মানব পাচারকারীদের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে অসংখ্য মানুষ
ভাল চাকরি-ভাল বেতন জীবনের স্বপ্ন সাধ পূরণের অনন্ত বাসনা কার না আছে। এই চাওয়াকে পূরণ করতে জীবন-মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে সাগর পথে অনিশ্চিত যাত্রা। কপালে ভাল চাকরি আর ভাল বেতন মিলবে কিনা তার হিসাব মেলানোর আগেই অনেকেই ডুবে যাচ্ছে সাগরের গভীর অতলে আর কেউ কেউ মরছে থাইল্যান্ডের গহীন অরণ্যে। আবার অনেকে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। নির্যাতন করে কৌশলে লাখ লাখ টাকা আদায় করছে পাচারকারীরা। পাচারকারীদের প্রলোভনে সেই স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ায় যাওয়ার রুটটি সাগর পাড়ি দিয়ে থাইল্যান্ডের গভীর বনভূমি। এখান থেকে সীমানা পার হয়ে মালয়েশিয়া।
তবে বেশির ভাগেরই ভাগ্যে মালয়েশিয়া পৌঁছানো হয় না। যারা পৌঁছতে পারেন তাদেরও থাকে আটকের ভয়। এক পর্যায়ে তারা আটক হয়ে মালয়েশিয়ার কারাগারে স্থান পান। এমন এক ভয়ঙ্কর পথ পার হয়ে ভাল চাকরি-ভাল বেতন আর তাদের কপালে জোটে না। এই নিষ্ঠুরতার সঙ্গে রয়েছে কক্সবাজার টেকনাফের প্রভাবশালী গোষ্ঠী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যের যোগসূত্র। পাচার বাণিজ্যের একটি অংশ তাদের হাতেও যাচ্ছে।
সূত্র জানিয়েছে, সাগরপথে থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়া-গামীদের নিরাপদ রুট টেকনাফ। টেকনাফের ১০ পয়েন্ট দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মানবপাচার হচ্ছে। পাচারের এমন ঘটনা এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ১০ পয়েন্টের সবচেয়ে আলোচিত ঘাট হচ্ছে কাটাবুনিয়া। এই কাটাবুনিয়া ঘাটকে ‘মালয়েশিয়া এয়ারপোর্ট’ পরিচিতি পেয়েছে। এখান থেকেই থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার জীবন-মৃত্যুর ভিসা মিলছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন এই এয়ারপোর্ট থেকে নিয়মিত লাভবান হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। যখন লাভের পরিমাণ কমে যায় তখনই কিছু পাচার হতে যাওয়া লোকজনকে আটক করে থাকে। তবে এই আটকের মধ্যে পাচারকারীরা নেই। টেকনাফ-উখিয়া-কক্সবাজারের আরও নয়টি ঘাট দিয়ে প্রতিনিয়ত মানবপাচার হচ্ছে।
পাচারের সঙ্গে সরাসরি জড়িত রয়েছে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার পাচারকারী চক্রের সঙ্গে বাংলাদেশের ২০টি চক্র। ট্রলারে সাগর পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে থাইল্যান্ড উপকূলে পৌঁছার পর তাদের ঠিকানা হয় পাচারকারীদের বন্দীশালায়। থাইল্যান্ড উপকূলের পাহাড়-জঙ্গলে একাধিক বন্দীশালা তৈরি করে রেখেছে সেখানকার স্থানীয় পাচারকারী চক্র। এরপর তাদের ওপর শুরু হয় অর্থ আদায়ে অবর্ণনীয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।
এরপর পাচারকারীরা সেখান থেকে মোবাইল ফোনে বাংলাদেশে তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ওই সময় ফোনে নির্যাতিতদের চিৎকারও শোনানো হয়। পাশাপাশি মালয়েশিয়া পৌঁছানো বাবদ দেড় থেকে দুই লাখ টাকা টেকনাফ-কক্সবাজারের অবস্থানরত দালালদের হাতে পৌঁছানোর অনুরোধ জানানো হয়। পরিবারের সদস্যরা নিরুপায় হয়ে তখন দালালদের হাতে তুলে দেয় নির্ধারিত টাকা। এরপর তাদের থাইল্যান্ড সীমান্ত অতিক্রম করে হাঁটা পথে পৌঁছানো হয় মালয়েশিয়ায়। সেখানে তাদের গ্রহণ করে দালাল সিন্ডিকেটের অপর একটি গ্রুপ। অবৈধ পথে প্রবেশ করা এমন কয়েক হাজার মালয়েশিয়াগামী নিরীহ মানুষ সেখানকার কারাগারে বন্দী জীবন কাটাচ্ছে। মালয়েশিয়ার গহীন জঙ্গলে অনাহারে-অর্ধাহারে রয়েছেন বিপুলসংখ্যক স্বপ্নবিলাসী মানুষ।
শনিবার থাইল্যান্ডের জঙ্গলে গণকবর পাওয়া গেছে। একজন বাংলাদেশী নাগরিককে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। অন্যদিকে স্বপ্নের মালয়েশিয়া গিয়ে গত পাঁচ বছরে সাগরে সলিল সমাধি অথবা নিখোঁজ হয়েছেন এক হাজারের বেশি মানুষ। টেকনাফের লেদা আন- রেজিস্টার্ড রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় এখনও নিখোঁজ রয়েছেন পাঁচ শ’র বেশি বাংলাদেশী নাগরিক। বিভিন্ন সময় মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড থেকে ফেরত আসা বেশ কয়েকজন নাগরিক এমন কথা জানিয়েছেন।
সূত্র জানিয়েছে, কক্সবাজার থেকে ট্রলারে করে স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ায় যাত্রা নতুন কোন ঘটনা নয়। বছরের পর বছর ধরে এমন ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাড়ি জমাচ্ছে দেশের মানুষ। উত্তাল সাগর পথে বাহন ট্রলার কিংবা কার্গো বোট। পৌঁছতে সময় লাগে ৮ থেকে ১০ দিন। ওই সময়টা কোনোভাবে খেয়ে না খেয়ে পার করে পৌঁছে যায় থাইল্যান্ড উপকূলে। এরপর হয় অন্য রকম জীবনের যাত্রা। নিজের জীবনকে এক অনিশ্চয়তার হাতে তুলে দিয়ে এভাবেই অবৈধভাবে সাগর পথে পাড়ি জমাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ।
এক বুক স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি দেয়া সাগর পথের এই সব যাত্রীদের অনেকেই সলিল সমাধি বরণ করেন। না হয় তাদের ঠাঁই হয় বাংলাদেশী বা ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়ে কারাগারে। আর এসব মানব পাচারের কাজে জড়িত মূল হোতারা বরাবরই থেকে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। রাজনৈতিক ছত্রছায়া, স্থানীয় প্রভাব আর পুলিশ প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর চলছে সাগর পথে মানবপাচার। টেকনাফ-উখিয়া রুটে মানবপাচারে জড়িত রয়েছে ২০ সিন্ডিকেট। এই চক্রের সহযোগী রয়েছে আরও শতাধিক উপ চক্র। তাদের দালাল বলা হয়।
বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা তথ্যে জানা গেছে, শুধু মালয়েশিয়া নয়, থাইল্যান্ড কিংবা ইন্দোনেশিয়া যাত্রা। দালালদের খপ্পরে পড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিশ্বের অনেক দেশেই বাংলাদেশের নাগরিকরা যাচ্ছেন। ভাল উপার্জনের আশায় এসব লোকজন বিক্রি করে দিচ্ছেন ঘরবাড়ি, জমিজমা। টাকা তুলে দিচ্ছেন দালালদের হাতে। আর এই কাজটি করতে গিয়ে গরিব, দিনমজুর, মধ্যবিত্ত মানুষেরা মোকাবিলা করছেন সাগরের উত্তাল ঢেউ, প্রবল বৃষ্টি। ভয়ঙ্কর প্রাণী। ধরাও পড়ছে কোস্টগার্ডের-নৌবাহিনীর হাতে। জেল খাটছেন। অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। পথে পথে ঘুমাচ্ছেন। না খেয়ে পার করছেন দিন। আর যারা অর্ধাহারে-অনাহারে ওইসব দেশে পৌঁছেন তাদেরও শান্তি নেই। স্বল্প খরচে বিদেশ পাড়ি দিয়ে এসব লোকজনকে করতে হয় মানবেতর জীবনযাপন। হাজারো স্বপ্ন নিয়ে দালালদের হাতে সব কিছু তুলে দিয়ে মালয়েশিয়া যেতে গিয়ে তাদের স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে।
রাজনৈতিক ছত্রছায়া, স্থানীয় প্রভাব আর পুলিশকে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর চলছে বিদেশে লোক পাঠানোর নামে এই মানবপাচার। শ’শ’ কোটি টাকার অবৈধ পাচার বাণিজ্যের টাকার একটি অংশ বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের হাতেও যাচ্ছে। টেকনাফ ও কক্সবাজারের নাজিরারটেক, কস্তুরা ঘাট, উখিয়ার মনখালী, সোনারপাড়া, টেকনাফের শামলাপুর, শীলখালী, জাহাজপুরা, টেকনাফ সদর, শাহপরীর দ্বীপ ঘোলা পাড়া, পশ্চিম পাড়া, দক্ষিণ পাড়া, জেটিঘাট, কাটাবুনিয়া, মিঠা পানির ছড়া, রাজার ছড়াসহ বিভিন্ন উপকূল ঘাট থেকে মানব পাচার করা হচ্ছে। এই জায়গাগুলো পাচারের জন্য যে ব্যবহার হয় তা প্রশাসনের জানা।
মানব পাচার নিয়ে কাজ করেন এমন কয়েকটি সংগঠনের কর্মকর্তারা বলেন, চাকরির নামে পাচার ও অবৈধ অভিবাসন নিয়ে মানুষের ধারণা স্পষ্ট না হওয়ার কারণে সীমান্তবর্তী এলাকায় ভিকটিমরা উদ্ধার হলেও পুলিশ পাচারের মামলা রুজু না করে পাসপোর্ট আইনে মামলা করে। মানব পাচার প্রতিরোধে সচেতনতার পাশাপাশি সমস্যার স্থায়ী সমাধানে সময়োপযোগী ও সার্বজনীন আইন প্রণয়ন করা জরুরী। তাদের অভিযোগ, প্রতিটি জেলায় পাচারের মামলা মনিটরিং সংক্রান্ত কমিটি থাকলেও এর বেশিরভাগের কোন কার্যক্রম নেই। এ ছাড়া দায়েরকৃত মামলার ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ে তদন্ত রিপোর্ট প্রদান না করা, আদালতের স্বল্পতা ও দীর্ঘসূত্রতা, ভিকটিম ও সাক্ষীর নিরাপত্তা নিশ্চিতের ব্যবস্থা না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে পাচারের মামলাগুলোর বিচারপ্রাপ্তি ক্রমেই অনিশ্চিয়তার মুখে পড়ছে। বাংলাদেশে মানুষের নাজুক আর্থসামাজিক অবস্থা, নিরাপত্তার অভাব, সমাজে বিদ্যমান নারী-পুরুষের অসমতা, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারসহ নানা অসংগতি মানব পাচার প্রতিরোধের কাজকে বাধাগ্রস্ত করছে। পাচার রোধে অপরাধীর শাস্তির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা সৃষ্টি করে চলছে প্রচলিত আইনে পাচারের সংজ্ঞা স্পষ্ট না হওয়ার বিষয়টি।
এদিকে, থাইল্যান্ডে মালয়েশিয়া সীমান্তবর্তী জঙ্গলে উদ্ধার ব্যক্তি আসলে বাংলাদেশী কি না, তা যাচাই করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। রবিবার মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ব্যাংককে বাংলাদেশী দূতাবাস ইতোমধ্যে থাই কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তার সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা করার অনুরোধও জানানো হয়েছে। এক্ষেত্রে থাইল্যান্ডের কর্তৃপক্ষ সব ধরনের সহায়তা দিতে রাজি হয়েছে।
গত শুক্রবার থাইল্যান্ড পুলিশ ওই জঙ্গলে অন্তত ৩০টি কবরের সন্ধান পায়। ধারণা করা হচ্ছে, ওইগুলো রোহিঙ্গাদের, তারা মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে যেতে চেয়েছিল। ওই জঙ্গল থেকে জীবিত এক ব্যক্তিকে উদ্ধার করে পুলিশ। আনুজার নামে ওই ব্যক্তি বাংলাদেশী বলে থাইল্যান্ডের অনলাইন পোর্টাল ‘ফুকেট ওয়ান’ জানিয়েছে। এই খবর বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে আসার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে খোঁজখবর নেয়া শুরু হয়।
সৌজন্যে: জনকণ্ঠ