রাজনৈতিক অঙ্গনে শৃঙ্খলা আনতে বৈশ্বিক চাপে শেখ হাসিনা
সুশাসন নিশ্চিত করতে ও রাজনৈতিক অঙ্গনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক চাপে রয়েছেন। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও বৈশ্বিক অভিভাবক জাতিসংঘ বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং পোশাক খাতে সুশাসন নিশ্চিতে শেখ হাসিনাকে চাপ দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিরা এরই মধ্যে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি আলাপ করে তাদের উদ্বেগের বিষয়টি প্রকাশ করেছেন।
একাধিক কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, সদ্যসমাপ্ত সিটি নির্বাচন, ধারাবাহিকভাবে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং পোশাক খাতের বিভিন্ন অনিয়ম, বিশৃঙ্খল পরিবেশ ও সহিংসতাকে যুক্তরাষ্ট্র একাধিকবার অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। সর্বশেষ ঢাকা সফর করা যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের আন্ডার সেক্রেটারি ওয়েন্ডি শারম্যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার রাতে সরাসরি দেখা করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ওয়েন্ডি শারম্যান গত বৃহস্পতিবার রাতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দীর্ঘ এক ঘণ্টা বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে সিটি নির্বাচনের অনিয়ম, রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং পোশাক খাত প্রাধান্য পায়। ওয়েন্ডি শারম্যান প্রধানমন্ত্রীকে সিটি নির্বাচন সম্পর্কে বলেন, সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে যে অনিয়ম পাওয়া গেছে তা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় কখনই কাম্য নয়। এই অনিয়মগুলোর সঙ্গে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি না করলে সুশাসন নিশ্চিত হবে না এবং গণতন্ত্রের যাত্রাও মসৃণ হবে না। সামনের দিনের নির্বাচনে এমন অবস্থা হবে না, তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সিটি নির্বাচনের অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ওয়েন্ডি শারম্যান প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, বাংলাদেশ সম্ভাবনাময় একটি দেশ। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা শুভকর নয়। এমন হলে বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া সম্ভব হবে না। রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার জন্যই একের পর এক সহিংস কর্মকাণ্ড ঘটছে। রাজনৈতিক শৃঙ্খলার জন্য দলগুলোর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী সমঝোতা হওয়া প্রয়োজন। এর সমাধানের উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। সবগুলো দলকে নিয়ে আলোচনায় বসতে হবে।
পোশাক খাত সম্পর্কে ওয়েন্ডি শারম্যান প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, তৈরি পোশাক খাতের পরিবেশ উন্নয়নে বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করলেও কর্মপরিবেশের শতভাগ উন্নয়ন করতে পারেনি। এখনো এই খাতের ইউনিয়ন নেতারা শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, যা ইতিবাচক নয়। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী, পোশাক খাতের পরিবেশ শতভাগ নিশ্চিত করতে না পারলে বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা পাবে না।
প্রধানমন্ত্রীর দফতরসহ একাধিক সূত্রে জানা গেছে, অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়েন্ডি শারম্যানকে জানান, সদ্যসমাপ্ত সিটি নির্বাচন বাংলাদেশের একমাত্র নির্বাচন, যেখানে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। কিছু অনিয়ম হয়েছে, সেটা সরকার অনুসন্ধান করে কঠোর ব্যবস্থা নেবে। বর্তমান সরকার সহিংসতার বিরুদ্ধে। কয়েকটি গোষ্ঠী বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে চায় বলেই সিটি নির্বাচনকে বিতর্ক করছে এবং তারা মাঝপথে নির্বাচন বয়কট করে জনগণের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করছে।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং পোশাক খাত সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়েন্ডি শারম্যানকে জানান, বর্তমান সরকার সহিংসতার বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্রের পক্ষে। কতিপয় গোষ্ঠী জঙ্গি তৎপরতা এবং সহিংসতায় বিশ্বাসী। সরকার কখনই এই জঙ্গিদের সঙ্গে সমঝোতা করবে না। তৈরি পোশাক খাতের উন্নয়নে এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট আইনের সংশোধনসহ এই খাতের অনেক উন্নয়ন করা হয়েছে। আর যেগুলো বাকি আছে সেগুলো ধাপে ধাপে করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ও দ্য ডেইলি অবজারভারের সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী শনিবার রাতে বলেন, মোটেই আন্তর্জাতিক কোনো চাপ নেই। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রসহ যে দেশগুলো আমাদের সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে তা ওভার রিএ্যাকশন। আমাদের সমস্যা আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকেই সমাধান করতে হবে। তারা (বিদেশীরা) সিটি নির্বাচন নিয়ে যে অনিয়মের কথা বলছে, সেটা নির্বাচন কমিশনের কাছে বলতে হবে। কিন্তু তা না করে অন্য জায়গায় বললে তো কোনো লাভ হবে না।
ওয়েন্ডি শারম্যান বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘সিটি নির্বাচনের অনিয়ম সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ হয়েছে। শুধু তাই নয়, এর আগে জাতীয় প্রতিরক্ষা বৈঠক এবং অংশীদারিত্ব সংলাপেও এ বিষয়ে আলাপ হয়েছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অনিয়মের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কথা সরকারকে জানানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সিটি নির্বাচনে সংঘটিত অনিয়মের সমাধান চায় এবং সামনের দিনের নির্বাচনে এমন ঘটনা ঘটবে না তার নিশ্চয়তা চায়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রের শৃঙ্খলার জন্য নেতৃবৃন্দের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী সমঝোতা প্রয়োজন।’
তিনি আরও বলেন, ‘তৈরি পোশাক খাতে উন্নয়নে বাংলাদেশকে আরও পথ পাড়ি দিতে হবে। কেননা এখনো এই খাতের ইউনিয়ন নেতারা শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, যা কাম্য নয়।’
জানা গেছে, সিটি নির্বাচন এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের বিশৃঙ্খলা নিয়ে বৈশ্বিক অভিভাবক জাতিসংঘও অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন সরাসরি শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করে এই অসন্তোষের কথা জানান।
সিটি নির্বাচনে কারচুপি এবং রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সম্পর্কে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে ১৪ দলের বৈঠক শেষে শনিবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ‘তারা প্রমাণ করতে চেয়েছিল, শেখ হাসিনার অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। ভোট হয়েছে, মানুষ ভোট দিয়েছে। অন্যসব নির্বাচনের মতোই দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া এ নির্বাচনে কোনো বড় অঘটন ঘটেনি।’
এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাজ্য, সুইডেন, সুইজারল্যান্ডসহ অনেক রাষ্ট্রই বাংলাদেশের সদ্যসমাপ্ত সিটি নির্বাচনের অনিয়ম এবং রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা নিয়ে উদ্বেগ ও নিন্দা প্রকাশ করেছে। সকলেই দীর্ঘমেয়াদী সমঝোতার জন্য সবগুলো রাজনৈতিক দলকে এক টেবিলে বসার আহ্বান জানিয়েছে।