একতরফা নির্বাচনেও ফুরফুরে আওয়ামী লীগ

awamilig_1ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে বিএনপি সরে দাঁড়ানোর পরে একতরফা এ নির্বাচনেও অভিনব কায়দায় অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা এ সব অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত থাকেন নির্বাচন শেষ হওয়া পর্যন্ত। সবচেয়ে অনিয়মের ঘটনা পাওয়া গেছে পুলিশের ভূমিকায়। ভোট কেন্দ্রেগুলোতে দায়িত্বরত পুলিশ সাংবাদিক প্রবেশে বাধা দিয়েছে। যা নিকট অতীতে কখনো দেখা যায়নি। একসঙ্গে পাঁচ জনের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশে বাধা প্রদানের বিধি-নিষেধও আরোপ করে পুলিশ। ব্যালট পেপার কেড়ে নেওয়া, বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষের পোলিং এজেন্টকে বের করে দেওয়া, বিএনপি-জামায়াতের কর্মী-সমর্থকদের ভোট কেন্দ্রে আসতে বাধা প্রদান, প্রিসাইডিং অফিসারকে হুমকি-ধমকি দেওয়া- এ সব অনিয়ম তো ছিলই। এ ছাড়া জাল ভোটের মহোৎসব এবং এ সময়ে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে পুলিশি সহযোগিতার অভিযোগও পাওয়া গেছে। পুলিশ নিজেই ক্ষমতাসীনদের পক্ষে কেন্দ্র দখল করার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহী প্রার্থীদের সঙ্গে দল সমর্থিত প্রার্থীর সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে অনেক কেন্দ্রে। এত অনিয়মের পরেও নিজেদের প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করে ফুরফুরে ও স্বস্তিতে রয়েছে ক্ষমতাসীনরা। আর নিজেদের নির্বাচনী কৌশলে বিজয় নিশ্চিত হয়েছে বলে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা জানান। ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে বেশি ভোটার উপস্থিতি, বিএনপিকে নির্বাচনে সম্পৃক্ত করা ও তাদের সমর্থিত প্রার্থীদের নির্বাচন বর্জনের আগ পর্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি করতে পারাই তাদের স্বস্তির বড় কারণ। শাসক দলের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা এমনটিই জানান। কৌশলের কথা জানাতে গিয়ে নেতারা আরও জানান, তারা নির্বাচনে উৎসবের আমেজ আনতে সক্ষম হয়েছেন। এটাই তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল। এ প্রসঙ্গে দলের এক নেতার বক্তব্য এমন- ‘কোনো কেন্দ্র তো ফাঁকা ছিল না। ভোটার এসেছে। লোকজন নির্বাচনী আমেজে রাস্তায় ছিল। কোনো গণমাধ্যম তো ফাঁকা কেন্দ্র দেখাতে পারেনি।’ তবে অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে সংঘটিত ‘বিচ্ছিন্ন’ সহিংসতাকে দলের নেতারা কাউন্সিলর প্রার্থীদের স্থানীয় দ্বন্দ্ব বলছেন। এ সকল অনিয়মের চিত্র দেখা গেলেও আওয়ামী লীগ নেতারা এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবেই দেখছেন। তবে ভোট কেন্দ্রে অনিয়ম ও সংঘাত-সহিংসতার বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, কিছু কেন্দ্রে বিচ্ছিন্ন যেসব ঘটনা ঘটেছে তা স্থানীয় রাজনীতির কারণে। বিভিন্ন দল সমর্থিত এবং স্বতন্ত্র কাউন্সিলর প্রার্থীরা নিজেদের প্রভাব বজায় রাখতে এ সব ঘটনা ঘটিয়েছেন। নির্বাচন উৎসবমুখর পরিবেশে ও শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা পুরো নির্বাচনের চিত্র নয়। অনিয়মের ঘটনার কথাও অস্বীকার করেন তিনি। ভোট কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখা গেছে, ভোট শুরু হওয়ার আগ থেকেই ক্ষমতাসীনদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ও অন্যান্য সংগঠনের নেতাকর্মীরা ভোট কেন্দ্রের আশপাশে জড়ো হন। শাষক দলের জড়ো হওয়া নেতাকর্মীরা অপরিচিত কাউকে দেখলে বিএনপি জামায়াতের ভোটার মনে করে কেন্দ্রের আশপাশে দেখা মাত্রই চলে যাওয়ার হুমকি প্রদান করেন। এক পর্যায়ে সরকার দল সমর্থিত প্রার্থীদের প্রতীক ও ছবি সম্বলিত ব্যাচ পরে বিএনপির ভোটাররা কেন্দ্রে আসে এবং তাদের প্রার্থীকে ভোট প্রদান করেন। তবে সে চিত্রও বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। ভোটকেন্দ্রগুলোতে বিএনপি প্রার্থীদের পক্ষে পোলিং এজেন্ট না থাকায় ও ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন ও নির্বাচনী পরিবেশ অনুকূলে নাই এমন অভিযোগ তুলে ৩ সিটিতে একযোগে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেয় বিএনপি। আর কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কমতে শুরু করে। এর পর পরই চলে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর প্রতিযোগিতা। এ বিজয়কে আওয়ামী লীগ তাদের কৌশলের বিজয় বলে উল্লেখ করেন। পুলিশি মারধরেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কৌশলের কাছে মার খায় বিএনপি। বাড়ি বাড়ি পুলিশি হামলা, ধরপাকড়, বিএনপির নেতাকর্মীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন এ সব কৌশলে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনকে ঘিরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিত করতে যুদ্ধংদেহী মনোভাব গ্রহণ করে। আর সেই কৌশলের কাছে মূলত আত্মসমর্পণ করেছে বিএনপি। নির্বাচনে বিএনপির কর্মী-সমর্থক ও কেন্দ্রীয় নেতাদের মাঠে অনুপস্থিতিই এটা প্রমাণ করেছে। এ ছাড়া মঙ্গলবার দুপুরের মধ্যে তেমন কোনো বড় অঘটন ছাড়াই বিএনপির নির্বাচন থেকে সড়ে দাঁড়ানোর ঘোষণা তাদের আত্মসমর্পণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিএনপি প্রার্থীদের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে ক্ষমতাসীনরা যেমন মাঠে গত কয়েকদিন ধরে রয়েছেন, নির্বাচনের দিন সকাল থেকে সব রকমের প্রস্তুতি গ্রহণ করে কেন্দ্রে কেন্দ্রে সতর্ক পাহারায়ও ছিলেন। বিএনপির নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণার পর পরই ক্ষমতাসীনদের সকল রকম প্রস্তুতি ও সতর্ক পাহারায় থাকার মানসিকতায় ভাটা পড়ে। ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতিও কমতে শুরু করে। তবু আওয়ামী লীগকে ফুরফুরে করে তোলে বিএনপির নির্বাচন থেকে সরে আসার ঘোষণা। সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঢাকার কেন্দ্রগুলো ঘুরে ও চট্টগ্রামে প্রতিবেদকের সঙ্গে ভোটের পরিস্থিতির খবর নিয়ে এ চিত্র পাওয়া গেছে। জানা যায়, ঢাকা ও চট্টগ্রামের রাজনীতির মাঠে বিএনপির ভবিষ্যত আন্দোলন মোকাবেলায় সরকার অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে। তাই নির্বাচনে বিএনপিকে চাপে রাখার সিদ্ধান্ত ছিল সরকারের হাইকমান্ডের। এর মধ্যদিয়ে বিএনপিকে আবারও আন্দোলনে ঠেলে দিয়ে দলটিকে দুর্বল ও ভঙ্গুর করে তোলার কৌশলও সরকারের রয়েছে। আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার প্রচারণায় সরকার অনেকটা শঙ্কিত হয়ে পড়ে। খালেদা জিয়ার প্রচারণায় রাজনীতির মাঠ হারানোর ভয়ও ছিল শাসক দলে। তাই বিভিন্ন কৌশলে সরকার তার প্রচারণা থামায়। তার গাড়ি বহরে বিভিন্ন কারণে কয়েক দফা হামলা হয়। আর এ হামলার পরই থেমে যান খালেদা। ঢাকার নেতাকর্মীদের নব উদ্যমও স্তিমিত হয়ে যায়। তখনই সিটি নির্বাচনের মাঠ সরকারের অনুকূলে চলে আসে বলে আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করছেন। তবে নির্বাচনের প্রাক্কালে সরকার প্রশাসনকে কিছুটা ব্যবহার করলেও দুপুরে বিএনপির বর্জনের ঘোষণার পর উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। বিএনপির বর্জনের ঘোষণায় যেন ভোট কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি কমে না যায়, তাই দল সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের কোনো আনুকূল্য না দেখানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর ফলে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী ও স্বতন্ত্র কাউন্সিলর প্রার্থীরা তাদের নিজেদের ভোটার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। তবে শাসক দলের একাধিক নেতার ভিন্ন বক্তব্যও আছে। তারা বলেছেন, বিএনপি নিজেদের অন্তর্কোন্দলে পরাজয়ের শঙ্কায় বিএনপি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে অবরোধ-হরতাল দিয়ে বিএনপি আন্দোলনের নতুন কোনো ইস্যু পাচ্ছিল না। তাই তারা এ নির্বাচনে এসেছে দলের নেতাকর্মীদের ধরে রাখতে। আর নির্বাচন বর্জন করেছে নতুন ইস্যু সৃষ্টি করতে। বিএনপি নেতাদের এ সংক্রান্ত কথোপকথনও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে রয়েছে। আর শেষ বেলায় ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে সাবেক মেয়র ও ঢাকার জনপ্রিয় বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী সাঈদ খোকনকে সমর্থন দেয়। ঢাকা উত্তরের আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আনিসুল হকের জয় অনেকটা নিশ্চিত জেনে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত আগেই নিয়ে নেয় বিএনপি। তবে চট্টগ্রামে প্রার্থীর অনিচ্ছা ছিল নির্বাচন বয়কটের। এ কথা জেনে বিএনপির হাইকমান্ড নির্বাচনের দিন বিএনপির কোনো নেতা-কর্মীকে দল সমর্থিত প্রার্থী মনজুরের সমর্থনে নির্বাচনী মাঠে নামতে দেয়নি। যার ফলে অনেকটা ক্ষোভে মনজুর নির্বাচন বর্জন করেই ক্ষান্ত হননি; রাজনীতি থেকেও অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ ছাড়াই নিশ্চিত পরাজয় জেনে ভবিষ্যৎ আন্দোলনের ইস্যু তৈরি করতে বিএনপি ভোট বর্জন করেছে। ভোট শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠুভাবে হয়েছে। এটা তাদের পূর্ব পরিকল্পিত ছিল। হানিফ বলেন, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বর্জনের কারণ হিসেবে তারা যে অভিযোগ করেছে, এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। ভোট বর্জন ও কারচুপির অভিযোগ বিএনপির নতুন কিছু নয়। এটা পূর্বপরিকল্পিত। কারণ তারা জানত বিগত দিনে যেভাবে মানুষ হত্যা করেছে, তাতে জনগণের সমর্থন পাবে না।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend