আন্দোলন নয়, কূটনীতিতে তৎপর বিএনপি
সিটি নির্বাচন বর্জন করলেও সহসাই সক্রিয় কোনো আন্দোলনে যাচ্ছে না বিএনপি। কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখে সরকারকে চাপে রাখতে চায় দলটি। এর মধ্যে বিভিন্ন পেশাজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময় ও আটক নেতাকর্মীদের আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুত মুক্ত করে আনার চেষ্টা অব্যাহত রাখা হবে। দলের বেশ কয়েকজন নেতা ও আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে।
দলের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আপাতত আন্দোলনের কোনো কর্মসূচি দেবে না বিএনপি। সময় নিয়ে ভেবেচিন্তে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানিয়েছে, এ মুহূর্তে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখবে বিএনপি। সরকার ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতায় থেকে সর্বশেষ গত ২৮ এপ্রিল ভোট জালিয়াতির সিটি নির্বাচন সম্পন্ন করেছে। এ সব বিষয়ে জাতিসংঘের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন দেওয়ার ব্যাপারে চাপে রাখার একটা প্রক্রিয়াও অব্যাহত রাখতে চায় বিএনপি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘আপাতত এভাবেই চলবে। তারপর কর্মসূচি আসবে, নতুন কর্মসূচি তো দিতেই হবে।’
কূটনৈতিক তৎপরতা সম্পর্কে তিনি জানান, সিটি নির্বাচনের আগেও জাতীয় নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। তারা সকল দলের অংশগ্রহণে একটা নতুন জাতীয় নির্বাচনের কথা বলে আসছে। জাতিসংঘও এ ব্যাপারে উদ্বেগের কথা জানিয়েছে।
তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘ চাইলে সদস্যভুক্ত দেশের বিরুদ্ধে একটা ব্যবস্থা নিতে পারে। বাংলাদেশ সদস্য দেশ, তাই জাতিসংঘ সরকারের প্রতি চাপ প্রয়োগ করতে পারে। যেহেতু সরকার একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতা বসে আছে।’
তবে সাবেক এই স্পিকার এ কথাও স্বীকার করেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশীদের খুব বেশি কিছু করার নেই। তিনি বলেন, আমাদের নিজেদের সমস্যা নিজেদেরই আলোচনা করে সমাধানে আসতে হবে।
দলের অপর এক স্থায়ী সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান আন্দোলন সম্পর্কে বলেন, ‘হুট করেই সক্রিয় আন্দোলনে যাওয়া যায় না। বিগত দিনের আমাদের সফলতা, ব্যর্থতা যাচাই-বাছাই করে সবাই আলোচনা করে নতুন কর্মসূচি দেওয়া হবে। দলের চেয়ারপারসন পরবর্তী করণীয় ঠিক করবেন।’
মাহবুবুর রহমান আরও জানান, দলের অনেক নেতাকর্মী গ্র্রেফতার আতঙ্কে বাসা-বাড়িতে ফিরতে পারছে না। তা ছাড়া তাদের নামে একাধিক মামলা রয়েছে। সক্রিয় কর্মসূচিতে গেলে আবারও মামলার আতঙ্ক থাকে। আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মামলাগুলো নিষ্পতি করা ও আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীরা যাতে ঘরে ফিরতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। আইনজীবীরা কাজ করে যাচ্ছেন।
বিএনপি নেতাকর্মীদের দাবি, সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে দল গুছিয়ে পূর্ণ শক্তি নিয়ে মাঠে নামতে দলটি। সিটি নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার দায় এড়াতে হরতালের মতো কর্মসূচি থেকেও নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন খালেদা জিয়া। তবে, নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠায়, এটিকে আপাতত বিএনপির জন্য নৈতিক জয় হিসেবেই দেখছেন তারা। সে কারণে আপাতত বিএনপি কঠোর আন্দোলন যাবে না।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, এবার ‘ধীরে চলো’ নীতিতেই এগোতে চান বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। ফলপ্রসূ আন্দোলনের শক্ত ভিত গড়ার লক্ষ্য নিয়ে শিগগিরই কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হবে। দল, জোটের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের বৈঠকের পাশাপাশি বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন, সুশীল সমাজের নেতাদের সাথে খালেদা জিয়া মতবিনিময় শুরু করার পরিকল্পনা করছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন মামলায় কারাগারে আটক নেতাদের ছাড়িয়ে আনাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে।
আন্দোলনে গত জানুয়ারি থেকে তিন মাস নেতাকর্মীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। সিটি নির্বাচনকে ঘিরে ফের সরব হয়ে উঠে তারা। খালেদা জিয়া প্রচারণায় অংশ নেওয়ায় রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুনভাবে উত্তাপ ছড়ায়। ‘নজিরবিহীন ভোট কারচুপি’র অভিযোগ তুলে সিটি নির্বাচন বর্জন করার পর, নানা মহলে জল্পনা-কল্পনা ছড়াতে থাকে পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের দাবি, ভোটের ফল আওয়ামী লীগের ঘরে গেলেও, নৈতিক জয় হয়েছে বিএনপিরই।
বিএনপির কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, ৫ জানুয়ারি ২০১৪ বিএনপির নির্বাচনে না যাওয়াটা যে সঠিক ছিল তা আবার প্রমাণ হয়েছে সিটি নিবার্চনে। এ নির্বাচনে কেন্দ্র দখল করে জাল ভোট, সংঘর্ষ ও বিভিন্ন অনিয়মের ভিডিও ফুটেজ এবং আলোকচিত্র সংগ্রহ করা হচ্ছে। এগুলো বিদেশী রাষ্ট্র ও দূতাবাসগুলোতে সরবরাহ করা হবে।
ওই সূত্রে আরও জানা যায়, আগামী এক বছরের মধ্যে একটি নতুন জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায় বিএনপি। সেই লক্ষ্যে দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. ওসমান ফারুক যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। দেশে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান, সাবিহ উদ্দিন আহমেদসহ আরও কয়েকজন নেতা কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।
বিএনপির নেতাকর্মীদের মামলার প্রসঙ্গে দলের গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক সানা উল্লাহ মিয়া বলেন, ‘বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১৫ থেকে ২০ হাজার মামলা আছে। লাখ লাখ নেতাকর্মী আসামি। আমরা আইনী প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছি কীভাবে তাদের ছাড়িয়ে আনা যায়।’
তিনি আরও জানান, কারাগারে আটক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নামে প্রায় ৮০টি মামলা আছে। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ অনেক নেতাই এখন কারাগারে। তাদের কারামুক্ত করতে জোরদার আইনী লড়াই চালিয়ে যেতে বেগম খালেদা জিয়ার সার্বক্ষণিক নির্দেশনা রয়েছে।
বিএনপির আইনজীবী এ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন মেজবাহ বলেন, ‘নেতাকর্মীদের কারাগার থেকে ছাড়িয়ে আনার ব্যাপারে সব সময় তাগিদ থাকে। আইনানুগভাবে যত দ্রুত সম্ভব নেতাকর্মীদের ছাড়িয়ে আনা যায় সেই চেষ্টা আমরা করে যাচ্ছি।’
তিনি আরও জানান, সারা দেশে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় ২০ হাজার মামলা আছে। আসামি আছে কয়েক লাখ। মূলত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আর এ গনি, ড. আব্দুল মঈন খানসহ কয়েকজন ছাড়া ওয়ার্ড পর্যায় থেকে শুরু করে শীর্ষনেতাদের নামে একাধিক মামলা আছে।’