। এসব এলাকায় প্রয়োজনীয় পাইলিং করে ভবন নির্মিত হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ববিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আক্তার হুমায়ুন বলেন, আমাদের কাছেও ঢাকা শহরের মাটির মানের তথ্য রয়েছে। অনেক এলাকায় লালমাটির অস্তিত্ব চোখেই পড়ে না। ওইসব এলাকার মাটির পুরুত্ব খুবই কম। এ ধরনের মাটিতে বহুতল ভবন নির্মাণ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি জানান, মাটির পরীক্ষা রিপোর্টে ভবন মালিকরা অসাধুতার আশ্রয় নেন। ভালো এলাকার মাটির রিপোর্ট উপস্থাপন করে খারাপ এলাকায় বহুতল ভবনের নকশা পাস করিয়ে নেন। এ ধরনের ভবন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি বলেন, গত শনিবারের ভূমিকম্পের উত্পত্তিস্থল নেপাল না হয়ে ঢাকার আশপাশে হলে ঢাকার অধিকাংশ এলাকা ধ্বংস্তূপে পরিণত হতো।
রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ ও ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক মোঃ সিরাজুল ইসলাম বলেন, রাজধানীতে ভরাট হওয়া এলাকাগুলোও সঠিকভাবে ভরাট করা হয়নি। ওইসব এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণ করা ঝুঁকিপূর্ণ। সঠিকভাবে ভরাট না করায় মাটি ঢিলেঢালা রয়ে গেছে। যেমন কোন পুকুর যে ভরাট করা হয়েছে, সেটা কেউ ভবন বানানোর সময় আর মনে রাখেনি। ভবন বানানোর সময় এ বিষয়ে সচেতনতা থাকা প্রয়োজন।
প্রসঙ্গত, এরআগে শনিবার দুপুরে সারাদেশে দুই দফায় শক্তিশালী ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এ সময় আতঙ্কে মানুষ বাড়িঘর, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসেন। রিখটার স্কেলে ৭.৯ মাত্রার এ ভূমিকম্পের উত্পত্তিস্থল ছিল নেপালে। এরপরদিন রবিবার দুপুর ১টা ১১ মিনিটে ফের ভূকম্পন অনুভূত হয়। দু’দিনের ভূমিকম্পে বাংলাদেশে সাত জনের মুত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন বহু মানুষ।
সৌজন্যে: ইত্তেফাক