পত্রিকা পড়ে আঁতকে উঠেছেন পাঠক
সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির নানা ধরনের খবর প্রধান শিরোনাম হয়েছে বুধবারের জাতীয় দৈনিকগুলোয়। প্রধান প্রধান শিরোনামে সরকারি দলের ভোট জালিয়াতি ও সহিংসতার একাধিক চিত্র উঠে এসেছে।
দৈনিক প্রথম আলো, যুগান্তর, সমকাল থেকে শুরু করে প্রথম সারির ইংরেজি দৈনিক দি ডেইলি স্টার ও নিউজ এজসহ দেশের অধিকাংশ পত্রিকায়ই উঠে এসেছে ২৮ এপ্রিলের সিটি নির্বাচনে জালিয়াতির অভিনব সব খবর।
প্রথম আলোর প্রধান শিরোনাম ছিল— ‘জিতল আ.লীগ, হারল গণতন্ত্র’।
যুগান্তরের শিরোনাম করা হয়— ‘ভোট জালিয়াতির মহোৎসব’।
দৈনিক সমকালের শিরোনাম— ‘প্রশ্নবিদ্ধ ভোট, বিএনপির বর্জন’।
দি ডেইলি স্টারের শিরোনাম ছিল— ‘পোলস বাবল বার্স্টস (ভোটের বেলুন ফাটল)’।
দৈনিক মানবকণ্ঠের শিরোনাম— ‘অনিয়ম দখল সিল আর বর্জনে শেষ হলো ভোট’।
দৈনিক দিনকালের শিরোনাম ছিল— ‘তিন সিটিতে নজিরবিহীন ভোট ডাকাতি’।
সাংবাদিকতায় রাজনৈতিক বিভাজন থাকলেও খবর প্রকাশে অধিকাংশ পত্রিকায় সত্যকে আড়াল করা হয়নি।
সাংবাদিকরা মনে করেন, সত্য প্রকাশ করলে কারও পক্ষে যাবে, কারও বিপক্ষে যাবে। তারপরও সত্য প্রকাশ করতে হবে। তাই মঙ্গলবারের নির্বাচনে ঘটে যাওয়া খবরগুলো প্রকাশে একটুও পিছপা হননি তারা। যদিও নির্বাচনের দিন সাংবাদিকদের ওপর নেমে এসেছিলো বর্ণনাতীত নিয়ন্ত্রণ।
যশোরের একজন পাঠক হাফিজ শরীফ এই প্রতিবেদককে বলেন, প্রথম আলো এসব কী লিখেছে?সত্যিই কী এসব ঘটেছে। কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার।
বরিশালের গৌরনদীর পাঠক আব্দুর রশীদ তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘পত্রিকা পড়ে আঁতকে উঠেছি! এরকম ভোট জালিয়াতি হয়েছে। অবিশ্বাস করারও সুযোগ নেই, কোনো কোনো পত্রিকায় তো ছবিসহ খবর প্রকাশিত হয়েছে।’
দৈনিক যুগান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, ‘বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের জন্য আমাদের কাজ করতে হবে। এখানে কিছু চাপ থাকবে। কারণ সত্য প্রকাশ করলে কারো পক্ষে যাবে, কারো বিপক্ষে যাবে। তারপরও সত্য প্রকাশ করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যারা এই পেশায় এসেছি তারা পেশীশক্তি, সন্ত্রাসীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কাজ করছি। চ্যালেঞ্জ নিয়েই কাজ করতে হবে, এটা জেনেই আসছি। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।’
সিটি নির্বাচনের সংবাদ পরিবেশন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করেছি সব সংবাদ তুলে ধরার জন্য। আমাদের ৩০ জন রিপোর্টার মাঠে কাজ করেছেন।’
প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান বলেন, ‘বিশ্বের যে কটা দেশে সাংবাদিকরা ঝুঁকির মধ্যে কাজ করেন সেই তালিকায় বাংলাদেশের নামটাও আছে। আমাদের ঝুঁকির মধ্যে থেকেই কাজ করতে হচ্ছে।’
সিটি নির্বাচনে পুলিশের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে আগের দিনই বলা হয়েছিল কেন্দ্রে ৫ জনের বেশি প্রবেশ করা যাবে না। নির্বাচন কমিশনের এ বিষয়ে প্রদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ ছিল। সাংবাদিকদের কাজে বাধা দেওয়া বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ।’
সময় শেষ হয়ে যায়নি, নির্বাচন কমিশন এখনও ব্যবস্থা নিতে পারেন বলেও মন্তব্য করেন মিজানুর রহমান খান।
দৈনিক সমকালের নির্বাহী সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি বলেন, ‘সিটি নির্বাচনের সংবাদ পরিবেশনে নৈর্ব্যক্তিক জায়গা থেকে দেখার চেষ্টা করেছি। কারও পক্ষ নিয়ে নয়, সত্য ঘটনা-তথ্যচিত্র পাঠকের জন্য নিরপেক্ষ জায়গা তুলে ধরতেই আমাদের হেড লাইনটি দেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ভোট গ্রহণের প্রথম তিন ঘণ্টার মধ্যেই নির্বাচনের যে চিত্র পাওয়া গেছে, সেটা যেমন ঠিক হয়নি, বিএনপির ভোট বর্জন করাও ঠিক হয়নি। তাদের শেষ পর্যন্ত দেখার দরকার ছিল। এটা বলছি না ভোট জালিয়াতি হয়নি।’
গণমাধ্যমকর্মীদের উপর হামলা ও তাদের কাজে বাধাদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘গতকাল সাংবাদিকরা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন। এর জন্য নিন্দা জানাই। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে। আসলে এ ধরনের ঘটনা বার বার ঘটছে সাংবাদিকদের মধ্যে বিভক্তির কারণে। ’
তিনি বলেন, ‘এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সরকারদলীয় লোকজন। যখনই যারা সরকারে থাকে তারাই সাংবাদিকদের কাজে বাধা দেয়। তারপরও আমাদের পেশাদারিত্ব নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।’
সিটি নির্বাচনে পুলিশের ভূমিকা সম্পর্কে তিনি বলেন, “সাংবাদিকদের কাজে বাধা দেওয়ার বিষয়ে যতটুকু জানতে পেরেছি পুলিশ সরকারের নির্দেশে কাজটি করেছে। তারা বলেছে— ‘উপরের নির্দেশ আছে’।”
তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্রের স্বার্থে সাংবাদিকদের উপর নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। অবাধ, মুক্ত ও স্বাধীন গণমাধ্যম গণতন্ত্রের জন্য খুবই জরুরি।’
দৈনিক ইত্তেফাকের প্রধান শিরোনাম ছিল— ‘আনিসুল খোকন নাসির বিজয়ী’।
অপর একটি শিরোনাম করা হয়— ‘কেন্দ্র ২৭০০, হাঙ্গামা ৫৫টিতে’।
দৈনিকটির প্রধান প্রতিবেদক নাজমুল হাসান বলেন, ‘গণতান্ত্রিক চর্চা যতদিন থাকবে ততদিন সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন। মূল কথা হচ্ছে দেশের প্রধান বড় দুটি দল সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চা করে না।’
তিনি বলেন, ‘যত দিন না সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চা করা হবে ততদিন আমাদের কাজ করার ক্ষেত্রে আশঙ্কা থাকবে।’
‘সিটি নির্বাচনের সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে কোন বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছেন?’— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ নির্বাচনের ঘটনা প্রকাশে আমাদের কোনো বাধা ছিল না।’
মানবকণ্ঠের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আবু বকর চৌধুরী বলেন, ‘আগেও সাংবাদিকদের কাজে বাধা দেওয়া হয়েছে। তবে এটা যারাই করে থাকুক না কেন, উচিৎ নয়। এ ধরনের ঘটনা অনভিপ্রেত, এতে পুলিশের ভূমিকা অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।’ তবে সংবাদ প্রকাশে কোনো ধরনের চাপ ছিল না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
দৈনিক দিনকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী বলেন, ‘আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি সিটি নির্বাচনের সকল সংবাদ কাভারেজ দিতে। কিন্তু লোকবল সঙ্কটের কারণে সব তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। তবে সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে চাপ ছিল না। সব গণমাধ্যম স্বাধীনভাবেই সংবাদ প্রকাশ করেছে।’
তিনি বলেন, ‘সংবাদ সংগ্রহের কাজে গণমাধ্যমকর্মীদের যেভাবে বাধা দেওয়া হয়েছে সেটা অগণতান্ত্রিক। সরকারের স্বৈরাচারী ও অস্বাভাবিক আচরণ। র্যাব, পুলিশ সরকারের ক্যাডার বাহিনী দিয়ে যেভাবে একটি নির্বাচন করিয়ে নেওয়া হলো এটা ফ্যাসিবাদী আচরণ।
প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার তিন সিটিতে ভোটগ্রহণের সংবাদ সংগ্রহে গণমাধ্যমকর্মীরা পুলিশের নানামুখী বাধা ও নির্যাতনের শিকার হন। কেউ কেউ হামলারও শিকার হয়েছেন। শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন কয়েকজন। গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর হামলা, ক্যামেরা ভাঙচুর ও ভয়ভীতি দেখিয়ে কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।
সাংবাদিকদের বাধা দেওয়ার দু’একটি ঘটনা
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মোহাম্মদপুরের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে গণমাধ্যমকর্মীরা ভেতর থেকে আটকানো গেট খোলার অনুরোধ জানালে ভেতরে থাকা পুলিশ সদস্যরা অকথ্য ভাষা প্রয়োগ করে।
রাজধানীর মিরপুরের শাহ আলী মহিলা কলেজ কেন্দ্রে সমকাল পত্রিকার দুই প্রতিবেদক শরিফুল ইসলাম ও যিলফুল মুরাদ এবং প্রথম আলোর প্রতিবেদক সামছুর রহমানকে চলে যেতে হুমকি দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রথম আলোর প্রতিবেদক মাসুম আলী, আলোকচিত্রী পাপ্পু ভট্টাচার্য এবং মানবকণ্ঠ পত্রিকার প্রতিবেদক এম মামুন হোসেন বাধার শিকার হন। সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সুজয় মহাজনও হামলার শিকার হয়েছেন।
এদিকে ঢাকা দক্ষিণের সবুজবাগে বাসাবো বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে সংঘর্ষের সময় রাইজিং বিডির নিজস্ব প্রতিবেদক ইয়াসিন রাব্বী গুলিবিদ্ধ হন। এ ছাড়া দৈনিক যুগান্তরের একজন প্রতিবেদককে কমলাপুরে মারধর করেছেন ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা। এ ছাড়া যুগান্তরের সাংবাদিক ওবায়েদ অংশুমানকে আহত করে তার ভিডিও ক্যামেরা ও মোবাইল ছিনিয়ে নেয় হামলাকারীরা।