স্বপ্ন-রঙিন টেস্ট ম্যাচের পূর্বাভাস
খুলনায় মরা ম্যাচেও প্রাণের উত্তাপ। রেকর্ডের ফুলঝুরি। ড্র-র সফল কাব্যনামা। ক্রিকেটের রোজনামচায় জয়জয় আমেজ। হাতে এক। তখন আবার স্বপ্ন দেখা শুরু। ঢাকার বুকে টেস্ট জয় জয় হৃদস্পন্দন মুখরিত। পাশে থাকছে ‘সব ভালো যার শেষ ভাল তার’-এর চিরায়ত বাণী। সেখানেও উদ্যাপন-প্রেরণা খুঁজছেন মুশফিক-তামিম-সাকিবরা। বুধবার ফের শুরু ৫ দিনের টেস্ট; সিরিজের শেষ ম্যাচ। সেখানে কঠিন হলেও স্বপ্ন-রঙিন টেস্ট ম্যাচের পূর্বাভাষ দেখেছেন কোটি কোটি ক্রিকেটপ্রাণ ভক্তরা।
শেষ ম্যাচ। বাঁচা-মরার মাঝামাঝি কোনো জায়গা আর পড়ে নেই! কারণ, এই ম্যাচে পাকিস্তান মরিয়া হয়ে উঠবে জয় পেতে। নিদেনপক্ষে সিরিজে একটি জয়ের মুখ দেখতে। থাকবে আক্রমণাত্মকও। সে কারণে বাংলাদেশের ‘ড্র’ ভেবে ম্যাচ খেললেই মহাবিপদ। ১০ নাম্বার বিপদ সঙ্কেত। বরং ঢাকা টেস্টেও ক্রিকেটপাগল বাঙালিরা দেখতে চাইবে খুলনার দ্বিতীয় ইনিংসের বাংলাদেশকে; চাইবে তেমন তামিম-ইমরুল-সৌম্য-মুশফিক-তাইজুলদের।
বুধবার শুরু সিরিজের শেষ টেস্ট ম্যাচ। এই ম্যাচ নিয়ে আগাম কিছু বলা কঠিন হলেও পাকিস্তানের ধার-ভারে বাংলাদেশ আর নুয়ে পড়ার মতো দল নয়। ৫ দিনের ম্যাচ। তারপরও দর্শক কমতি থাকবে না। ক্রিকেটভক্তদের খামতিতে পাকিস্তানের তেতে ওঠার যথেষ্ট কারণ থাকতে পারে। কারণ, টেস্ট ব্যাকরণসিদ্ধ রানের ফুলঝুরিতে-স্ট্যাম্প উপড়ে ফেলার পর গ্যালারির হাজারী গর্জন আছড়ে পড়বে মিরপুরে। সেখান থেকে শহরের অলিতে গলিতে; তা উত্তাল হয়ে সারা দেশে৷ তখন কিন্তু পাকিস্তান চুপসে যেতেও পারে।
চলতি সিরিজে বাংলাদেশে দুমড়ে মুচড়ে পড়েছে পাকিস্তান। জয়ের নাগালে থাকা প্রথম টেস্টে বাংলাদেশের বাজি মারা নিশ্চিত করেছে টিম বাংলাদেশ অধ্যায়ের। বাংলাদেশের আর পিছিয়ে যাওয়া নয়; এবার সামনে যাওয়ার পালা। সফরে একটি জয়ের জন্য হাঁসফাঁস করছে পাকিস্তান। আবার কঠিন হলেও মুশফিক-তামিম-সাকিবরা জয়ে শুরু সিরিজের শেষ জয়সরণি আর অত অনিশ্চিত মানছেন না৷ পাকিস্তানের বিপক্ষে সাড়ে চৌদ্দ বছরের মাথায় এসে জয়ে সুরভিত সিরিজের শেষ টেস্টেও অনুকূল পরিবেশ আলো ঝলমল করছে। ছন্দে থাকা রুবেলের চোট পাওয়াটা সাময়িক হয়তো দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের। তবে তার বদলি হিসেবে আবুল কিংবা অভিসিক্ত শহীদেও ঘটনার ঘনঘটা বাকি। বাকি এই মাঠের সেরা সাকিবের ঋণ পরিশোধের চিত্রনাট্য। আর প্রথম টেস্টে যেভাবে ব্যাটিং করেছেন সাকিব; মনে হচ্ছে, ক্ষণ গণণা করছেন ভাল কিছুর করে দেখানোর। অধিনায়ক মুশফিকও সাকিবে বাজি ধরেছেন।
গোটা টিমটাই গত সাত-আট মাস ধরে নিম্নপর্যায় থেকে উচ্চপর্যাপে রূপান্তরের রূপকথা এঁকে এখন টিম বাংলাদেশের সামিল। বিশ্বকাপ তো বটেই দেশের মাটিতে পাকিস্তানকে বিস্ময়কর গোলকধাঁধায় ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশ। সবগুলো ম্যাচ থেকেই পাকিস্তান পুরোপরি ডাগআউটে। তাদের অবস্থা ত্রাহিমধূসুদন। সেই কারণে সফরের শেষ অনুশীলনের পরও মিসবাহ সাহসী উচ্চারণে বাংলাদেশকে ভরকে দেওয়ার মতো কোনো কথা বলেননি। বরং নিজেদের গোলা-বারুদের প্রযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহারের কথা বলেছেন। যদি তা সম্ভব হয়; তবেই স্বস্তি মিলবে।
খুলনা টেস্টে ড্রই পাকিস্তানীদের বেশি আহত করেছে। উদ্দীপনা-উৎসাহে ভাটার টান পড়েছে। রঙ বদলের খুলনা টেস্টে পাকিস্তান নানা হিসেব-সমীকরণের কথা বলেছে টেস্টের ৫দিনই। কিন্তু ফুল ফুটেছে বাংলাদেশের আঙিনায়। ফলে এক ফ্ল্যাট উইকেটের তকমা ছাড়া খুলনায় তারা কথা বলার কিছুই খুঁজে পাননি। খুলনায় খুবই মর্মাহত হয়েছেন মিসবাহরা জয়ের সুবাতাসময় ডেরায় বাংলাদেশের তামিম-ইমরুলের দুর্দান্ত সাইক্লোন দেখে; জয়ের সাজানো বাগান ওই দুইয়ের ব্যাটিংশৈলীতে তছনছ দেখে। আসলে ঢাকায় অপদস্ত-পর্যুদস্ত হওয়ার পর খুলনাকে স্বস্তির ভূখণ্ড ভেবে নিয়েছিল পাকিস্তান। তৃতীয় দিন পর্যন্ত পাকিস্তান চালকের আসনে। চড়েছে রানপাহাড়ে; যেখান থেকে ড্র সত্যিই কঠিন; রীতিমতো বীরোচিত। সঙ্গে বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে অল্পে বেধে ফেলা পাকিস্তানের হাতে ছিল সেই গোলা-বারুদে পেস আর স্পিন চক্রব্যূহ সৃষ্টির অফুরন্ত মশলা। কিন্তু সবাইকে বেধড়ক পিটিয়ে থেতিয়ে ভোঁতা বানিয়েছেন তামিম-ইমরুল। এক কথায় এই দুইয়ের অভূতপূর্ব বিশ্বরেকর্ডময় ব্যাটিং মহাকাব্যে স্রেফ ধ্বংস হয়ে গেছেন জুনায়েদ-গুল-ইয়াসির-বাবররা।
ছোট ভার্সান আসল কিছু নয়। টেস্টই আসল। সেখানেও বাংলাদেশের ক্রিকেট প্রতিশোধের ঔদ্ধত্যে উবুজুবু পাকিস্তান অহমের প্রতিরোধ। কারণ, শেষ হওয়া সিরিজে ৫ ম্যাচের মধ্যে এক টেস্টের প্রথম ৩ দিন ছাড়া সব দিনই বাংলাদেশের। ফলে আক্ষেপ-বন্যায় মিসবাহ-হাফিজরা এখন অনেকেটা ভেসে যাওয়া খড়কুটার মতো। গলা অবদি পানিতে খাবি খাওয়া পাকিস্তানীরা সম্মান বাঁচানোর শেষ আশ্রয় জাপটে ধরতে চাইবে ঢাকায়। হয়তো সেই আশায়ও গুঁড়েবালি দেখতে হতে পারে সফরকারীদের। কারণ, খুলনা ‘বিজয়ের’ পর ঢাকায়ও নিশ্চিত লো, স্লো উইকেট। চোখ বুজেই বলা যায় মিরপুরে বড়জোর স্পিন-ফাঁসের পাশে ব্যাটিং-স্বর্গ থাকছেই। যাতে মারার বলটি দমবন্ধ করে মারার চাবিকাঠি ব্যাটারদের হাতেই অস্ত্র হিসেবে থাকে। ফলে খুলনার চেয়ে ঢাকা বেশি রানের টেস্টে পরিণত হলেও আশ্চর্যের কিছুই থাকবে না।
পাকিস্তানের তুলনায় অভিজ্ঞ টেস্ট ক্রিকেটার কম হলেও বাংলাদেশের নতুনদের উত্থানে ওদের শক্তিশালী নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ-ছত্রখান। এই দৃশ্য ওয়ানডে-টোয়েন্টি২০’র পর টেস্টেও। পাকিস্তান ব্যাটে-বলে-ফিল্ডে সবখানেই চিৎপাত। প্রথম টেস্টে তৃতীয় দিন অবদি পাকিস্তানের তাণ্ডবে হার দেখে বীরদর্পে লড়াই করেছে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের ভয়কে অভয়ারণ্য বানিয়ে ফেলেছেন তামিম-ইমরুল-সাকিব-মুশফিক-সৌম্য-তাইজুলরা। ফলে টেস্ট ক্রিকেটেও প্রাণের তাপ-উত্তাপ-সঞ্চার ঘটেছে। খুলানায় বাংলাদশকে নতুন উচ্চতায় তুলতে তামিম-ইমরুল নিজের দিনে সুদে-আসলে দলের প্রতিদান চুকোনোর চেষ্টা করেছেন। এবার ঢাকায় কিন্তু মুশফিক-সাকিব-সৌম্যদের পালা। বাংলাদেশের ব্যাটে-বলের কুহেলিকা ও চার ছক্কা-উইকেটপ্রাপ্তির প্রহেলিকায় হত-বিহ্বল পাকিস্তানকে ঢাকায়ও গুড়িয়ে দিতে হবে। বাংলাদেশের কাছে নাকাল হয়ে পাকিস্তানের ক্রিকেট বিশ্বাসযোগ্যতাটাই বড্ড ঘা খেয়েছে। বাংলাদেশের ব্যাট-প্যাচে তারা রীতিমতো ক্ষত-বিক্ষত। ক্রমেই দলের ভেতরে নানা টানাপড়েন উগড়ে পড়ছে। সেই সুযোগের শতভাগ কাজে লাগাতে হবে।
প্রতিশোধস্পৃহা জেগে উঠেছে বারবার। কিন্তু সেই প্রতিশোধ এসেছে ষোলো বছর বাদে। ক্রিকেটের আদিখ্যেতা দেখিয়ে নয়; বরং পেশাদারী মনোভাবে সফলায়ন ঘটেছে চলতি সিরিজে। যেখানে পাকিস্তানী কথার গিমিকবাজিকে বাংলাদেশ ওয়াক-ওভার দিয়ে; প্রথম থেকেই সর্তক উচ্চারণে মিডিয়ার মন ভরিয়েছে। যেমন ওয়ানডে সিরিজে উড়ে যাওয়ার পর টোয়েন্টি২০-এ আফ্রিদি-গুল জুজু ছড়ানো হয়েছিল। পরে টেস্টে মিসবাহ-ইউনিস বাজি। কিন্তু বাংলাদেশের পাল্টে যাওয়া ক্রিকেট কারোর ধার ধারেনি। তার আপন গতিতে স্বপ্রভিত থেকেছে। বিশ্বকাপের উর্ধ্বমূখীন পারফরমেন্সে একটু ভাটা পড়েনি দেশের মাটিতে। বরং আরো পালিশ-ক্ষুরোধার হয়েছেন বাংলাদেশী ক্রিকেটাররা।