জবর-দখল অশনিসংকেত, চরমপন্থা বাড়বে
জবর-দখল আর ভোটারবিহীন নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। গণতন্ত্রের হৃৎপিণ্ড নির্বাচনে জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পারলে রাজনীতিতে বিদেশী হস্তক্ষেপ, চরমপন্থা ও সহিংসতা বাড়বে বলে মনে করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষকদের মতে, সাংগঠনিক দুর্বলতা আর মামলা-প্রতিবন্ধকতার কারণে বিএনপি জোট সরকারের বিরুদ্ধে সহসাই তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলেও জনমনে ক্ষোভ বাড়বে। সেখান থেকে চরমপন্থা ও সহিংস রাজনীতির উদ্ভব হতে পারে। যেমনটা লিবিয়া, সিরিয়া ও তিউনিসিয়াতে হয়েছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রশাসনের সাহায্যে ও দলীয় কর্মীদের দিয়ে একতরফা নির্বাচন ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনও করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেখানেও সহিংস রাজনীতির সৃষ্টি হয়েছে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধেও চলছে সহিংস বিদ্রোহ। গণতন্ত্রহীন ও জবর-দখলের নির্বাচন কখনই গণতন্ত্রের জন্য সুখকর নয়। সিটি নির্বাচন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকলো। যার কারণে, সময়ের ব্যবধানে এদেশেও সহিংস রাজনীতির প্রেক্ষাপট তৈরির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটাররা তাদের ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়ে থাকে। কিন্তু মঙ্গলবারের নির্বাচনে ভোটাররা ভোটই দিতে পারলেন না। ভোটাররা নির্বাচনে ভোট দিতে না পারলে তাদের ক্ষোভ আরও বাড়ে। এতে করে চরমপন্থা, সহিংসতা ও অনিশ্চয়তার রাজনীতির আশঙ্কা বাড়লো’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা অতি দ্রুত একটি সমাধানে পৌঁছবে। কেননা, আমরা আমাদের সম্ভাবনার বাংলাদেশকে ধ্বংস হতে দেখতে চাই না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. নুরুল আমিন বেপারি বলেন, ‘৫ জানুয়ারি নির্বাচন ছিল ভোটারবিহীন নির্বাচন। আর সিটি নির্বাচন ছিল একতরফা ও গায়ের জোরের নির্বাচন। এই নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার শেষ সম্ভাবনাটুকুকেও কবর দেওয়া হল।’
ড. আমিন আরও বলেন, ‘পৃথিবীর যেকোনো দেশের যেখানেই গণতন্ত্রের নামে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানেই চরমপন্থা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এখন বাংলাদেশ সেই ঝুঁকির মধ্যে পড়লো। সরকারের উচিৎ দেশের স্বার্থে গণতন্ত্রের পথ সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া।’
তবে এ বিষয়ে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে নারাজ আরেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. শান্তনু মজুমদার।
ড. মজুমদার বলেন, ‘এবারের নির্বাচনে সন্ত্রাস, কারচুপি ও বিরোধী দলের প্রত্যাখ্যান সবই হতাশাজনক। শেষ কথা হলো, এর মাধ্যমে গণতন্ত্র পঙ্গুত্ব বরণ করলো।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন নানা ধরনের থেরাপি না দিয়ে, এখনকার কাজ হচ্ছে রাজনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে সর্বোচ্চ জোর দেওয়া। এ ক্ষেত্রে বৈশ্বিক অভিজ্ঞতাকে আমলে নিতে হবে।’
ড. শান্তনু মজুমদার সংসদ, নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করার উপর গুরুত্বারোপ করেন।
এদিকে, টানা তিন মাসের আন্দোলনে বিরতি দিয়ে বিভক্ত ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল বিএনপি। দলটি আশা করেছিল, স্থানীয় সরকার বিভাগের সবচেয়ে সম্মানজনক এ নির্বাচনে নিজেদের সমর্থিত প্রার্থীর বিজয়ের মধ্য দিয়ে দেশে গণতন্ত্র উদ্ধারের আন্দোলন আরও জোরদার হবে। কিন্তু সরকারদলীয় প্রার্থীদের পক্ষে নির্বাচন কমিশন, সরকারের প্রশাসন, পুলিশ বাহিনী ও ক্যাডারদের হস্তক্ষেপে ভোট জালিয়াতির কারণে কোনো সিটিতেই বিএনপি সমর্থিতরা জয়লাভ করতে পারেনি। মঙ্গলবার ভোট গ্রহণের চিত্র দেখে দুপুরের আগেই বিএনপি আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নির্বাচন থেকে নিজ প্রার্থীদের প্রত্যাহার করে নেয়। একই সঙ্গে ভোট বর্জনেরও ঘোষণা করে দলটি।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সিনিয়র সাংবাদিক শওকত মাহমুদ বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে বিশেষ করে ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের পর থেকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্বন্দ্ব সংঘাত-সহিংসতা, বিভেদ ও হানাহানিতে অস্থির, অসহিষ্ণু ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠেছে। আইনের শাসন হয়েছে মারাত্মকভাবে উপেক্ষিত। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল্যবোধও নিদারুণভাবে নিপীড়িত হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এ অবস্থা থেকে রাজনীতিকে বের করে আবার গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে বিএনপি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু সরকার, ইসি ও পুলিশ এবং দলীয় ক্যাডাররা নির্বাচনের নামে যা করেছে, তাকে নির্বাচন না বলে নির্লজ্জ প্রহসন বলাই শ্রেয়। এই নির্বাচন ছিল জাতির ইতিহাসে কলংক ও তামাশা। এ নির্বাচন জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে।’
শওকত মাহমুদ বলেন, ‘দেশের রাজনীতির পরবর্তী পরিস্থিতি নির্ভর করছে সম্পূর্ণভাবে সরকারের আচরণের উপর। সরকারের আচরণ দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত আসবে।’
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে এই নির্বাচনকে শতভাগ সুষ্ঠু ও অবাধ বলে দাবি করেছে। দলটি এই নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানে সহায়তা করার জন্য নির্বাচন কমিশন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ধন্যবাদ জানিয়েছে।
আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘নির্বাচন শতভাগ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। প্রায় ৫০ ভাগ ভোট কাস্ট হয়েছে। অনেক উন্নত দেশেও এতো ভোট পড়ে না। বিএনপির অভিযোগ ভোটে না কি কারচুপি হয়েছে। তারা দেখাক কোথায় হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রত্যেকটি নির্বাচনে স্থানীয়ভাবে দু-একটি কেন্দ্রে সমস্যা হয়। এটা তো স্বাভাবিক। এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। সামগ্রিকভাবে এগুলো খুবই কম। বিএনপি পরাজয় বুঝতে পেরেই নির্বাচন থেকে সেরে গেছে।’
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘সিটি নির্বাচন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে। জনগণ ভোটের মাধ্যমে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে তাদের রায় দিয়েছেন। এদেশে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসী ও নাশকতাকারীদের আর জনগণ ক্ষমতায় আনবে না।’
এদিকে সাধারণত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অতীতে বিদেশী কূটনীতিকরা এতটা সক্রিয় ছিলেন না, যেমনটা সক্রিয় ছিলেন মঙ্গলবারের সিটি নির্বাচনে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার সরাসরি নির্বাচন কেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে তাদের অসন্তোষের কথা জানিয়েছেন।
এমনকি জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনও এক বিবৃতিতে নির্বাচন কারচুপির অভিযোগ তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন।
এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিতে আরও বিদেশী হস্তক্ষেপ বাড়ার আশঙ্কা করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, ‘এভাবেই রাজনীতিতে বিদেশী হস্তক্ষেপ বাড়ে এবং তারাই গণতন্ত্র উদ্ধারের নামে চরমপন্থাকে গোপনে সমর্থন দিয়ে থাকে।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বিদেশীরাসহ সবাই হতাশ। এখন তো তারা নতুন নির্বাচনের কথা বলবেই। তাই রাজনীতিবিদদের এখনই সতর্ক হওয়া উচিত।’