শুদ্ধি অভিযান: খালেদার কার্যালয় মুখে পদযাত্রা করবে নেতাকর্মীরা
বিএনপিতে শুদ্ধি অভিযান শুরুর দাবিতে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার হাতে লিখিত প্রস্তাবনা তুলে দিতে গুলশান কার্যালয় অভিমুখে পদযাত্রা করবেন দলের নেতাকর্মীরা। ছাত্রদলের সাবেক একাধিক নেতা কর্মসূচির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তবে তারা নাম প্রকাশ করতে চাননি।
আগামী ২৫ মে বিকেল ৩টায় এ পদযাত্রা কর্মসূচি হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
কর্মসূচি সফল করতে এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে পেজ খোলা হয়েছে। পেজটির https://www.facebook.com/events/796520577110510/ ঠিকানায় বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী লাইক দিচ্ছেন। কর্মসূচি শেয়ার করে অনেকেই প্রচারণা শুরু করেছেন।
কর্মসূচির উদ্দেশ্য সম্পর্কে উদ্যোক্তারা বলেছেন, ‘বিএনপিকে আরও শক্তিশালী করার ব্যাপারে দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের অনেক কথা আছে, যা তারা অন্য কারও কাছে বলতে পারেন না। সে বক্তব্যগুলো লিখিত আকারে আমরা নেত্রীর কাছে তুলে ধরব।’
গোলাম মর্তুজা নামে ছাত্রদলের এক কর্মী কর্মসূচি সম্পর্কে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘এটি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি। তাই জিয়ার সৈনিকদের বলি, আমরা আর দূরে থাকব না। দালাল আর চাটুকাররা শোন, তোদের বলছি। তোদের দিন শেষ। আমরা এসে গেছি। কোথায় কী করতে হবে, কীভাবে দল পুনর্গঠন করতে হবে, দলের মধ্যে কীভাবে, কী শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে, সব আমরা পয়েন্ট আকারে লিখে নোট করে আনছি। ম্যাডামকে বলছি, আপাতত আর কোনো কর্মসূচি নয়। সবার আগে নিজেরা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার-পরিছন্ন হয়ে নেই। তার পর সব হবে।’
গোলাম মর্তুজা শুক্রবার বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করেছেন।
বাড্ডা ছাত্রদল নেতা ইউসূফ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আর কিছুদিন এভাবে চললে বিএনপিকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো আর কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। আন্দোলন পরের কথা, দল হয়ে পড়বে নেতৃত্বশূন্য।’
তিনি বলেন, ‘বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কর্নেল অলি আহমদ ও নীরু ভাইদের মতো পরীক্ষিত নেতারা অনেকেই বাধ্যতামূলক অবসরে। দুদু ভাই, রিপন ভাই, বেনজির আহমেদ টিটো, নয়ন ভাই, সাঈদ টিটু ও মুন্না ভাইদের মতো জনপ্রিয় নেতারা চরম অবহেলিত। শহীদ বাবলু, ইলিয়াস, সালাহউদ্দিন ও পিন্টু ভাইদের মতো অদম্য সাহসী নেতারা পরপারে। ডেভিড, মামুন, চমক, মেহেদী, নিউটন ও সাগীর ভাইদের মতো নেতারা অনেক আগেই বিএনপির ভুল রাজনীতির স্বীকার হয়ে জীবন দিতে বাধ্য হয়েছেন। দলের অদম্য সাহসী ও ত্যাগী নেতাকর্মীদের মাঠের বাইরে বসিয়ে রেখে যে অসম্ভব ক্ষতি হয়েছে, তারই খেসারত আজ বিএনপিকে দিতে হচ্ছে।’
তিনি লিখেছেন, ‘বিএনপি দেশের সর্ববৃহৎ ও সর্বোচ্চ জনপ্রিয় দল। তাই ধ্বংস হওয়ার ভয় নেই। কিন্তু দলের ভেতরে লীগের বি টিম তৈরি ও স্বৈরাচারী সরকারের চক্রান্তে বিএনপিকে প্রতিবন্ধী সংগঠনে পরিণত করার কাজ অনেকটাই সফল। উপমহাদেশের এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের পথেই যাচ্ছে বিএনপি। বিএনপিকে রক্ষা করার সময় কম; কিন্তু সুযোগ এখনও আছে।’
বাড্ডা ছাত্রদলের নেতা ইউসূফও তাদের এ উদ্যোগের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
আবদুল্লাহ আল মামুন রনিক নামে একজন দলের হাইকমান্ডের কাছে দাবি জানিয়ে লিখেছেন, ‘ইউনিয়ন, ওয়ার্ড আর জেলার কমিটি ভোটের মাধ্যমে করুন। বেঈমানদের দল থেকে বের করে দিন। কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। আর মাঠের খেলোয়াড়দের খেলা দেখে সকল নির্বাচনে আসল খেলোয়াড়দের মনোনয়ন দিন। ক্লিনহার্ট করে যাদের মেরেছেন তাদের পরিবারগুলোর খবর নিন। সকল আন্দোলন-সংগ্রামে আহত, নিহত, কারাভোগী নেতাকর্মীদের সঠিক মুল্যায়ন করুন। তাহলে এক বছরও লাগবে না বাকশাল দূর করে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু দুঃখ এখানেই যে, বিএনপি এ সব কখনই করবে না। আর তাই আমাদের এ অবস্থা।’
কার নিয়ন্ত্রণে বিএনপি— প্রশ্ন করে এক উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ফেসবুকে বলেছেন, ‘অনেক চেষ্টা করে একদিন মাননীয় নেত্রীর গুলশান কার্যালয়ের দোতলা পর্যন্ত উঠতে পেরেছিলাম। কিন্তু ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দোতলায় ম্যাডামের রুমে প্রবেশের মুখে আমার পরিচয় পেয়ে নেত্রীর এক বেতনভুক্ত কর্মচারী একরকম ধাক্কা দিয়েই আমাকে বের করে দিলেন। শার্টের বুকপকেট থেকে আমার জেলা সভাপতির পাঠানো চিঠিটি নেত্রীকে দেখানোর সুযোগ পর্যন্ত পেলাম না। অনেক আশা নিয়ে এসে ফিরে যেতে বাধ্য হলাম।’
তিনি বলেন, ‘ছাত্রজীবন থেকে শহীদ জিয়ার রাজনীতি করি কিন্তু এরকম অমানবিক যন্ত্রণা কখনই পাইনি। লজ্জায় অপমানে চোখের কোণে জমতে থাকে নোনা অশ্রু। নীরবে শুধুই চোখের জল ফেলা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। অবুঝ মনকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাইনি। বার বার চোখের সামনে গুলশানের বড় বড় দালানগুলো ঝাপসা দেখাচ্ছিল। নিজেকে খুব ছোট মনে হয়েছিল সেদিন।’
তিনি লেখেন, ‘মাসের পরে মাস কারাগারের মেঝেতে বিনিদ্র রজনী কেটেছে। পুলিশের অত্যাচারে দিনের পর দিন সরকারি হাসপাতালের বারান্দায় পড়েছিলাম বিনা চিকিৎসায়। তবুও কখনই শহীদ জিয়ার রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হইনি। রাজনীতি আমার নেশা, শহীদ জিয়া আমার রক্তে, চাষাবাদ আমার পেশা। বাপের জমি বিক্রি করে মামলা চালাচ্ছি, হালের গরু বিক্রি করে জামিন হয়েছে, বাড়ি ফিরতে পারি না। আর আজ এ পেলাম পুরস্কার!!!
নেত্রী বেগম জিয়ার অফিস চিড়িয়াখানা নাকি যে, প্রবেশ করতে টিকিট লাগবে? কই জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে তো টিকিট লাগেনি।
মায়ের সঙ্গে সন্তানদের কেন এ ব্যবধান? কে তৈরি করেছে বিভেদের এ অসম দেয়াল?’
খালেদ চৌধুরী নামে অপরজন লিখেছেন, ‘আমাদের দাবি একটাই— দালালমুক্ত বিএনপি চাই। গুলশান অফিসের ভেতরে অনেকেই আছে যারা সরকারের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। তাই সব কর্মচারী-কর্মকর্তাদের ছাঁটাই করা হোক। রাজপথে সক্রিয় ও ত্যাগী নেতাদের দিয়ে কমিটি করা হোক। নীরু ভাইদের মতো নেতাদের দলে ফিরিয়ে এনে নতুন করে দলকে সংগঠিত করা হোক। ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, শ্রমিক দলের কমিটি ভেঙে রাজপথের সক্রিয় নেতাদের দিয়ে কমিটি করা হোক। যে সব জেলাতে আন্দোলনে নেতারা মাঠে নামেনি, তাদের বাদ দিয়ে নতুন কমিটি দেওয়া হোক। বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামের আন্দোলন জোরদার করার জন্য সিনিয়র নেতাদের প্রতি জিরো টলারেন্স নেওয়া হোক। যে সব নেতা মাঠে নামবে না তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হোক। দলে তরুণ নেতৃত্ব দেখতে চাই।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘উদ্যোগটি অবশ্যই ভাল। সকলের মত ও পরামর্শ যদি চেয়ারপারসনের কাছে তারা তুলে ধরেন এবং চেয়ারপারসন যদি তা গ্রহণ করেন, তাহলে দলের মঙ্গলই হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সাবেক ছাত্রদলসহ দলের তৃণমূলে অনেক ভাল ভাল নেতাকর্মী রয়েছে। দলের প্রতি যাদের অবদান ও ত্যাগ রয়েছে। তারা তো দলের মঙ্গলই চায়। তারা দলের বর্তমান সাংগঠনিক দুর্বলতা ঘোচাতে যদি সঠিক পরামর্শ দেয় এবং তা যদি দল গ্রহণ করে তবে তা অবশ্যই দলের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে।’
‘বিএনপির সাংগঠনিক ভঙ্গুর দশা থেকে উত্তরণের জন্য আপনারা নীতিনির্ধারকরা কাজ করছেন কিনা’- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, দলকে পুনর্গঠনের লক্ষ্যে সকলে মিলে কাজ শুরু করেছি। বহুদিন যাবৎ স্থায়ী কমিটির মিটিং হয়নি। খুব তাড়াতাড়ি এ বৈঠক হওয়া উচিত। দলের নির্বাহী কমিটিরও বৈঠক হওয়া উচিত। একই সঙ্গে দ্রুত দলের কাউন্সিল হওয়া উচিত। এ সব উদ্যোগের মধ্য দিয়ে দলের ত্যাগী, যোগ্য ও অনুগতদের সঠিক মূল্যায়ন করা ও নেতৃত্বে আনা উচিত। তাহলে সাংগঠনিক সক্ষমতা তৈরি হবে। দল ঘুরে দাঁড়াবে।’