খোকার মতো আব্বাসও ব্যর্থ! দুই ভাগ হচ্ছে ঢাকা মহানগর বিএনপি
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে কোনো ধরনের সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি বিএনপির তখনকার ঢাকা মহানগর কমিটি। যার প্রধান ছিলেন সাদেক হোসেন খোকা। একইভাবে ওই নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে আন্দোলন গড়তে ব্যর্থতার পরিচয় দেন দলটির মহানগর কমিটির বর্তমান আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস। বিগত দিনের মতো এবারও আন্দোলনে ‘নিষ্প্রাণ’ বিএনপির নগর কমিটি।
এই পরিস্থিতিতে ঢাকা মহানগর বিএনপিকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ভবিষ্যৎতে সক্রিয় আন্দোলনের জন্য ঢাকা মহানগর বিএনপির বর্তমান আহ্বায়ক কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে নতুন প্রজন্মকে নেতৃত্ব নিয়ে আসার কথা ভাবা হচ্ছে। একইসঙ্গে ঢাকা মহানগর কমিটি (উত্তর ও দক্ষিণ) দুই ভাগ করার চিন্তা-ভাবনা চলছে। তবে কারা নেতৃত্বে আসছেন এখনই এর কোনো ঘোষণা আসছে না। দলের শীর্ষনেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে খালেদা জিয়া চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। দলটির একাধিক শীর্ষনেতার সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে।
ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসের আস্থাভাজন এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে রবিবার বলেন, ‘বিএনপির মহানগর কমিটি দুই ভাগ করার চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। মির্জা আব্বাসও এ ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। তিনি দুই সিটিতে নতুন নেতৃত্বের কাছে দায়িত্ব দিয়ে চলে যেতে চাইছেন। এখন দেখা যাক, দলীয় ফোরামে কী সিদ্ধান্ত হয়।’
ওই নেতা আরও বলেন, ‘দমন-পীড়নের কারণে সরকারবিরোধী আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধভাবে মহানগরীতে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। সরকার মির্জা আব্বাসকে রাজপথে নামতে দেয়নি। মির্জা আব্বাসকে নিয়ে বরাবরই আতঙ্কে থাকেন। সেই জন্য মিথ্যা মামলা দিয়ে রাজনীতি থেকে তাকে দূরে রাখতে চাইছে সরকার।’
মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলা আছে বলেন জানান তিনি।
গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচিতে ঢাকা মহানগরীর নেতাকর্মীদের মাঠে নামাতে ব্যর্থ হন ঢাকা মহানগর বিএনপির তৎকালীন আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকা। ব্যর্থতার দায়ে খোকার কমিটি ভেঙ্গে নতুন করে দায়িত্ব দেওয়া হয় মির্জা আব্বাসকে। মহানগর বিএনপির দায়িত্ব নিয়ে মির্জা আব্বাস আন্দোলনের হুংকার দিলেও আন্দোলনে সক্রিয় কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি। ফলে আগামী দিনে সক্রিয় আন্দোলনে নতুন প্রজন্মকে নেতৃত্বে নিয়ে আসার চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে। যারা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে রাজপথে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারেন।
বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, গুলশান কার্যালয়ে দলের চেয়ারপারসন ‘অবরুদ্ধ’ থাকলেও বিএনপির মহানগর কমিটির কোনো নেতাকে সেখানে দেখা যায়নি। টানা তিন মাস অবরুদ্ধ থাকার পর ‘শূন্য’ ঘরে ফিরতে হয়।
একই চিত্র ছিল দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ক্ষেত্রেও। প্রায় ২৬ ঘণ্টা প্রেস ক্লাবে অবরুদ্ধ থাকলেও কোনো নেতা সেখানে যাননি। পরে তিনি প্রেস ক্লাব থেকে বের হওয়ার পথে গ্রেফতার হন। এ ছাড়া খালেদা জিয়ার গাড়ি ও তার গাড়িবহরে পর পর চারবার হামলার পরও মহানগর বিএনপির ‘নীরবতা’য় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এ কমিটির কার্যক্রম। এ ছাড়া সিটি নির্বাচনে নগর কমিটির ভূমিকা, সর্বশেষ শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজারের নকশা ভাংচুরের ঘটনায়ও নীরব ভূমিকায় রয়েছেন মহানগর বিএনপি নেতারা। আর কী কী করা হলে রাজপথে নামবে মহানগর কমিটি— এমন প্রশ্ন দলটির কর্মী-সমর্থকদের।
নেতাকর্মীদের দাবি, চলতি বছরে ৬ জানুয়ারি থেকে সারাদেশে টানা অবরোধ শুরু হওয়ার পর মহানগর নেতাদের মাঠে দেখা যায়নি। যদিও দলের জ্যেষ্ঠ নেতারাও মাঠে ছিলেন না। মহানগর আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস ও সদস্য সচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে অবরোধের আগের দিন ৫ জানুয়ারি কিছুক্ষণের জন্য রাজপথে দেখা গেলেও এরপর থেকে তারা আর সামনে আসতে পারেননি।
ঢাকা মহানগর উত্তর ২৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি হাজী মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘সঠিক নেতৃত্বের অভাবে রাজপথের আন্দোলনে আমরা ঢাকা মহানগরীতে কোনো ধরনের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারিনি। সিনিয়র নেতারা রাস্তার বের হন না। তারা পালিয়ে থাকেন।’
মহানগর কমিটিতে সাংগঠনিক দু্র্বলতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আগেই বলেছিলাম নতুন প্রজন্মের কাউকে নেতৃ্ত্ব দেওয়ার জন্য। পুরনোদের দিয়ে আন্দোলন হবে না। যারা জেলকে বাড়ি মনে করতে পারে তাদেরকেই নেতৃত্ব দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘জেলের ভয়ে রাজপথে নামতে পারেনি অনেক নেতাই। তাদের সাহসের অভাব। আসলে বলা কিছু নেই, আমাদের দলে কর্মীর চেয়ে নেতা বেশি হয়ে গেছে। যে কারণে আন্দোলনে নেতাদের পাওয়া যায় না।’
ঢাকা মহানগর ছাত্রদলের রাজনীতিতে জড়িত হিমেল হক। তিনি বলেন, ‘১০ বছর ধরে আমি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এখন পর্যন্ত কোনো ভাল পদে যেতে পারলাম না। নেতারা রাস্তায় না নামলে কর্মীরা কার ভরসায় নামবেন। গত ৫ জানুয়ারির আগেই ম্যাডামকে কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করা হলেও তেমন কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি সঠিক নেতৃত্বের অভাবে। এভাবে একটি দল চলতে পারে না।’
মির্জা আব্বাসকে আহ্বায়ক ও হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে সদস্য সচিব করে গত ১৮ জুলাই ২০১৪ সালে ঢাকা মহানগর বিএনপির নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। তাদের এক মাসের মধ্যে সকল ওয়ার্ড ও থানা কমিটি এবং দুই মাসের মধ্যে মহানগর পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। কিন্তু নির্দিষ্ট ওই সময়ের মধ্যে তারা নতুন কমিটি গঠনে ব্যর্থ হন। এর মধ্যে প্রায় ১০ মাস অতিক্রম হতে যাচ্ছে। এখনো মহানগর বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি আলোর মুখ দেখেনি।
ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম-আহ্বায়ক আবু সাঈদ খান খোকন বলেন, ‘ঢাকা মহানগর কমিটি পুনর্গঠন সম্পর্কে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে পুনর্গঠন তো করতেই হবে।’
রাজপথ আন্দোলনে ঢাকা মহানগর কমিটি ভূমিকা সম্পর্ক তিনি বলেন, ‘আমরা তো সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারি না। গুলি করলে পাল্টা গুলি করতে পারি না। বিএনপি এ ধরনের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না।’
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক মামলা, গাড়ি পোড়ানো ও নাশকতার দুই মামলাসহ বেশ কয়েকটি মামলা থাকায় মির্জা আব্বাস প্রকাশ্যে আসতে পারছেন না। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের মেয়র প্রার্থী হয়েও প্রচারণায় নামতে পারেননি তিনি। এদিকে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও ঢাকা মহানগর কমিটির সাবেক আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকা বর্তমানে আমেরিকায় অবস্থান করছেন। গত বছর ২৮ মে তিনি চিকিৎসার জন্য আমেরিকা যান।