বাঁধা গৎ ডিঙিয়ে ক্রিকেটে নতুন বাংলাদেশ
হারের বৃত্ত ভাঙার আওয়াজ তুলেছে বাংলাদেশ। বাঁধা গৎ ডিঙিয়ে নতুন আলোর যাত্রাপথে বাংলাদেশ; বাংলাদেশের ক্রিকেট। মাঠের ভিতরে-বাইরে সবখানেই স্পষ্ট ইঙ্গিত নয়া জমানার! উচ্চাশার সমীকরণ মিলাতে গিয়ে হয়তো কিছু বিভ্রাটও হচ্ছে। তবে ক্রিকেট রেখচিত্র উপরে তুলতে পাল্টে ফেলতে হচ্ছে অতীতের ধ্যান-ধারণা। অনেকেই মানেন, জানেনও এই মুহূর্তে ক্রিকেটের স্বপ্নের ফেরিওয়ালা কোচ হাথুরুসিংহে। তার নানা টিপস; ক্রিকেটারকেন্দ্রীক কাজ-অধ্যাবসায়ের ফলও মিলছে হাতেনাতে। আবার সম্মিলিতভাবে টিম বাংলাদেশ এখন নবরূপে বিশ্ব ক্রিকেট আঙিনায়। কারো আগাম চোখ রাঙানিতে আর ভয় পান না মাশরাফি-মুশফিক-তামিম-সাকিব-ইমরুলরা। যেমনটা দেখা গেছে বিশ্বকাপে; দেখা গেছে পাকিস্তানের বাংলাদেশ সফরকালে।
বিশ্বকাপে চমকে দেওয়া বাংলাদেশ কোয়র্টার ফাইনাল খেলেছে। আর পরের সিরিজে; পাকিস্তানকে দেশের মাটিতে পেয়ে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে। সহজ হিসেব। ৬ ম্যাচ। বাংলাদেশের স্কোর; ৪ জয়, এক ড্র এবং এক পরাজয়। পাকিস্তানের মতো শক্তিশালী দলের বিপক্ষে গৌরবের এই অর্জনে বাংলাদেশের ক্রিকেটের খোল নলচা নল পাল্টে যাচ্ছে। ক্রিকেট বিশ্বে প্রমাণের বাকি নেই- আসছে টিম বাংলাদেশ। সে আর ফেলনা নয়।
হারের পর হার; এই কথা এখন পুরোটাই অচল। খাটে না বাংলাদেশের পাশে। অতীত হতেও বাকি নেই পুরানো সেইসব নেতিবাচক অধ্যায়। নতুন সাহসী পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। তুঙ্গস্পর্শী ক্রিকেট উত্তেজনার আমজে তামিম-ইমরুল-সাকিব-মুশফিক-সৌম্য-সাব্বিরে ভাসছেন ভক্তরা। বিশ্বকাপেই তাক লাগিয়ে; চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। আর পাকিস্তান সিরিজে ক্রিকেট পাণ্ডুলিপি নতুনভাবে আর্কাইভে এঁকে দিয়েছে বাংলাদেশ। বদলে যাওয়া বাংলাদেশের সামনে বড্ড অসহায় মনে হয়েছে পাকিস্তানকে। মাত্র ৮ মাসের ব্যবধানেই অন্য এক বাংলাদেশ মুগ্ধতার আবেশ ছড়ানো সুর-মুর্ছনায় উদ্ভাসিত। বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা এখন আর হারার আগে নেতিয়ে পড়েন না। প্রাথমিক হোঁচটে ভেঙে পড়েন না। ক্রমেই বাংলাদেশ একটি সমীহ-জাগানিয়া দলে পরিণত হচ্ছে। ওয়ানডেতে পাকিস্তানকে হোয়াইওয়াশের পর ক্রিকেট মোড়ল ভারতও নড়েচড়ে বসেছে। তারা আসছে আগামী মাসে। বাংলাদেশ-ভারত সিরিজকে তাই সহজিয়া বাঁধনে বাধতে নারাজ সুনিল গাভাস্কার-সৌরভ গাঙ্গুলিরা। বরং কঠিন হুশিয়ারীতে ভারতকে শাসিয়েছেন; সর্তক থাকার কথা বলেছেন তারা। উজ্জীবিত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ টেস্ট ভাল হয়নি। এ নিয়ে অনেকে কথার রঙ চটিয়ে; উষ্মা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন কেউ কেউ। টস জেতার পর কেন ফিল্ডিং; এ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। সঙ্গে তাদের নানা মত-দ্বিমত-ধারণার সারবান হচ্ছে-‘আগে ব্যাটিং নিলে বাংলাদেশ ম্যাচ ড্র করতে পারত।’ অতি উৎসাহীদের কথার বাড়াবাড়ির সুর থাকায় বিড়ম্বনায় পড়ছে নতুন উচ্চতায় ওঠার সন্ধিক্ষণে পা রাখা বাংলাদেশের ক্রিকেট।
দ্বিতীয় টেস্টে দ্যুতিময় ছান্দসিক ব্যাটিং করতে পারেননি তামিম-মুমিনুল-শুভাগতরা। উচ্চাভিলাসী শটে কিছুটা ব্যাটিং-বিভ্রাটও হয়েছে। যা বাংলাদেশের স্বপ্রতিভ ব্যাটিং লাইনআপের ভাবমূর্তির জন্য বিপদ ডেকে এনেছে। যেই চোরাগুপ্তা পথ থেকে আর উদ্ধার-নিস্তার পায়নি বাংলাদেশ। ক্রিকেট প্রাজ্ঞজনেরা অবশ্য বাংলাদেশের জন্য এমন টেস্ট-ফল আগে থেকেই আশা করে রেখেছিলেন। তৈরিও ছিলেন। কারণ, টেস্টের সুবিস্তৃত করিডোরে বাংলাদেশ-পাকিস্তানে অযুত ব্যবধান। ঢাকা টেস্টের হার স্বাভাবিক মেনেই নিয়েই তারা ব্যাখ্যা-সমীকরণে খুলনায় বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংসের ব্যাটিংকে অভাবিত বলেছেন। বাংলাদেশের প্রতিভাদৃপ্ত ব্যাটিং দেখে টেস্ট ক্রিকেটে মুশফিক-তামিমদের আর অস্পৃশ্য ভাবছেন না। তারা, বাংলাদেশের সামনে সুদিন দেখছেন।
ব্যাট-বলের ওঠা-পড়ায়, রান-আউটের ঘাত-প্রতিঘাতে, ম্যাচের নানা বাঁকে-বাঁকে বাংলাদেশ এখন আর নুয়ে পড়ে না। খেই হারিয়ে ফেলে না প্রতিপক্ষের চোখ-রাঙানি কিংবা কথার হুমকি-ধামকিতেও। উল্টো ইটের বদলে পাটকেল ছুঁড়তেও এখন সাহসী বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। যেমনটা দেখা গেছে ঢাকা টেস্টে সাকিবকে। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে বারুদ বোলিংয়ে ভিন্ন উচ্চতা-আলোচনায় ওঠে আসা ওয়াহাব রিয়াজকে ব্যাটে তো বটেই; মুখে টিপ্পনি কাটার পর কঠিন জবাব দিয়েছেন সাকিব। অথচ তখন কিন্তু টেস্টে বাংলাদেশের প্রাণান্তকর অবস্থা।
ওয়ানডে-টোয়েন্টি২০-র পর বাংলাদেশ কিন্তু পাকিস্তানকে খুলনায় আসল টেস্ট খেলার নমুনা বুঝিয়ে দিয়েছে। শিল্পাঞ্চলের পয়মন্ত ভেন্যুতে প্রথম ইনিংসে একটু তালেগোলে হয়ে গেলেও দ্বিতীয় ইনিংসে অবিরাম ব্যাটিংয়ে ভাস্বর থেকেছেন তামিম-ইমরুলরা। বুক চিতিয়ে ব্যাটিংশৈলী দেখিয়ে বিস্মিত করেছেন পাকিস্তানকে। সেখানে কিন্তু কে ওয়াহাব-ইমরান-হাফিজ তার তোয়াক্কা করেননি। অথচ এক বছর আগেও প্রতিপক্ষ পাকিস্তান হলেই ব্যাটিংয়ের কাঁপন ধরত। হুড়মুর করে ছত্রখান হয়ে যেত সব প্রতিরোধ। এবার কিন্তু সেই অবান্তর নেতিয়ে পড়ার অভ্যাস বদলাতে পেরেছে বাংলাদেশ। পুরানো সব জড়তা ঝেড়েঝুড়ে নতুন হয়ে ওঠার পথ রচনা করতে পেরেছে। ক্রিকেটকে ধর্ম মেনে, দায়িত্বশীল আচরণে কর্মপ্রাণিত হয়ে বীরোচিতভাবে নিজেদের উপস্থাপন করতে পেরেছেন ক্রিকেটাররা। খুলনায় তামিম ইকবালের ডাবল সেঞ্চুরি, ইমরুলের দেড় শ’ রান; কিংবা তাইজুলের ৬ উইকেটকে আপনাকে অবশ্যই ধ্রপদী ঘরনায় ফেলতে হবে। টেস্ট সিরিজের মুমিনুলের এগারতম টানা হাফ সেঞ্চুরি নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছে। স্বপ্ন আরো বড় হচ্ছে মুমিনুলকে ঘিরে। আর ওয়ানডেতে তামিমের জোড়া সেঞ্চুরির সঙ্গে সৌম্যের একটিতেই খাদের কিনারা দেখেছে পাকিস্তান।
টেস্ট ক্রিকেট আলাদা; আলাদা ঢংয়ে, রঙে মেজাজে। ৯০ টেস্ট খেললেও এখনো দীর্ঘ ব্যাটিং-বোলিংয়ের অভ্যস্ততা গড়ে ওঠেনি বাংলাদেশের। ফলে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে ব্যাকরণসিদ্ধ ক্রিকেটীয় নির্যাস-জৌলুসের ছন্দপতন হয়েছে। সেখানে পুরানো-নতুনের ফারাকও সামনে চলে এসেছে। টেস্ট ক্রিকেট আসলে পুরানোর চালের মতো; যা ভাতে বাড়ে- কার্যকারিতায় এর গুণ অন্তর্নিহিত। একজন ক্রিকেটার টেস্টে যতবেশি ঋদ্ধ হবেন; ততটাই মঙ্গল হবে দলের। তবে চির নতুনের আহ্বান উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশের পেসার শহীদ-তাইজুল-ব্যাটার মুমিনুল-সৌম্য কিন্তু সম্ভাবনার শতভাগ আলো জ্বালিয়েছেন। সেই কারণে নতুন-পুরানো মিশেল শক্তিতে বাংলাদেশ এখন সামত্য-সমৃদ্ধ দল।
ইতিহাস যাই হোক; পরাজয়ের বিস্মৃতি-সে তর্কও তুলে রাখুন। পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ এবং টোয়েন্টি২০-র জয় জয়কার গৌরবকথা হয়তো টেস্ট সিরিজে খাটবে না। তবে নিখাদ সত্য উচ্চারণে বলতে দ্বিধা নেই; টেস্টেও সুদিনের অপেক্ষায় উৎসবের মেজাজে থাকা বাঙালি ক্রিকেটপ্রেমীরা। যারা রোদ-বৃষ্টি ঝর উপেক্ষা করেও ছুটে আসেন খেলার মাঠে। আসেন ক্রিকেটারদের সোল্লাসে, স্লোগানে স্লোগানে অনুপ্রাণিত করতে। সেখানে ঘাম ঝরানো কষ্টার্জিত টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর ক্রিকেটাররা ফিরিয়ে দিচ্ছেন কই। কখনো জিম্বাবুয়েকে, কখনো নিউজিল্যান্ডকে, আবার কখনো পাকিস্তানের মতো শক্তিশালী দলকেও হোয়াইটওয়াশ করে ভক্তদের বিনোদনদায়ী ক্রিকেট উপহার দিয়েছেন। তবে সচরাচর এমন বর্ণ-রঙিন ঝলমলে দিন ক্রিকেটে কালে-ভদ্রেই আসে।