রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক
মুহম্মদ আকবর
এইতো সেদিন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ গানের আবহে সমবেত নৃত্যের মধ্যদিয়ে একটি অনুষ্ঠানের শুরু দেখে দর্শকসারিতে বসা এক ভদ্রলোক রীতিমতো বিরক্ত হলেন। বাদ্যের মধুর আওয়াজ আর নাচের নান্দনিক মুদ্রায় যখন অনুষ্ঠানে ভিন্নমাত্রা যোগ করে, ঠিক পাশে বসে বিরক্ত করছিলেন এই ভদ্রলোক। হারে! বার বার বলছিলেন– ‘আজও নজরুল আমাদের দেশে উপেক্ষিত!’
পরে জানতে পেরেছিলাম লোকটি উচ্চ শিক্ষিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি সমাপ্ত করেছেন। বর্তমানে একটি বেসরকারি ফার্মে চাকরি করেন।
নজরুল কীভাবে উপেক্ষিত সে বিষয়ে জানতে চাইলে তার কাছে সদোত্তর পাওয়া যায়নি।
আমি বলেছিলাম রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে নজরুলের লেখা পড়েছেন। তিনি উত্তর দিলেন– ‘এত সময় কোথায়?’
আমি বলেছিলাম নিজের গানেই যখন নজরুল পরিচিত তখনও নজরুলের ব্যাপক আগ্রহের বিষয় রবীন্দ্রনাথের গান এবং সাহিত্য। উনি থেমে গেলেন এবং খুব আগ্রহ দেখালেন। বললেন চলুন না মাঠে গিয়ে বসি। কেন জানি অপরিচিত লোকটিকে দেখেও মনে হয়নি তার উদ্দেশ্য খারাপ। আমার সন্দেহ আর আলোচনা যখন প্রসরিত হচ্ছে ততক্ষণে নৃত্য, গান এবং নাচে পুরো শিল্পকলা একাডেমী প্রাঙ্গণ ছিল প্রাণবন্ত। বাংলার চিরায়ত সৌন্দর্য্যের অবগাহন চললেও আমাদের মন সেখানে নেই। চলে এলাম বাইরে।
শিল্পকলা একাডেমীর সদ্য সৃষ্টিনন্দন মঞ্চের ঝর্নার আবহে আমাদের বাহাস শুরু হল। ঠিক বাহাস বলা যাবে না কারণ বলার অংশটা আমারই ছিল বেশি।
লোকটির ডাক নাম কাজল। পুরো নাম মোস্তাফিজুর রহমান কাজল। আমাকে বললেন-‘আপনার হাতে কতটুকু সময় আছে?’ আমি বললাম যতক্ষণ বাহাসের উপকরণ আছে।
একটু হাসলেন। বললেন, ভাল বলেছেন।
আচ্ছা আপনি বলছিলেন নজরুল রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন এটি কোথায় পেয়েছেন?
কেন, নজরুলের পরম সতীর্থ কমরেড মোজাফফর আহমদের স্মৃতি কথায়!
নজরুল মোজাফফর আহমদের সঙ্গে করে জোড়াসাঁকো যাচ্ছিলেন সে সময় তিনি গীতাঞ্জলির প্রায় সবগুলো গানই গেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের নিকট এটি বলছিলেন মোজাফফর আহমদ। সে সময় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহও সেখানে ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বিস্মিত হয়েছিলেন।
তাদের সম্পর্কের আর কী নজির আছে আপনার কাছে?
স্বল্প সময়ে বলে শেষ করা যাবে না হয়তো। তারপরও যতটুকু বলা যায়।
নজরুল গবেষক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম’র ‘নজরুল : জীবন ও কর্ম’ শীর্ষক বইয়ে পাই রবীন্দ্রনাথের এক চিঠির উত্তরে ‘তীর্থপথিক’ নামক কবিতা রচনা করেছিলেন। কবিতাটিতে রবীন্দ্রনাথের চিঠির জবাব দিয়েছিলেন যা ১৩৪২ সালে ‘নাগরিক’ পত্রিকার ২য় বর্ষের প্রথম সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। কবিতার শেষাংশে ছিল–
‘প্রার্থনা মোর, যদি আবার জন্মি এ ধরণীতে,
আসি যেন গাহন করিতে তোমার কাব্য-গীতে!!
ভ্রু কুঁচকে তিনি বেশ আগ্রহের সঙ্গে আমার কথা শুনছিলেন আর ক্ষাণিক পর পর মুচকি হাসছিলেন।
আমার সন্দেহ হল- শুধু শুনে যাবেন, কোনো কথা বলবেন না এমন স্রোতাও কী আমাদের দেশে আছে? মানুষ তো শুধু বলতে চায়। সে যাক, হতেও পারে মানুষ আর এক রকম হয় না।
কী ভাবছেন?
ভাবছি, আপনি কৌতূহল ভরে আমার মতো একজন তরুণের কথা শুনছেন। তিনি বললেন-‘তরুণরাই তো বলবে, ওদের বলতে দেওয়া উচিত’।
কথাটা আমাকে নাড়া দিল। মনে হল, যেমনটা ভাবছি তিনি হয়তো তেমনটি নন।
আচ্ছা, আপনি স্বপক্ষে-বিপক্ষে কিছুই বলছেন না যে?
একটু মুচকি হেসে বললেন –‘আপনার কথা শুনতে ভাল লাগছে তাই শুনে যাচ্ছি। আচ্ছা রবীন্দ্রনাথ বসন্ত নাটকটি উৎসর্গ করেছিলেন তাই না?’
জি।
সে বিষয়ে আপনার কি কোনো ধারণা আছে?
কিছুটা।
সঞ্চিতা ও সঞ্চয়িতা?
জি।
বলুন না।
নজরুল যখন জেলে সে সময় রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য ‘বসন্ত’ প্রকাশ পায়। বইটি তিনি নজরুলকে উৎসর্গ করেন-‘শ্রীমান কবি নজরুল ইসলাম স্নেহভাজনেষু-এই বলে। খ্যাতিমান গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী তার ‘এক সুরের দুই কাননের পাখি’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘এই উৎসর্গের বিশেষত্ব ও তাৎপর্য আছে। প্রথমত, তিনি নজরুলকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘কবি’ বলে স্বীকার করে নেন। দ্বিতীয়ত, যৌবন-আনন্দ-উৎসবের এই ঋতুর সঙ্গে নজরুলের চারিত্রের বিশেষ ঐক্য ছিল। তৃতীয়ত, নজরুলের কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতীকী প্রতিবাদও বলা যায়। চতুর্থত, এর আগে রবীন্দ্রনাথ স্বজন ও সমাজের ব্যক্তি ছাড়া বোধহয় বাইরের আর কাউকে বই উৎসর্গ করেননি।’
বইটিতে তিনি স্বাক্ষর করে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। সে সময় নজরুলকে বলতে বলেছিলেন- তাকে বল কবিতা লেখা যেন কোনো কারণেই বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে, কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা দেওয়ার কবিও তো চাই।
বাকিটা তো সবারই জানা, বইটি পাওয়ার পর নজরুল কী বাঁধ ভাঙা আনন্দে ভেসেছিলেন!
তখনকার সমাজ কি সেটা ভালভাবে গ্রহণ করতে পেরেছিল?
কোনটা?
এই যে রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে বই উৎসর্গ করেছিলেন এই ব্যাপারটা?
না পারেনি। রবীন্দ্রনাথের কাছে সে বার বার নিষেধ করেছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাদের বোঝাবার চেষ্টা করেছেন যে নজরুল সাধারণ কেউ নন। তিনি বলেছিলেন- ‘জাতীর জীবনের বসন্ত এনেছে নজরুল; তাই আমার সদ্য প্রকাশিত ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যখানি ওকেই উৎসর্গ করেছি।’ এখানে নজরুল সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের একটি মূল্যায়নও গুরুত্বপূর্ণ সেটি হল- রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- ‘আমি জানি তোমাদের মধ্যে কেউ এটা অনুমোদন করতে পারনি। আমার বিশ্বাস, তোমরা নজরুলের কবিতা না পড়েই এমন মনোভাব পোষণ করেছ। আর পড়ে থাকলেও তার মধ্যে রূপ ও রসের সন্ধান করনি, অবজ্ঞাভরে চোখ বুলিয়েছ মাত্র।’
বাহ্। বেশ ভাল ইনফরমেশন আছে তো আপনার কাছে। তারপর কোর্টের উকিলের মতো আমাকে একের পর এক প্রশ্ন করে চলেছেন। আমিও খুব উপভোগ করছিলাম। কিন্তু কোনোভাবেই তার সম্পর্কে কৌতূহল শেষ হচ্ছিল না।
এদিক সেদিক তাকিয়ে আবার আমাকে উদ্দেশ করে বললেন- নজরুল ও রবীন্দ্রনাথের সুসম্পর্কের বিষয় নিয়ে আপনার অনেক চর্চা দেখছি সেটা কেন বলবেন কি?
কথাগুলো যখন বলছি আবহাওয়া ছিল চমৎকার। না গরম না ঠাণ্ডা। কথা চলছে। কথার বাঁকে বাঁকে সময় চলছে। বেলা গড়িয়ে তখন চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছিল। কৌতূহলী কাজল সাহেবের মুখ দেখে আর কথা বলতে পারছিলাম না। তাই ল্যাম্পের সামনে দাঁড়ালাম এবং বললাম- খুব ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। একজন আরেকজনের শত্রু ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি।
রবীন্দ্র-নজরুলের মতো প্রাজ্ঞজনদের মধ্যে এই বিষয়টি থাকবে এটি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তাই এ বিষয়ে যখনই কোনো তথ্য পেয়েছি তখনই পাগলের মতো অনুসন্ধান করে চলেছি। এক সময় অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের ‘নজরুল : জীবন ও কর্ম’ এবং নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত সংকলন ‘রবীন্দ্রনাথ-নজরুল’ এ বিষয়ে অনেক তথ্য পাই। কথা বলি নানান গবেষকের সঙ্গে। বলা যায় সকল ভ্রান্তির অবসান ঘটায় আমার এ আগ্রহ। এরই মধ্যে নজরুলের নাতনী সংগীত শিল্পী ‘অনিন্দিতা কাজী’র গ্রন্থনা ও উপস্থাপনায় ‘রবীন্দ্র পরিক্রমায় নজরুল’ অনুষ্ঠানটি আরও ব্যাপকভাবে তাদের সুসম্পর্কের জানান দেয়।
ততক্ষণে কাজল সাহেব আমার গা স্পর্শ করেন এবং বলেন- আচ্ছা, চলুন কফি হাউসের দিকে যাই। কারণ ইতিহাস সবসময়ই একটু নিরস হয়। সুতরাং কিছু খেতে খেতে রস আহরণ করি তারপর না হয় আবার শুরু করি।
বলতেই অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে কফি হাউসের দিকে আমাদের যাত্রা শুরু। এরই মধ্যে অনেক পরিচিত লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ। ক্ষণিক আলোচনা ও কুশল বিনিময়। অতঃপর কফি হাউজে পৌঁছা। কফি পান শেষে চারদিক হৈ চৈ এর মধ্যেই আবার শুরু হল আলোচনা। ততক্ষণে আমাদের আলোচনার কিছুটা ছন্দপতন হল। ভুলে গেলাম কোথা থেকে শুরু হয়েছিল।
কাজল সাহেব নিজেই অনেকটা আলোচনার পথ ধরিয়ে দিলেন।
প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন। রবীন্দ্রনাথ গত হওয়ার পর নজরুলের অনুভূতি কেমন ছিল?
আপনার মুখেই বলেন না? মনে হচ্ছে আপনি সব জানেন কিন্তু বলছেন না। আপনার ধারণা পুরোপুরি মিথ্যে নয় কিন্তু আমার জানাটার সঙ্গে যাচাই বাচাই করে নিচ্ছি। কোথাও কোনো গরমিল আছে কি না।
আচ্ছা শুনুন তবে—
পুরো কবিতা বলার তো আর সময় নেই। রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণের পর নজরুল লিখলেন রবিহারা কবিতা। সেটির অংশ বিশেষ হল-
‘বাঙালী ছাড়া কি হারালো বাঙালী বুঝিবে না আর,
বাংলা ছাড়া এ পৃথিবীতে উঠিবা না হাহাকার।…
আমরা তোমাকে ভেবেছি শ্রী ভগবানের আশীর্বাদ
সে আশীস যেন লয় নাহি করে মৃত্যুর অবসাদ।’
এ ছাড়াও ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে, সালাম অন্ত রবি, মুত্যৃহীন রবীন্দ্রসহ বেশ কিছু কবিতা ও গান রচনা করেন।
দু‘জনের একই শিরোনামের লেখা ১৪০০ সাল কবিতাও তো সুসম্পর্ক ও একজন আরেকজনকে অনুধাবনের অনুপম নজির।
নজরুল সম্পাদিত ‘ধুমকেতু’ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন-
আয় চলে আয়, রে ধুমকেতু,
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা,
জাগিয়ে দেরে চমক মেরে’
আছে যারা অর্ধচেতন!
নজরুল যখন জেলে অনশনরত তখন রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা কেমন ছিল?
তিনি নজরুলকে উদ্দেশ করে প্রেসিডেন্সি জেলে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন- ‘লেখা ছিল গিব আপ ইয়র হাঙ্গার স্ট্রাইক আওয়ার লিটারেচার ক্লেইমস ইউ।’ অর্থাৎ তুমি তোমার অনশন ত্যাগ কর। আমাদের সাহিত্য তোমাকে দাবি করছে।
আমাদের আলোচনা চূড়ান্ত সময়ে একাডেমীর সিকিউরিটি গার্ড বাঁশিতে ফু দিলেন। যার অর্থ বের হয়ে যেতে হবে। আলোচনা অর্ধসমাপ্ত করেই বাড়ি ফিরলাম। কিন্তু বুঝতে পেরেছিলাম কোনো কিছু ভুল হলে কাজল সাহেব সংশোধন করে দিতে ভুল করতেন না।
লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক