তামিম-ইমরুলে খুলনায় উৎসবের রঙ

Khulna-test,-4-day-1-(Home) (1)বড্ড বিচিত্র ক্রিকেট। এই হাসায়; এই কাঁদায়। টানা ৩ দিন খুলনার আকাশ ছিল মেঘাচ্ছ্বন্ন-গম্ভীর। ক্রিকেট ব্যাকরণের পরিভাষায়- এক দুই তিন করে সবখানেই ছিল পাকিস্তানের এগিয়ে থাকায় চিত্রনাট্য। মাঠ থেকে শহর; শহর থেকে সারা দেশে উঠছিল হাপিত্যেশ। নিভৃতে-নীরবে মুশড়ে পড়েছিল দর্শকদের প্রাণের জোয়ার। সেই হতাশার আঙিনায় চতুর্থদিনে অনাবিল উৎসব উপভোগের আবাহন। কারণ, মাত্র ৬১ ওভারের খেলা শেষেই দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশের ২৭৩ রান; তাও কোনো উইকেট না হারিয়ে। যেখানে তামিম-ইমরুলে ধ্রুপদী ঘরানার মহাকাব্য রচনা হয়ে গেছে। আর এই টেস্টে ড্র করেই জয়ের সৌরভে মিল রাখার প্রেক্ষাপট তৈরী হয়ে গেছে; তাতে বর্ণিল উৎসবের রঙ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়বে সারাদেশে।
পাকিস্তানকে ইনিংস ঘোষণার সুযোগ দেননি বাংলাদেশের বোলাররা। এক তাইজুল (৬/১৬৩০ ঘুর্ণিতে, পাকিস্তানের প্রথম ইনিংসের বেপরোয়া খোলামুখ বন্ধ হয়েছে ৬২৮ রানে। তারপর; খুলনায় যা যা হয়; হতে পারে-বাংলাদেশের শুভ কামনায় হয়েছে তাই। না; এবারও মুখ ফিরিয়ে নেয়নি শিল্পনগরী খুলনা। দিয়েছে অবারিত হৃদয়ে। প্রত্যাশাকেও যা ছাপিয়ে যেতে পারে। চতুর্থ দিন শেষে যোগ-বিয়োগের সমীকরণ টেনে পাকিস্তান শুধু সুখসুখ অনুভব করতে পারে ২৩ রানের লিড থাকায়।Khulna-test,-4-day-1-3
আবু নাসের স্টেডিয়ামের লাঞ্চ বিরতির ঠিক আগ মুহূর্তে পাকিস্তানকে গুটিয়ে দিয়ে ব্যাটিংয়ে নেমেছিল বাংলাদেশ। ব্যাটারদের দায়িত্ব নিয়ে ম্যাচ বাঁচাতে হবে এই মন্ত্রে দীক্ষিত ছিল বাংলাদেশ। শেষ পর্যন্ত হয়েছেও তাই। ওয়ানডে সিরিজ-টোয়েন্টি২০ ম্যাচের জয়ের অনুপ্রেরণায় শতভাগ ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ।
শুরু থেকে ক্রমেই দর্শকদের ভিড় বাড়ছিল গ্যালারিতে। সমীকরণ মিলিয়েই এসেছিলেন তারা; বাংলাদেশের উদ্দীপক-প্রাণোজ্বল ব্যাটিং দেখতে। মিলে গেছে খাপে-খাপ। ফলে রোদ-গরমে গা পুড়ে যাচ্ছে যাক; সেই দিকে কোনো খেয়াল করার সময় ছিল না তাদের। বরং রোদের উত্তাপের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লাগামহীন ঘোড়ায় চড়ে রানের পেছনে ছুটছিলেন তামিম-ইমরুল; তা সুদ-আসলে উপভোগ করেছেন দর্শকরা। শুক্রবার চতুর্থ দিন শেষে শুধু উদ্বোধনী যুগলেই নয়; যে কোনো উইকেটে জুটিবদ্ধ রানে গৌরবময় রেকর্ড গড়েছেন তামিম-ইমরুল। আগের রেকর্ডে নাম ছিল আশরাফুল-মুশফিকের; তারা পঞ্চম উইকেটে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২৬৭ রান তুলেছিলেন গলে ২০১৩ সালে। আর উদ্বোধনী জুটিতে তামিম-ইমরুলের ব্যাটে ছিল সর্বোচ্চ ২২৪ রানের রেকর্ড। ওই যুগলের দেখা হয়েছিল চট্টগ্রামে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২০১৪ সালে। এই দুইয়ের ধৈর্য্য এবং দায়িত্বশীল ব্যাটিংশৈলীতে নতুন বাতিঘর খুঁজে পেয়েছে বাংলাদেশ। খুলনার উইকেটে আসন পেতে বসেছেন তামিম-ইমরুল অবিচ্ছিন্ন ২৭৩ রানের পার্টনারিশিপ নিয়ে। পাক্কা ৪ ঘণ্টা ৪০ মিনিট নিরেট-প্রাণবন্ত ব্যাটিং উপহার দিয়েছেন তারা। দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশের ওভারপ্রতি ৪.৪৭ রানের গতি বিস্মিত করেছে সবাইকে।Khulna-test,-4-day-12)_t
শুরুর দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে ধীরে ধীরে জেগে উঠা তামিম-ইমরুল দিনের ২ সেশনের বেশি সময় কাটিয়েছেন নির্বিঘ্নে। তাতেই পরিস্থিতি পাল্টেছে। চতুর্থ দিনে তাই শেষ হাসিটা কিন্তু ফুটেছে বাংলাদেশের মুখেই। অথচ পাকিস্তান বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস ছাড়িয়ে এই মাঠের রেকর্ড রান তুলে নিয়েছিল। লিড নিয়েছিল ২৯৬ রানের। এখনো ২৩ রানে এগিয়ে। অথচ হতাশা পাকিস্তান শিবিরে। পাহাড়প্রমাণ রান তোলার পরও স্বস্ত্বিতে নেই সফরকারীরা।
পাকিস্তানের পেস-স্পিনে প্রাণপণে চাপে রাখার চেষ্টা তামিম-ইমরুলের ব্যাটে ‘নস্যি’ প্রমাণিত হয়েছে। তামিম ব্যাটে রানের পথ দেখিয়েছেন; ইমরুল সেই পথে হেঁটেছেন। এভাবে দুরন্ত ব্যাটে ছুটে তামিম আগে ভাগেই হাফ সেঞ্চুরির গণ্ডি পেরিয়েছেন; তারপর দেখেশুনে ইমরুল। তাঁদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখার চেষ্টায় মরিয়া পাকিস্তান অধিনায়ক শুধু খাবি খেয়েছেন। কত ছক-কত সমীকরণ; সবটাই বিফলে গেছে। পাকিস্তান পেসের সঙ্গে মাঝে মাঝে ঘুর্ণি ছোবলে ব্যাটসম্যানদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু হয়েছে তার উল্টো। ধারে-ভারে, কথায়-কাগজে বোলিংয়ে এগিয়ে থাকা পাকিস্তান দেখেছে তামিম-ইমরুলের জাদুময়ী ব্যাটিং শো।
তামিম ইকবাল ব্যাক টু ‘থার্ড’ সেঞ্চুরি ছুঁয়ে ফেলেছেন খুলনায়। এর আগে ২ দুই টেস্ট সেঞ্চুরি পাওয়া তামিম নেমেছিলেন ৩৮তম ম্যাচে। প্রথম ইনিংসে ২৫ রান করার দুঃখ ঘোঁচাতে এই মেজাজী ক্রিকেটারকে দ্বিতীয় ইনিংসে খুঁজে পেয়েছেন ক্রিকেটভক্তারা। তার ঢংয়ের ব্যাটিংয়ে হয়েছেন মুগ্ধ। আহ; সে কী শট! ২০১৪ সালের নভেম্বরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে খুলনা এবং চট্টগ্রামে টানা দুই সেঞ্চুরি করেছিলেন। হিসেবটা এখন টানা ৩ সেঞ্চুরির। সঙ্গে নিজ ক্যারিয়ারকে সমৃদ্ধ করতে মোহম্মদ আশরাফুলের করা ৬ টেস্ট সেঞ্চুরির রেকর্ডও টপকে গেছেন তামিম। এটা তার ক্যারিয়ারের ৭ম সেঞ্চুরি।Record-1st-Wiciket-3
নতুন দিনে নতুন মাত্রায় ব্যাটিং করে ১ঘণ্টা ১২মিনিটে হাফসেঞ্চুরি পূর্ণ করতে তামিম খেলেছেন মাত্র ৬৩ বল। আর ইমরুলের হাফসেঞ্চুরি ৮০ বলে। তামিমের সেঞ্চুরি এসেছিল ১২৩ বলে। তাও আবার জুনায়েদের মতো পেস বোলারকে পর পর ২টি চার মেরে। ১৫৩ বলে ইমরুল সাজিয়েছেন তার সেঞ্চুরি। তার সেঞ্চুরির বোলার জুলফিকার বাবর। তামিম-ইমরুল বিনোদনের আবাহ তৈরি করেছেন ব্যাটিং শেলীতে। চার-ছক্কার ফুলঝুরিও দেখেছেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। তামিমের সামনে আরেকটি মাইল ফলক দাঁড়িয়ে। টেস্টে তামিমের সর্বোচ্চ ১৫৭ রান। খুলনা টেস্টের শেষ দিন ১৩৮ রান নিয়ে ব্যাটিং নামবেন এই ড্যাশিং ব্যাটার। অন্যদিকে, শুক্রবারই ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ দেখে ফেলেছেন ইমরুল ১৩২।

এর আগে ঠিক আগের ম্যাচেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তিনি খেলেছিলেন ১৩০ রানের এক অনবদ্য ইনিংস। তামিমের সঙ্গী ইমরুলও দুর্দান্ত ব্যাটে দর্শকদের মাতিয়েছেন। এটা তার ক্যারিয়ারের ২০তম ম্যাচে তৃতীয় সেঞ্চুরি। এটা ইমরুলেরও ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরি।
অথচ প্রথম বলেই পাকিস্তানীদের সমস্বরে আবেদন। বোলার পেসার জুনায়েদ। বলটাও মন্দ নয়। বুঝে ওঠার আগেই সেই আবেদনে প্রকম্পিত ব্যাটার তামিম। আম্পায়ারের ‘না’।

কিন্তু রিভিউর আবেদন হতেই কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল ভয়! যদি কিছু ঘটে যায়; ফের উঁকি দিচ্ছিল শঙ্কার ঘনঘটা। শঙ্কা হাজারটা। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা কি সেই প্রথম ইনিংসের চেহারায়ই ফিরেবেন। খুব বেশিক্ষণ চোখ রাখতে হয়নি স্লো-মোশানে নিশ্চিত হতে। থার্ড আম্পায়ার জানিয়ে দিয়েছেন, বল যেখানে পিচড করে শেষ আশ্রয় উইকেটে হামলে পড়েছিল তাতে শতভাগ নটআউট। হালে পানি ফিরে পেয়েছে বাংলাদেশ। সেখানে ফেরা বাংলাদেশের। সঙ্গে খুলনা আবু নাসের স্টেডিয়ামের কাঠফাঁটা রোদে সেদ্ধ হওয়া উল্লেখ্যযোগ পরিমাণ দর্শকরাও হাফ ছেড়ে বেঁচেছেন। দিনের প্রথম বলটিই ছিল বিপদে-মোড়ানো নাভিশ্বাস উঠতে পারে এমন কিছু। এর বাইরে পাকিস্তান ‘জিরো’।
সকালেই পাকিস্তানের শেষ ৫ উইকেট পত্রপাট তুলে নিয়েছেন বাংলাদেশের স্পিনাররা। যেখানে অনেকটাই এগিয়ে তাইজুল। আগের দিনের ৩-কে ৬ বানিয়েছেন এই ঘুর্ণি জাদুকর। শেষমেষ খালি হাতে ফিরেননি সাকিব। নিয়েছেন ১।Imrul-News-1

আর অভিষেক ম্যাচে শহীদ নিয়েছেন আরো ১। পাকিস্তানের শেষ ৫-এর বিপরীতে মাত্র ৯১ রান। অথচ দ্বিতীয় উইকেট জুটিতেই পাকিস্তান তুলে নিয়েছিল ২২৭ রান। ৬ উইকেট নিয়ে আরেকটি মাইলফলক স্পর্শ করেছেন তাইজুল। ক্যারিয়ারে তৃতীয়বার ৫ প্লাস উইকেট তুলে নিয়েছেন তিনি।
মন্তব্য প্রয়োজন নেই : ক্রমেই পাল্টে গেছে মিডিয়া জগৎ। মে দিবস উপলক্ষে কল-কারখানা-অফিস-আদালত সব বন্ধ। বন্ধ প্রিন্ট মিডিয়া। কিন্তু বন্ধ নেই সংবাদ প্রবাহ। প্রতিক্ষণে মুহূর্তের সংবাদ পরিবেশনের কোনো বিরতি নেই ইলেকট্রোনিক্স এবং অনলাইন মিডিয়ায়। সে কারণেই কর্মবিরতির দিনেও মিডিয়ার প্রতিনিধিদের কর্মহীন থাকার সুযোগ ছিল না। খুলনায় চলছে টেস্ট ক্রিকেট। এক নতুন উচ্চতায় দিন কাটিয়েছে বাংলাদেশ। তামিম-ইমরুলের কাব্যিক ইনিংস, পাটর্নাশিরেপর রেকর্ড। আরো কত কি? প্রিন্ট মিডিয়ার অনেক বন্ধুরাই এসব দেখেছেন। নোট রেখেছেন। কিন্তু পুড়ছেন আফসোসে। লিখার সুযোগ নেই। অথচ চতুর্থ দিন শেষে বাংলাদেশের অনন্য উচ্চতার লাইন-লেন্থে ফিরেছে। প্রিন্ট মিডিয়ার বন্ধুদের ধন্যবাদ যে সুযোগ থাকার পরও তারা অবসরে থাকেননি। বরং এমন একটি দিনের দুই সেশনের ব্যাটিং গোগ্রাসে অবগাহন করেছেন।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
বাংলাদেশ : প্রথম ইনিংস ৩৩২ এবং দ্বিতীয় ইনিংস, ২৭৩/০, ৬১ ওভার (তামিম ১৩৪*, ইমরুল ১৩২*) ।
পাকিস্তান : প্রথম ইনিংস ৬২৮/১০, ওভার ১৬৪.৪ (হাফিজ ২২৪, আজহার ৮৩, মিসবাহ ৫৯, আসাদ ৮৩, সরফরাজ ৮২, ইউনিস ৩৩; তাইজুল ৬/১৬৩, শুভাগত ২/১২০)।
* চতুর্থদিনশেষে

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend