‘সমঝোতা নাকি বিএনপির অক্ষমতা’
চলতি বছর ৫ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া তিন মাসের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণসহ চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচন উপলক্ষে হঠাৎ করেই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। অবশ্য শুধু সিটি নির্বাচন উপলক্ষে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তাপ হারিয়েছে এমনটি মনে করেন না রাজনীতি বিশ্লেষকরা। তাদের কেউ কেউ মনে করছেন এটা সরকারের সঙ্গে গোপন সমঝোতার কারণেই হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে এমনটি হয়েছে।
তাদের মতে, বিএনপি দীর্ঘ ৯২ দিন অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচির মাধ্যমে নিজেদের দাবি আদায়ের ব্যাপারে অনেকটা অনড় অবস্থানে ছিল। অন্যদিকে বিএনপির আন্দোলন দমনে মারমুখী ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। অবশেষে গত মার্চ মাসে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। এই নির্বাচনকে সামনে রেখে উভয় দল নিজেদের অনড় অবস্থান থেকে সরে আসার চেষ্টা করে।
এর আগে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ‘ভোটারবিহীন’ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনকে ‘গণতন্ত্র হত্যা’ দিবস আখ্যায়িত করে চলতি বছর ৫ জানুয়ারি রাজধানীতে সমাবেশ করার ঘোষণা দেয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। আর এ দিনকে ‘গণতন্ত্র রক্ষা’ দিবস হিসেবে পালন করতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা করে। দেশের প্রধান দুই দলের মুখোমুখি কর্মসূচির কারণে ‘বিশৃঙ্খলা’ সৃষ্টি হতে পারে এমন অজুহাতে রাজধানীতে সকল প্রকার সভা-সমাবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। একই সঙ্গে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে প্রশাসনের মাধ্যমে তার গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে কার্যত ‘অবরুদ্ধ’ করে রাখা হয়। পূর্বঘোষিত কর্মসূচিতে অংশ নিতে ৫ জানুয়ারি নিজের কার্যালয় থেকে বের হতে চাইলে পুলিশের বাধার মুখে ব্যর্থ হন খালেদা জিয়া। এ সময় কার্যালয়ের ভেতরে থাকা বিএনপি চেয়ারপারসন ও অন্য নেতাকর্মীদের লক্ষ্য করে পুলিশ পেপারস্প্রে নিক্ষেপ করে। কার্যালয় থেকে বের হতে না পেরে ওই দিন খালেদা জিয়া সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এরপর টানা ৯২ দিন এমন কর্মসূচির সঙ্গে সাপ্তাহিক কর্মদিবসগুলোতে দেওয়া হয় হরতাল। বিএনপির এমন কর্মসূচিতে সারাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা, পেট্রোলবোমা হামলা ও কথিত বন্দুকযুদ্ধে শতাধিক মানুষ নিহত হন। ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের শিকার হয় কয়েক হাজারের অধিক যানবাহন। বিএনপির এমন কর্মসূচিতে সৃষ্ট নাশকতার দায়ে তৃণমূলসহ শীর্ষ পর্যায়ের বহু নেতাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ধীরে ধীরে বিএনপির আন্দোলন শিথিল হয়ে আসলেও ‘যৌক্তিক’ পরিণতি না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন দলের চেয়ারপারসন। একই সঙ্গে নিজের গুলশানের বাসভবন ছেড়ে শতাধিক দিন পার করেন রাজনৈতিক কার্যালয়ে।
বিএনপির এমন টানা কর্মসূচিতে বার বার সংলাপের মাধ্যমে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি করা হলেও, সরকার এমন দাবি অগ্রাহ্য করে ঢাকার দুটিসহ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিলেও তিন সিটিতেই প্রার্থী দেয় বিএনপি। এ সময় বিএনপি ঘোষিত হরতাল কর্মসূচি ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে শিথিল করা হয়। পরবর্তীকালে অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা না দিলেও কার্যত সব ধরনের কর্মসূচি থেকে সরে আসে বিএনপি। সিটি নির্বাচন উপলক্ষে বিএনপির কর্মসূচি প্রত্যাহারকে অনেকেই ‘এক্সিট ওয়ে’ হিসেবে দেখছেন। আবার অনেকেই মনে করেন সরকারের সঙ্গে দলটির গোপন সমঝোতার ভিত্তিতেই এমনটি হয়েছে।
এদিকে সিটি নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম, কারচুপির অভিযোগ এনে নির্বাচন বয়কট করে বিএনপি। তবে এ সব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এখনো কোনো কর্মসূচি দেয়নি দলটি। বিএনপির এমন নিরুত্তাপ অবস্থানকে দলটির অক্ষমতা হিসেবে দেখলেও অনেকেই মনে করছেন সরকার ও বিএনপির মধ্যে গোপন সমঝোতাও হতে পারে।
দেশে গত চার মাসের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বছরের শুরু থেকেই আমরা একটি অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি লক্ষ্য করি। যার ফলাফল শতাধিক মানুষের মৃত্যু, হাজার খানেক মানুষের অগ্নিদগ্ধ দেহ, দমনের নামে বন্দুকযুদ্ধে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও সর্বোপরি জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হয়ত বিএনপি বা তাদের জোট কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছে, তবে সেটা যে শুধুমাত্র সিটি নির্বাচনই উপলক্ষে ছিল এমনটা মনে হয় না। হতে পারে দুই দলের মধ্যে গোপন কোনো সমঝোতার ফলে এমনটি হয়েছে। আর যদি তাই হয় তবে অবশ্যই সাধুবাদ জানাই। কারণ গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সমঝোতার বিকল্প কেবল সমঝোতাই। সেটি গোপন হোক আর প্রকাশিত হোক।’
নির্বাচন কমিশনের সাবেক কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘দুই দলের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে এমনটি আমার মনে হয় না। কারণ তারা তো মূর্খ না, তাদের তো জ্ঞান-বুদ্ধি আছে। এখন যদি তারা গোপন সমঝোতায় পৌঁছাতে পারে তাহলে কেন এতগুলো মানুষের মৃত্যুর আগে পৌঁছাল না? তেলে জলে যেমন এক হয় না তেমনি বিএনপি-আওয়ামী লীগ সমঝোতাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। আর সমঝোতা হলে তো সিটি নির্বাচনে বিএনপিও কিছু ভাগ পেত। কিন্তু সরকার তো তাদের সামান্য ছাড় দেয়নি।’
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন নিরুত্তাপ হয়ে যাওয়াটা যেমন ইতিবাচক তেমনি কিছু নেতিবাচক দিকও আছে। যেমন হঠাৎ করে কেন বিএনপি তাদের কর্মসূচি থেকে সরে এল? এর কারণ হতে পারে বিএনপি এখন আর কর্মসূচি সফল করার ক্ষমতা রাখে না বা সেই শক্তি-সক্ষমতা বিএনপির ক্ষয়ে গেছে। আবার এমনও হতে পারে বিএনপির কর্মসূচিতে যে সব নাশকতা হয়েছে তার দায়-দায়িত্ব বিএনপির উপরই বর্তায়। আর এতে বিএনপির জন-সমর্থন অনেক হ্রাসও পেয়েছে, বিএনপি তাদের কর্মসূচিতে জন-সম্পৃক্ততা বাড়াতেও পারছিল না। তাই জনবিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয় থেকে বিএনপি এখন কোনো কর্মসূচি দিতে পারছে না। যদি বিএনপির নাশকতাকে সমর্থন না করে কর্মসূচি থেকে সরে আসে তাহলে সেটা ইতিবাচক। অন্যদিকে যদি এমন হয় যে বিএনপির প্রকৃতপক্ষে এখন কোনো মানববন্ধন করারও ক্ষমতা নেই তাহলে তা নেতিবাচক। কারণ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় অবশ্যই একটি শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা প্রয়োজন। তা না হলে শাসকগোষ্ঠী স্বৈরাচার হয়ে ওঠে।’
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সমঝোতা হলে ভাল। যদি গণমাধ্যম বা জনগণের সামনে সমঝোতা করতে উভয় পক্ষ লজ্জা পায় তাহলে গোপনেই হোক তাও জনগণ মুক্তি পাক। তবে সমঝোতা যদি হয়েই থাকে তাহলে তার প্রতিফলন সব জায়গায় হওয়া উচিত। সিটি নির্বাচনের ঘোষণা, বিএনপির কর্মসূচি থেকে সরে আসা ও নির্বাচনে অংশ নেওয়া পর্যন্ত মনে হয়েছে সমঝোতা হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন যেভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে সেটা কখনোই সমঝোতার ইঙ্গিত বহন করে না। কারণ বিএনপি এমন কোনো সমঝোতায় যাবে না যেখানে মেরে, কেটে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জিতে যাবে আর তা বিএনপি মেনে নিবে। এখনো পর্যন্ত আমরা দেখছি বিএনপি নির্বাচন বয়কটের মধ্যেই আছে। এটা একটা গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ। জ্বালাও-পোড়াও কখনো গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ হতে পারে না।’
এদিকে সমঝোতার বিষয়টি নাকচ করে দিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট আহম্মেদ আজম বলেন, ‘বিএনপি নেত্রী আপসহীন নেত্রী। বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো আপস হতে পারে না। আপতদৃষ্টিতে বিএনপিকে নিশ্চুপ মনে হতে পারে। বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক দল, সবস্তরের নেতাকর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে বিএনপি কর্মসূচি দেয়। তা ছাড়া দেশের বৃহৎ তিনটি সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। বিএনপি জানত এই নির্বাচনে কি হবে। আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না, এটা বিএনপি জেনে-বুঝে নির্বাচনে গেছে। কারণ বিএনপি নির্বাচনে না গেলে সরকারের আর কারচুপি প্রয়োজন হতো না। অনেকটা ৫ জানুয়ারির মতো বিনা ভোটে তারা মেয়র নির্বাচিত করে ফেলত।’
আহম্মেদ আজম বলেন, ‘নির্বাচনে অংশ নেওয়া ও কর্মসূচি প্রত্যাহার করা বিএনপির রাজনৈতিক একটি কৌশল। আমরা কর্মসূচি প্রত্যাহার করে একটি সুষ্ঠু ভোটগ্রহণের পরিবেশ সৃষ্টি করে দিয়েছি। একই সঙ্গে নির্বাচনে অংশ নিয়ে আমরা জনগণকে দেখিয়ে দিয়েছি আমাদের জনপ্রিয়তা কতটুকু আর সরকার আমাদের জনপ্রিয়তাকে কত ভয় পায়। সেটা আমরা দেখাতে সক্ষম হয়েছি। সামনের দিনগুলোতে আমরা জনগণকে সঙ্গে নিয়েই কর্মসূচি দিব। আমাদের দাবি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন সে দাবিও আমরা আদায় করব।’
সাংগঠনিক সক্ষমতা ক্ষয় হয়নি দাবি করে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘বিএনপি সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী একটা দল। বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে যদি মোকাবিলা করার ক্ষমতা সরকারের থাকে তাহলে আমি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারি মুহূর্তের মধ্যে সরকারের পতন হবে। কিন্তু সরকার বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা না করে আইনের অপব্যবহার করছে। বিএনপিকে সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে না। শীর্ষ নেতাসহ হাজার হাজার নেতাকর্মীদের মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করছে। রাস্তায় নামলে পুলিশ বিনা উস্কানিতে গুলি ছুঁড়ছে। এটা তো লেভেল প্লেয়িং হতে পারে না। সরকারের হাতে ক্ষমতা আছে বলে তারা যাচ্ছেতাই ব্যবহার করছে। তবে সরকারের টিকে থাকা এ সব অস্ত্রও এক সময় অক্ষম হয়ে যাবে। তখন করুণ পরিণতি নিয়ে তাদের ক্ষমতা ছাড়তে হবে।’