এমন ড্র জয়ের চেয়ে বড় কিছু
এতগুলো ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর শিরোনাম নিয়ে ধন্দে পড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। পেশাদার মিডিয়া প্রতিনিধি হয়েও সেই রেশ থেকে রেহাই পাইনি। অনেক চিন্তার পর মনে হল- এত অর্জনের একটি ম্যাচের শিরোনাম নাইবা দিলাম। আবার বিপদও মনে হয়েছে। তাই এমন ড্র-কে জয়ের চেয়ে বড় কিছু ভাবতেও খারাপ লাগছে না।
তামিমের ডাবল সেঞ্চুরি-ক্যারিয়ারসেরা ব্যক্তিগত রান। ইমরুলেরও ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ ইনিংস। উদ্বোধনী জুটিতে সর্বোচ্চ রান, সঙ্গে বিশ্বরেকর্ড। দ্বিতীয় ইনিংসে দলের রান ৫৫৫।
সেই সঙ্গে টানা ৩ দিন পাকিস্তানের খুব কাছাকাছি থাকা ম্যাচ দেখেও মুখ ফিরিয়ে নেয়নি দর্শকরা। তারা এসেছেন, অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। আর মনে করিয়ে দিয়েছেন- বাংলাদেশ এখন আর আগের বাংলাদেশ নেই। এটা টিম বাংলাদেশ। তামিম-ইমরুলে চতুর্থ দিন শেষেই উৎসবে রঙিন হয়ে উঠেছিল খুলনা। শেষদিন শেখ আবু নাসের স্টেডিয়াম যেন আরও বেশী উদার হয়ে বাংলাদেশকে উজাড় করে দিয়েছে; দিয়েছে আরও অনেক কিছুই।
রঙ বদলের ম্যাচে এত রেকর্ড হতে পারে তা পরিসংখ্যান ঘাটাঘাঁটি করেই পাওয়া দুষ্কর। সে কারণে রেকর্ডবুকের দ্বারস্থ হওয়ার ইচ্ছা হল না। কী কী ঘটেছে খুলনা টেস্টে; কী কী ঘটেছে শেষদিন?
এক. সবার আগেই এই ম্যাচে উঠে আসবে তামিম ইকবালের নাম। এককথায় বলতে গেলে অসাধারণ ব্যাটিং। এর আগেও তামিমের ব্যাটে বাংলাদেশ জয় পেয়েছে, পেয়েছে রানও। কিন্তু টেস্টে চতুর্থ দিনে নেমে এমন ব্যাটিং বিরল ঘটনা। ডাবল সেঞ্চুরি। ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ ইনিংস, ২০৬।
মুশফিকের ২০০ রান টপকে বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস। ৪৪৬ মিনিট উইকেটে থাকা। একাই খেলেছেন ২৭৮ বল, যার মানে ৪৬.২ ওভার পার হয়েছে তার ব্যাটে। খেলেছেন ১৭ বাউন্ডারি, সঙ্গে ৪টি ওভার বাউন্ডারি। পাহাড়সম রানের বোঝা নিয়ে একই ধরনের ব্যাটিংয়ে শুধু পাকিস্তানই নয়, বিস্মিত হবে ক্রিকেট বিশ্বও। তামিম তার ব্যাটে এঁকেছেন পাকিস্তানী বোলারদের বধের গল্প-কাহিনী। এই ম্যাচেই তামিম টপকে গেছেন আশরাফুলের ৬ সেঞ্চুরির আগের রেকর্ড। এখন তামিম ৭-এ। সঙ্গে টানা ৩ টেস্ট সেঞ্চুরির অংশীদারও বটে।
দুই. ইমরুল কায়েসও উঠে এসেছেন ভিন্ন উচ্চতায়। ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ ১৫০ রানের ইনিংস খেলেছেন টেস্ট ব্যাকরণকে শতভাগ মাথায় নিয়ে। ৩৫১ মিনিট কাটিয়ে খেলেছেন ২৪০ বল। তার ব্যাটেও ছিল চার-ছক্কার বাহারি স্ট্রোক। ১৬ চারের সঙ্গে ইমরুলের ছক্কা ৩টি। তামিমের চেয়ে ঠিক একটি করে বাউন্ডারি-ওভার বাউন্ডারি কম। এটা তার ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরি। আগেরটি করেছিলেন নভেম্বরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। সেই ম্যাচেই ছিল ১৩০ রানের সর্বোচ্চ রানের ইনিংস।
তিন. শুধু বাংলাদেশেরই নয়, তৃতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নেমে তামিম-ইমরুল ভেঙেছেন ৫৫ বছরের ইতিহাস। টেস্ট ক্রিকেটের তৃতীয় ইনিংসে (কিংবা কোনো দলের দ্বিতীয় ইনিংসে) এর আগে ১৯৬০ সালে ২৯০ রানের জুটিবদ্ধ রান ছিল রেকর্ডের পাতায় এক নম্বরে। শনিবার সেখানে উঠে গেছে বাংলাদেশের নাম, লিখিয়েছেন তামিম-ইমরুল। তারা ৩১২ রানের জুটি গড়ে ইতিহাস খচিত ফ্রেমেবন্দী হয়েছেন। তারা ভেঙেছেন ১৯৬০ সালে ইংল্যান্ডের উদ্বোধনী জুটি কলিন কাউড্রে-জিউফ পোলারের ২৯০ রানের রেকর্ড। তাদের জুটির ছন্দপতন হয়েছে ৩৫১ মিনিটের মাথায়। খেলেছেন ৭৫.৪ ওভার।
চার. বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দলীয় রানের ইনিংসও হয়ে গেছে খুলনায়। ৫৫৫ রানের পর পাকিস্তানের প্রস্তাবিত ড্র মেনে নেওয়ার আগে বাংলাদেশের চোখ ছিল আগের স্কোরবোর্ডেই। কিন্তু সমঝোতার কারণে সেই ২০১২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তুলে নেওয়া ৫৫৬ রানের গণ্ডি পেরোনো হয়নি।
পাঁচ. তাইজুলের ৬ উইকেট। তামিম-ইমরুলের বিস্ময়কর ব্যাটের ছায়ায় পড়ে গেছেন তাইজুল। অথচ পাকিস্তানের আরও বেশি সময় ব্যাটিং করার স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দিয়েছেন এই স্পিনার। তার ১৬৩ রানে ৬ উইকেট তুলে নেওয়ার ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঘটনা। এটা তার টেস্ট ক্যারিয়ারে তৃতীয়বার ৫ বা তার চেয়ে বেশী উইকেট তুলে নেওয়ার ঘটনা। অথচ এই স্পিনার খেলেছেন মাত্র ৬ টেস্ট।
শেষ দিনের গল্প
খুলনায় চতুর্থ দিন শেষেই নিশ্চিত হয়েছিল ম্যাচের গতিপথ। বাকি ছিল গৌরবময় রেকর্ডের অভিযাত্রার শেষ দেখা। আগের দিনের ৬১ ওভার শেষে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২৭৩।
শেষদিন ব্যাটিংয়ে নামার আগে তামিমের ব্যাটে ১৩৪, ইমরুলের ১৩২ রান। সেখান থেকেই শুরু করেছিলেন এই যুগল। কিন্তু প্রথম সেশনের আগেই সাজঘরে ফিরে গেছেন ইমরুল। তখন তার ব্যাটে ১৫০ রান। দলের ৩১২।
দুর্দান্ত খেলছিলেন একপ্রান্তে তামিম, অনপ্রান্তে স্বপ্রতিভ ইমরুল। পার্টনারশিপের গল্পটা আরও বড় হলেও হতে পারত। কিন্তু ইমরুল স্ট্রেইট ড্রাইভে বাউন্ডারি হাঁকাতে গিয়ে ক্যাচ দিয়েছেন বদলি ক্রিকেটার আজমের হাতে। পরের গল্প শুধুই তামিমময়। ইমরুলের ফিরে যাওয়ার পরও থেমে থাকেননি তামিম। হাতখুলে-চোখ ধাঁধিয়ে ছুঁয়ে নিয়েছেন ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি। আর ওই ডাবল স্পর্শ করার পথে যে ২টি ছক্কা মেরেছেন, তা লা-জবাব। পাকিস্তানের হাফিজ যেমন ছক্কায় সেঞ্চুরি করেছিলেন, সেই বদলা নিয়েছেন তামিমও। তার আগেই টপকে গেছেন নিজের সেরা ইনিংসের মাইলফলক। তামিমের আগের ক্যারিয়ারসেরা ১৫১ ছিল ভারতের বিপক্ষে। সেখানে তিনি ১৮১ মিনিট উইকেটে ছিলেন। এবার কিন্তু টেস্টমুখী ব্যাটার তামিম সময়ে চোখ রেখেছিলেন। খেলেছেন পাক্কা ৭ ঘণ্টা ২৪ মিনিট। ডাবল সেঞ্চুরির পর ছাড়িয়ে গেছেন মুশফিককেও। মুশফিকের ছিল ২০০ রান। ২০৬ রানে তামিম ফিরেছেন হাফিজের বলে, যে হাফিজের সঙ্গে আরেকটি লড়াই ছিল। পাকিস্তানের পক্ষে ডাবল সেঞ্চুরি করা হাফিজ যখন দলের সব বোলিং অস্ত্র অচল তখন বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানদের ফিরিয়েছেন চতুর বোলিং করে। হাফিজ করেছেন ২০৮ রান। ২ রান কম করেও কিন্তু ব্যাটিংশৈলীর গুণে হাফিজদের কাছ থেকে ম্যাচসেরা পুরস্কার ছিনিয়েই নিয়েছেন তামিম। মোহাম্মদ হাফিজ ডাবলের সঙ্গে দ্বিতীয় ইনিংসে ২ উইকেট নিয়েও হেরে গেছেন তামিমের কাছে। কেন? তামিম যেখান থেকে বাংলাদেশকে মর্যাদার আসনে তুলেছেন তা ছিল পাকিস্তানের জন্য অভাবিত ঘটনা। সাহসী তামিমের ব্যাটে বদলে যাওয়া প্রতিচ্ছবি দেখেছে ক্রিকেট বিশ্ব। তাই তো এমন পুরস্কার। মাহমুদউল্লাহ ৪০, শুভাগত ২০, মুমিনুলের ২১ কিংবা মুশফিকের ডাক নিয়ে বলার কিছুই নেই এমন ম্যাচে। তবে সাকিবের ব্যাটিংয়ে ফিরে আসা এবং অপরাজিত ৭৬ রানের গল্পটা না হলে নয়। সম্মতির ড্র’র আগে তখনো ওভার বাকি ছিল ১৫।
সেখানে সেঞ্চুরির আরেকটি স্বপ্ন ক্রিকেট সৌহার্দ্যের কাছে বিসর্জিতই হয়েছে। কিন্তু সৌম্যের আউটটি আবারও প্রমাণ করেছে- এখনো টেস্টে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে এই নতুন সেনসেশনকে। ৪৫ বলে ৩৩ রান করে অকেশনাল শফিকের বলে হাফিজকেই ক্যাচ দিয়েছেন সৌম্য। বাংলাদেশ ৬ উইকেট খোয়ালেও সাজঘরে ফিরেছে বীরের বেশে। তখন বাংলাদেশের স্কোর ৫৫৫।
এমন উৎসবের দিনে অশান্তির বৃষ্টিও এসেছিল। একপর্যায়ে মনে হচ্ছিল তামিমের ডাবলে বাধা হয়ে দাঁড়াবে তা। কিন্তু দুই দফা হিমগুঁড়ি বৃষ্টি শুধু অশান্তির বার্তা বয়ে এনেছে; এই যা।
প্রথমত বিশ্বকাপে দুর্দান্ত পারফর্ম। অতঃপর ঢাকায় ওয়ানডে সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করার পর টোয়েন্টি২০ ম্যাচে পাকিস্তানকে নাস্তানাবুদ করার সৌরভ-অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত বাংলাদেশ খুলনায়ও পাকিস্তানীদের সেই রূপসজ্জায় সাজিয়েছে তামিম-ইমরুলদের বীরত্বে। তাই তো বাংলাদেশের ব্যাটিং দেখে বিস্মিত পাকিস্তান শিবির। তারা স্বপ্নে ভেবে দেখেনি এমন ম্যাচের এমন পরিণতির কথা। সে কারণেই বাংলাদেশকে সাধুবাদ জানিয়ে পাকিস্তান অধিনায়ক মিসবাহ বলেছেন, ‘এখন সময় বাংলাদেশের।’ ব্যাকফুটের একটি ম্যাচকে ড্র বানিয়ে ফেলে জয়ের তৃপ্তিতে তৃপ্ত হতেও এখন আর বাধা নেই। পাকিস্তানের বিপক্ষে সাড়ে ১৪ বছরের মাথায় প্রথম ড্র পাওয়া জয়ের চেয়ে বড় কিছু।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
বাংলাদেশ : প্রথম ইনিংস ৩৩২ এবং দ্বিতীয় ইনিংস, ৫৫৫/৬, ১৩৬ ওভার (তামিম ২০৬, ইমরুল ১৫০, সাকিব ৭৬*, মাহমুদউল্লাহ ৪০, সৌম্য ৩৩; জুনায়েদ ২/৮৮, হাফিজ ২/৮২) ।
পাকিস্তান : প্রথম ইনিংস ৬২৮/১০, ওভার ১৬৪.৪ (হাফিজ ২২৪, আজহার ৮৩, মিসবাহ ৫৯, আসাদ ৮৩, সরফরাজ ৮২, ইউনিস ৩৩; তাইজুল ৬/১৬৩, শুভাগত ২/১২০)।
ফল : ম্যাচ ড্র (দুই ম্যাচ সিরিজের প্রথম টেস্ট শেষে ০-০ সমতা)
ম্যান অব দ্য ম্যাচ : তামিম ইকবাল (বাংলাদেশ)