আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কোন পথে >>> আব্দুল কাইয়ুম
ঢাকা ও চট্টগ্রামে তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর দুটি ঘটনা বিস্ময়কর মনে হয়েছে। আওয়ামী লীগ-সমর্থিত বিজয়ী প্রার্থীরা ঢাকঢোল বাজিয়ে কোনো বিজয় মিছিল বের করেননি। অন্যদিকে বিএনপিও দুপুর ১২টা না বাজতেই তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার বারোটা বাজিয়ে চুপচাপ ঘরে ফিরে গেছে, কোনো হরতাল বা প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করেনি। সাম্প্রতিক রাজনীতির উত্তাপের সঙ্গে এ দুটি ঘটনার কোনোটিই খাপ খায় না। এক পক্ষ যে বিজয় মিছিলের নামে হইহুল্লোড় শুরু করেনি আর অন্য পক্ষ যে লাগাতার অবরোধ-হরতাল ডেকে বসেনি, সেটা ভালোই হয়েছে। নাগরিকেরা স্বস্তি পেয়েছে, সন্দেহ নেই।
কিন্তু এ রকম তো হওয়ার কথা নয়। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দল এভাবে ঢিলে মেরে দিতে পারে, তা কেউ ভাবেনি। যাক, নির্বাচন ও ফলাফল নিয়ে যে দেশে একটা মারামারি-কাটাকাটি শুরু হয়ে যায়নি, সেটাই ভাগ্যের কথা। দুই দলেরই কি সুমতি হলো নাকি?
আওয়ামী লীগ কি বুঝেশুনেই চুপ মেরে গেল? তাদের জেতা যে জেতা নয়, ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অভিযোগগুলো যে এক কথায় উড়িয়ে দেওয়া সহজ নয়, এসব সাত-পাঁচ ভেবেই কি তারা আর বিজয় উৎসবের দিকে যায়নি? এ রকম আত্মোপলব্ধি হয়ে থাকলে সেটা তো সহজ কথা নয়।
অন্যদিকে খালেদা জিয়ার প্রচার শোভাযাত্রায় হামলা, ইটপাটকেল ছোড়া ও গাড়ি ভাঙচুরের প্রতিবাদে বিএনপি যেখানে নির্বাচনের মাত্র পাঁচ দিন আগেও ঢাকা ও চট্টগ্রাম বাদে সারা দেশে হরতাল ডাকল, তারা নির্বাচনে এত কিছুর পরও একদম চুপ থাকল কীভাবে? অভিযোগগুলো তো গুরুতর। কেন্দ্র দখল করে জাল ভোট, বিএনপির পোলিং এজেন্টদের মারধর করে তাড়িয়ে দেওয়া এবং ব্যাপক পুলিশি নির্যাতন, মামলা ও গ্রেপ্তারের ভয়ভীতি দেখানো থেকে শুরু করে কোনো কিছুই তো বাদ ছিল না। এর পরও তাৎক্ষণিক কোনো কর্মসূচি না দেওয়ার মাহাত্ম্য বোঝা কঠিন। একমাত্র কারণ হতে পারে তাদের সংগঠনের ভাঙাচোরা অবস্থা সম্পর্কে আত্মোপলব্ধি। এটাই বা কম কী!
নির্বাচনের আগে থেকেই একটা কথা শোনা যাচ্ছিল যে তিন সিটি করপোরেশনেই বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীরা জিতে যাবেন। এ রকম একটা আশঙ্কার কথা নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের কানেও উঠেছে। ধারণা ঠিক না বেঠিক, সেই হিসাব-নিকাশের সময় কোথায়? তাই দেখা গেল, পুলিশ তৎপর হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন এলাকায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের ভয়ভীতি, মামলায় জড়ানো ও গ্রেপ্তারের হুমকির অভিযোগ উঠল। এমনিতেই বহু বছর ধরে বিএনপির লোকজন এলাকাছাড়া। নির্বাচনের ডামাডোলে নতুন করে হুমকি-ধমকি শুরু হলে বাদবাকি যে কয়জন ছিলেন, তাঁরাও গা ঢাকা দিলেন। এতে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে প্রচার চালানো আরও বেশি দুঃসাধ্য হয়ে উঠল।
আওয়ামী লীগ এটাই চাইছিল। বিএনপি যদি মাঠে না থাকে, তাহলে মানুষ ভোট দেবে কাকে? এরপর যখন দুপুর না হতেই বিএনপি রণে ভঙ্গ দিল, তখন কে কোথায় সিল মারল, সেটা গৌণ বিষয়ে পরিণত হলো। কোনো কোনো কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীর বিরুদ্ধে শক্তিশালী বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে কিছু মারপিট হয়েছে। এমনকি পুলিশকেও টিয়ার গ্যাস মারতে হয়েছে। কোথাও সাময়িকভাবে ভোট বন্ধ রাখা হয়েছে। কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোট গণনা হলো বটে, কিন্তু প্রতিপক্ষ প্রার্থীর এজেন্ট তো নেই। ভোটের হিসাব বুঝে নেবে কে?
এসব ব্যাপার মানুষও জানে, আওয়ামী লীগও জানে। এ রকম নির্বাচনে বিজয়ের ঢাক পেটাতে যাওয়া যে হাস্যকর হবে, সেটা বুঝতে পারার মতো মেধার অভাব আওয়ামী লীগের মধ্যে নিশ্চয়ই নেই। ফলে বিজয়ী মেয়ররা বিভিন্ন চ্যানেলে সহাস্যবদনে হাত নেড়ে সবাইকে ‘শুভেচ্ছা’ জানিয়েই ক্ষান্তি দিলেন।
অবশ্য আওয়ামী লীগ বলতে পারে, তারা ২০০৮ সালে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেও বিজয় মিছিল বের করেনি। সুতরাং ঢাকঢোল পেটানোর সংস্কৃতি থেকে তারা আগেই বেরিয়ে এসেছে বলে দাবি করলে কথাটা অসত্য হবে না। কিন্তু এটা তো শুধু মেয়র নির্বাচন ছিল না। ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচনও ছিল। আগে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে বিজয়ী কাউন্সিলরদের জাঁকজমক করে বিজয় মিছিল করতে দেখা গেছে। এবার সেটাও ফাঁকা। হয়তো তাঁরাও হাওয়া বুঝে চলতে শিখে গেছেন। এ নির্বাচনে জেতাটা যে জেতার পর্যায়ে দেখতে মানুষ রাজি ছিল না, সেটা তাঁরা ধরতে পেরেছেন। এটা কম উন্নতি নয়।
অন্যদিকে বিএনপির অবস্থা তো আরও খারাপ। তারা নির্বাচন শুরু হতে না হতেই প্রথমে চট্টগ্রামে এবং এর কিছু পরে ঢাকায় নির্বাচন ত্যাগ করে। টিভিতে প্রার্থী প্রত্যাহারের ঘোষণা শুনে তো সবাই অবাক। কারণ দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া নির্বাচনী কেন্দ্রগুলো ছিল শান্ত। মারদাঙ্গা পরিস্থিতি তেমন চোখে পড়েনি। বিএনপির নির্বাচন ত্যাগ অনেকের কাছেই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো শোনায়।
বিএনপির একটি বড় অভিযোগ ছিল, বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে তাদের এজেন্টদের মারপিট করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মানুষ দেখছে মারপিট তো দূরের কথা, বেশির ভাগ কেন্দ্রে বিএনপির লোকই নেই, কেন্দ্রের বাইরে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে টেবিল নিয়ে কেউ বসেনি। যেখানে বিএনপির কর্মীই যাননি, সেখানে ঘাড় ধরে বের করবে কাকে? এ তো হাস্যকর কথা। অনেকে বলেছেন, এজেন্টদের খরচাপাতির জন্য বেশ টাকা দেওয়া হলেও তাঁরা কেন্দ্রে দায়িত্ব পালনের জন্য যাননি। প্রায় ৯০ শতাংশ কেন্দ্র যে বিএনপিশূন্য ছিল, তা তো গোপন বিষয় নয়।
বিএনপি বলতে পারে, পুলিশের ভয়ভীতির মধ্যে কর্মীরা কোন সাহসে যাবেন কেন্দ্রে? এ তো পরের কথা। যেখানে তাঁরা কেন্দ্রে যানইনি, সেখানে তাঁদের ঘাড় ধরে বের করে দেওয়ার অভিযোগের ভিত্তি কোথায়? সুতরাং বিএনপি বুঝেশুনেই চুপ মেরে গেছে। যেখানে আশা ছিল খালেদা জিয়া পথে নামলেই লাখে লাখে লোক নেমে পড়বে, সেটা না হওয়ায় বিএনপি নির্বাচনের আগে থেকেই কিছুটা হতাশ ছিল। তারই প্রতিফলন দেখা গেছে নির্বাচনের পরে।
বিএনপি মুখে কিছু না বললেও ভেতরে ভেতরে বাস্তব অবস্থা নিয়ে আলোচনা করছে। তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতার বিষয়ে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন তারা বেশি সচেতন। নির্বাচনের আগের মুহূর্তে হরতালে যখন সাড়া পাওয়া যায়নি, সেখানে আবার নির্বাচনে জোর-জবরদস্তির অভিযোগে হরতাল ডেকে যে কোনো লাভ নেই, এই বাস্তবতা তারা এত দিনে বুঝতে পেরেছে।
মনে রাখা দরকার, বিএনপি কিন্তু এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে অবরোধ প্রত্যাহার করেনি। এটা তাদের করা উচিত। সবকিছু স্বাভাবিক। কেউ অবরোধ মানে না। হরতাল মানে না। তাহলে ওই সব ডেকে লাভ কী? নির্বাচনের দিনে যখন দেখা গেল মাঠে কেউ নেই, তখন তারা টের পেল যে সংগঠন কতটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। এ অবস্থায় যে হরতাল ডাকা চলে না, সেই বুঝ তাদের হয়েছে। এ জন্য বিএনপি ধন্যবাদ পেতে পারে।
একটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার কিন্তু থেকেই গেল। বিএনপি প্রার্থী প্রত্যাহারের পরও দিন শেষে দেখা গেল তাদের সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থীরা প্রত্যেকেই কয়েক লাখ করে ভোট পেয়েছেন! এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে বলার চেষ্টা করা হয়েছে যে আওয়ামী লীগের কর্মীরা সিল মারার সময় কিছু সিল বিএনপির পক্ষেও মেরে দিয়েছে, ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য। এটা শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, এত নিখুঁত হিসাব করে যদি আওয়ামী লীগ নির্বাচন জালিয়াতি করে থাকতে পারে, তাহলে দেশ পরিচালনায় তো তাদের আরও ভালো করার কথা। সবখানে অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার অভিযোগ আর ভোটের সময় নিপুণভাবে ব্যালেন্স করে সিল মারার সুনাম!
যদি এটা কারসাজি না হয়, তাহলে বিএনপির প্রার্থীরা এত ভোট পেলেন কীভাবে? এ বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগ মহলেও প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই মনে করেন, যেখানে অবাধে ভোট দেওয়ার সুযোগ ছিল, সেখানে বিএনপির প্রার্থীদের পক্ষে ভোট পড়েছে বেশি।
এর তাৎপর্য এখন বিএনপি ও আওয়ামী লীগ—দুই দলকেই উপলব্ধি করতে হবে। বিএনপি যদি বোঝে যে কথায় কথায় হরতাল দিলে জনবিচ্ছিন্নতা ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না এবং আওয়ামী লীগ যদি বোঝে যে ভয়ভীতি ও পুলিশি নির্যাতন দিয়ে ভোট আনা যায় না, তাহলে হয়তো আগামী দিনের রাজনীতি একটি সুস্থ ধারায় আসতে পারে। আমরা সেই সম্ভাবনার জন্যই পথ চেয়ে রইব।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com