ব্যয় বাড়বে ৩০ হাজার কোটি টাকা : দুই ধাপে নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন
সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ঘোষিতব্য নতুন বেতন কাঠামো দুই ধাপে বাস্তবায়ন করা হতে পারে। আগামী ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বর্ধিত মূল বেতন এবং পরবর্তী ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বর্ধিত ভাতা দেওয়া হতে পারে। নতুন বেতন কাঠামোতে চাকরির বয়স ১৫ বছর হলে একজন সরকারি চাকুরের বেতন দ্বিগুণ হবে। এ ছাড়া টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বহাল রাখার পাশাপাশি বীমার আওতায় আসছেন সরকারি চাকরিজীবীরা।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও অর্থ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য প্রতীক্ষিত নতুন পে-স্কেল বাজেটের আগেই ঘোষণা এবং আগামী নতুন অর্থবছরের প্রথম দিন থেকেই তা কার্যকর করা হবে। সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়নে ‘পে এ্যান্ড সার্ভিসেস কমিশন’-এর সুপারিশের বিষয়ে গঠিত সচিব কমিটির প্রতিবেদন আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে জমা দেওয়া হবে। এরপর চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য এটি মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হবে।
সূত্র জানায়, নতুন পে-স্কেল বাস্তবায়নে ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয় বাড়বে সরকারের। এর মধ্যে সরকারি চাকরিজীবীদের (প্রতিরক্ষাসহ বিভিন্ন বাহিনী ও উন্নয়ন প্রকল্পে থাকা জনবল) শুধুমাত্র বর্ধিত বেতন দিতেই ব্যয় হবে প্রায় ১৫ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা এবং পাশাপাশি ভাতা প্রদান করা হলে সে জন্য ব্যয় হবে আরও ১৬ হাজার কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, চলতি ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে সরকারি চাকরিজীবীদের বিভিন্ন বাহিনীর লোকবল বাদে) বেতন-ভাতা খাতে বাজেট বরাদ্দ রয়েছে ২৩ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেতন খাতে ১১ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা ও ভাতাদি খাতে ১২ হাজার ৫৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
সূত্র জানায়, পে-কমিশনের প্রতিবেদনে যে সব সুপারিশ করা হয়েছে, সেগুলোর খুব বেশি পরিবর্তন করা হচ্ছে না। ছোটখাটো পরিবর্তনের মধ্যে সরকারি চাকুরেদের নিম্নতর স্কেলের বেতন কিছুটা বৃদ্ধির সুপারিশ করছে সচিব কমিটি। পে-কমিশনের সুপারিশে সবচেয়ে নিচের ১৬তম গ্রেডের চাকুরেদের বেতনের প্রস্তাব করা হয়েছিল ৮ হাজার ২০০ টাকা। সচিব কমিটি এটিকে ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৮ হাজার ২৫০ টাকার করার সুপারিশ করেছে। তবে যুগ্ম-সচিব থেকে তার উপরের চাকুরেদের জন্য কমিশন যে সুপারিশ করেছে সেটা ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা কমতে পারে। একই সাথে পে-কমিশন যে হারে সরকারি চাকুরেদের ভাতা বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে সচিব কমিটি তা-ও খানিকটা কাটছাঁট করার সুপারিশ করেছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত ‘পে এ্যান্ড সার্ভিসেস কমিশন’ গত ২১ ডিসেম্বর অর্থমন্ত্রীর আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। কমিশনের প্রতিবেদনে প্রদত্ত সুপারিশসমূহ পর্যালোচনার জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন ভূঁইঞাকে প্রধান করে ৩১ ডিসেম্বর গঠন করা হয় সচিব কমিটি।
পে-কমিশনের সুপারিশে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন শতভাগ বৃদ্ধির পাশাপাশি সর্ব্বোচ্চ বেতন ৮০ হাজার টাকা ও সর্ব্বনিম্ন বেতন আট হাজার ২০০ টাকার করার প্রস্তাব করা হয়। অন্যদিকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মুখ্য সচিবের বেতন মাসিক ১ লাখ টাকা, সিনিয়র সচিবদের মাসিক বেতন নির্ধারিত ৮৮ হাজার টাকা এবং সচিবদের মাসিক বেতন নির্ধারিত ৮৪ হাজার টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে। এই অনুযায়ী সচিবদের বেতন হবে গ্রেড-১ এর চেয়ে ৪ হাজার টাকা বেশি।
এ ছাড়া কমিশনের সুপারিশে সরকারি বেতন গ্রেড বা স্কেলের সংখ্যা বিদ্যমান ২০ থেকে ১৬-তে নামিয়ে আনা এবং সরকারি চাকরিজীবীদের টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড তুলে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর পরিবর্তে সুপারিশকৃত বেতন গ্রেড/স্কেলের মধ্যে টাকার অঙ্কে দূরত্ব বাড়ানো হয়েছে। বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের হার বৃদ্ধি করে সুপারিশকৃত ৫-১৬ গ্রেড/স্কেলে শতকরা ৫ ভাগ এবং ২-৪ গ্রেড/স্কেলে বার্ষিক ৪ ভাগ নির্ধারণ ও বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট চক্রবৃদ্ধি হারে প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি ৯ম থেকে ১৬ তম গ্রেড/স্কেলে ২০টি সোপান (স্টেপ) রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে যাতে কারো বেতন বৃদ্ধি থেমে না যায়।
সূত্রমতে, পে-কমিশনের টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড তুলে দেওয়ার বিষয়ে সচিব কমিটি প্রথমে একমত হলেও পরে এখান থেকে পিছিয়ে আসে। এখানে যুক্তি দেখানো হয় যে, টাইম স্কেলের মাধ্যমে বিশাল সংখ্যাক সরকারি চাকরিজীবীরা আর্থিকভাবে উপকৃত হচ্ছেন। এখন হঠাৎ করে তা বাতিল করে দেওয়া সমীচীন হবে না। তাই এবারকার মতো এটা রেখে দেওয়ার প্রয়োজন। একই সাথে সিলেকশন গ্রেডের বিষয়ে একই ধরনের মতো প্রকাশ করা হয়। এ সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি অর্থমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে সূত্র জানায়।
অন্যান্যের মধ্যে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ‘সমৃদ্ধি সোপান ব্যাংক’ নামে একটি ব্যাংক স্থাপনের প্রস্তাব করেছিল পে-কমিশন। কিন্তু এটি আপাতত হচ্ছে না বলে সূত্র জানায়। তবে অদূর ভবিষ্যতে সরকারি চাকুরেদের জন্য বিশেষ কোনো ব্যাংক করা যায় কিনা, তা বিবেচনা করা যেতে পারে বলে মনে করছে সচিব কমিটি।
উল্লেখ্য, পে-কমিশনের প্রতিবেদনে ‘সমৃদ্ধ সোপান ব্যাংক’ গড়ে তোলার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে বলা হয়, ‘কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের আওতায় সরকারি চাকরিজীবী এবং অবসরপ্রাপ্তদের ট্রাস্ট ব্যাংকের আদলে ৪০০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন নিয়ে ‘সমৃদ্ধ সোপান ব্যাংক’ নামে একটি বাণিজ্যিক ও উন্নয়ন ব্যাংক স্থাপন করা যেতে পারে। বর্তমানে কর্মরত প্রায় ১২ লাখ সরকারি চাকরিজীবী ও অবসরপ্রাপ্তদের প্রত্যেককে আজীবন ১০ (দশ) টাকা মূল্যমানের ৪০০টি শেয়ারের মালিকানা প্রদান করে উক্ত পরিশোধিত মূলধনের টাকা সংস্থান করা যেতে পারে। কল্যাণ বোর্ডের অলস প্রায় ১৪০ কোটি টাকাও যতদূর সম্ভব এই উদ্দেশ্য সীড ক্যাপিটাল হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।’
প্রস্তাবিত ব্যাংকের বিষয়ে কমিশন আরও বলেছে, ‘সম্পূর্ণ পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত প্রস্তাবিত ব্যাংকটির মুনাফা থেকে শেয়ারহোল্ডারগণ নিয়মিত লভ্যাংশ পাবেন। শেয়ারহোল্ডাররা সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পরও সমৃদ্ধি সোপান ব্যাংকের শেয়ার ধরে রাখতে পারবেন। ব্যাংকের মূলধন বৃদ্ধির তাগিদে উন্মুক্ত বাজার থেকে ইক্যুইটি উত্তোলনের সময় সরকারি চাকরিতে নতুন যোগদানকারীদের শেয়ার বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে। ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সময় সম্পূর্ণ পেশাদার ব্যবস্থাপনা এবং এতে শেয়ারহোল্ডারদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বিবৃত করা হবে।’