সঞ্চালন লাইন ও উপকেন্দ্রের সক্ষমতা বৃদ্ধির কাজ চলছে: ভারত থেকে আরও ৬ শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি

powerplantপ্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে আরও ৬ শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করবে সরকার। সেই লক্ষ্যে সঞ্চালন লাইন নির্মাণ, উপকেন্দ্রের সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ আনুষঙ্গিক কাজ এগিয়ে চলছে।
পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর থেকে বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা সাবস্টেশন হয়ে ৫ শ’ মেগাওয়াট এবং ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশের কুমিল্লা দক্ষিণ সাবস্টেশনের মাধ্যমে এক শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হবে। এ জন্য এক হাজার ৬ শ’ কোটি টাকার দু’টি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার।
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর থেকে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা হাইভোল্টেজ সাবস্টেশনের মাধ্যমে ৫ শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানায়, বর্তমান সরকার ২০২১ সালের মধ্যে লোডশেডিংমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। ওই সময়ের মধ্যে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে কাজ করছে সরকার। দশম সংসদের সর্বশেষ (চতুর্থ) অধিবেশনে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল জাতীয় সংসদকে জানান, বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ১১ হাজার ২৬৫ মেগাওয়াট। ২০১০ সালের পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী আগামী ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। সে অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে দেশের সব নাগরিকের জন্য বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে জানান তিনি।
মন্ত্রী বলেন, ‘দেশে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে বর্তমানে সরকারি খাতে মোট ৪ হাজার ৬৫৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১৭টি এবং বেসরকারি খাতে মোট ২৭ হাজার ৬ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে।’
সূত্র জানায়, ২০২১ সালের মধ্যে জনগণকে প্রতিশ্রুত ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দেওয়ার লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি বড় বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেওয়ার পাশাপাশি বিদেশ থেকেও বিদ্যুৎ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এ সিদ্ধান্তের আলোকেই গত ২০১৩ সালের অক্টোবর থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর থেকে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা সাবস্টেশনের মাধ্যমে বর্তমানে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি হচ্ছে। একই এলাকা থেকে ভেড়ামারা সাবস্টেশনে আরও ৫ শ’ মেগাওয়াট এবং ত্রিপুরা থেকে এক শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কুমিল্লা দক্ষিণ সাবস্টেশনের মাধ্যমে আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
ভারত থেকে ৬ শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ (ভেড়ামারা)-ভারত (বহরমপুর) বিদ্যমান গ্রিড আন্তঃসংযোগের ক্ষমতা বর্ধিতকরণ (৫০০ মেগাওয়াট) প্রকল্প এবং বাংলাদেশ (কুমিল্লা দক্ষিণ)-ভারত (ত্রিপুরা) গ্রিড ইন্টারকানেকশন (১০০ মেগাওয়াট) প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে। এ দু’টি প্রকল্প বাস্তবায়নে এক হাজার ৬ শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গত ৩১ মার্চ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এ দু’টি প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ (ভেড়ামারা)-ভারত (বহরমপুর) বিদ্যমান গ্রিড আন্তঃসংযোগের ক্ষমতা বর্ধিতকরণ (৫০০ মেগাওয়াট) প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ৪৬০ কোটি টাকা, সংস্থার নিজস্ব তহবিল ১০০ কোটি টাকা এবং প্রকল্প সাহায্য ৮৪৫ কোটি টাকা। জানুয়ারি ২০১৫ থেকে জুন ২০১৮ মেয়াদে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (পিজিসিবি) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। আর ‘ত্রিপুরা (ভারত)-কুমিল্লা দক্ষিণ উপকেন্দ্র (বাংলাদেশ) গ্রিড আন্তঃসংযোগ প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ১৬২ কোটি ৭ লাখ টাকা এবং সংস্থার নিজস্ব তহবিল ১৭ কোটি টাকা। পিজিসিবি জানুয়ারি ২০১৫ থেকে জুন ২০১৬ মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে।
ভেড়ামারা-বহরমপুর গ্রিড আন্তঃসংযোগ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা। এ প্রকল্পের আওতায় ১২ কিলোমিটার ২৩০ কেভি ডাবল সার্কিট সঞ্চালন (রিডার ক্রসিংসহ) লাইন নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া ভারত থেকে আমদানিকৃত ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রিসিভের (গ্রহণ) জন্য ভেড়ামারায় এইচভিডিসি ব্যাক-টু-ব্যাক উপকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে।
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর থেকে যে সঞ্চালন লাইন দিয়ে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসছে ওই লাইন দিয়েই অতিরিক্তি ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হবে। এ পরিমাণ বিদ্যুৎ বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিডে যোগ করতে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় এইচভিডিসি-২ ব্যাক-টু-ব্যাক উপকেন্দ্র নির্মাণে ইন্ডিয়ান পাওয়ার গ্রিড কোম্পানিকে কনসালটেন্সি ফার্ম নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রায় দেড় মাস আগে পিজিসিবির সঙ্গে এ বিষয়ে ইন্ডিয়ান পাওয়ার গ্রিডের একটি চুক্তি সই হয়। এইচভিডিসি-২ ইউনিটটি নির্মাণে কারিগরি নানা দিক পর্যালোচনা ও কী পরিমাণ অর্থ খরচ হতে পারে তা সমীক্ষা করছে ভারতীয় এ কোম্পানিটি। এ জন্য পিজিসিবি তাদের দিয়েছে ২০ কোটি টাকা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ইতোমধ্যে ইন্ডিয়ান পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির বিশেষজ্ঞ কয়েক কর্মকর্তা ভেড়ামারা সাবস্টেশনে কয়েকবার পরিদর্শন করেছেন। সামগ্রিক বিষয় সমীক্ষা শেষে ইন্ডিয়ান পাওয়ার কোম্পানিটি পিজিসিবিকে অবহিত করবে। এরপর এইচভিডিসি-২ ইউনিটটি নির্মাণে আরেকটি চুক্তি সই হবে। পিজিসিবি ২০১৮ সালের জুনের মধ্যে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার কথা।
তবে সেদিক থেকে বাংলাদেশ (কুমিল্লা দক্ষিণ)-ভারত (ত্রিপুরা) গ্রিড কানেকশন (১০০ মেগাওয়াট) প্রকল্পের কাজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে বলে প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী শফিউল্লাহ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ত্রিপুরা থেকে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির জন্য গৃহীত প্রকল্পের কাজ অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে গেছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সঞ্চালন লাইন নির্মাণসহ আনুষঙ্গিক কাজ সম্পন্ন হবে।’
ভারতের ত্রিপুরা থেকে আমদানিকৃত ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পিজিসিবি’র কুমিল্লা (দক্ষিণ) সাবস্টেশনে ব্যবহৃত হবে। তবে কুমিল্লা থেকে ত্রিপুরার পালাটানা কেন্দ্র পর্যন্ত আন্তঃদেশীয় সঞ্চালন লাইনের বাংলাদেশ অংশে বাংলাদেশ এবং ভারত অংশের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব ভারতীয় কর্তৃপক্ষের।
গত ১৫ এপ্রিল কুমিল্লা (দক্ষিণ) সাবস্টেশনের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এনার্জিপ্যাক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড ও পিজিসিবি’র মধ্যে একটি দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর হয়। চুক্তি অনুযায়ী, আগামী আট মাসের মধ্যে কুমিল্লা (দক্ষিণ) সাবস্টেশনে দু’টি নতুন ১৩২ কেভি বে (BAY) নির্মাণ করে পিজিসিবি’র কাছে হস্তান্তর করবে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এনার্জিপ্যাক। এ কাজের চুক্তিমূল্য ধরা হয়েছে ৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।
প্রকল্পের আওতায় ত্রিপুরা থেকে বিদ্যুৎ আমদানির লক্ষ্যে উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজ পূর্ণ গতিতে এগিয়ে চলছে। ত্রিপুরা থেকে কুমিল্লা (দক্ষিণ) সাবস্টেশনে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হবে। তবে ভবিষ্যতে এই লাইন দিয়ে আরও বেশি বিদ্যুৎ আমদানি করা যাবে। সঞ্চালন লাইন নির্মাণে ইতোমধ্যে দু’টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দ্বি-পক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করছে পিজিসিবি।
প্রকল্পের আওতায় গত ১৫ মার্চ কুমিল্লা (উত্তর) সাবস্টেশন থেকে ভারত সীমান্ত পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করতে কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান জিএস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত করে পিজিসিবি। চুক্তি অনুযায়ী, আগামী ১০ মাসের মধ্যে সঞ্চালন লাইনটি নির্মাণ করে পিজিসিবি’র কাছে হস্তান্তর করবে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। এই কাজের চুক্তিমূল্য ৯৮ কোটি ৬১ লাখ টাকা। বাংলাদেশ সরকার ও পিজিসিবি’র অর্থায়নে এ কাজ এগিয়ে চলছে।
এর আগে গত ৮ মার্চ কুমিল্লা (দক্ষিণ) সাবস্টেশন থেকে কুমিল্লা (উত্তর) সাবস্টেশন পর্যন্ত ১৯ কিলোমিটার ১৩২ কেভি ডাবল সার্কিট সঞ্চালন লাইন নির্মাণে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান কেইসি ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে চুক্তি সই করা হয়। এই কাজের চুক্তিমূল্য প্রায় ২৫ কোটি টাকা। চুক্তি অনুযায়ী, আগামী ১০ মাসের মধ্যে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কেইসিকে হাইভোল্টেজ লাইনটি নির্মাণ করে পিজিসিবি’র কাছে হস্তান্তর করতে হবে।
এ ব্যাপারে পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুম আলবেরুনী বলেন, ‘সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত ও দেশের চাহিদা অনুযায়ী প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির লক্ষ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকল্প দু’টির কাজ এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে ত্রিপুরা থেকে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির জন্য সঞ্চালন সুবিধা বাড়ানোর কাজ অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়েছে। এ ছাড়া কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় এইচভিডিসি’র দ্বিতীয় ব্লক নির্মাণের কাজও চলমান রয়েছে।’ দ্রুততার সাথেই এ দু’টি প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend