গ্রেড-স্কেল কেড়ে নেওয়ায় ক্ষোভ আন্দোলনের প্রস্তুতি
তিন দশকেরও বেশি পুরনো পদ্ধতি সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে আন্দোলনে যাচ্ছেন সরকারি কর্মচারীরা। একজন কর্মচারী যখন পদোন্নতি না পেয়ে দীর্ঘদিন একই পদে কাজ করতে বাধ্য হন তখন বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর বেতন বাড়ানো হয়। পদোন্নতিবঞ্চিতদের বেতন বাড়ানোর এ পদ্ধতি চিরতরে বন্ধ করার খবরে বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন সরকারি কর্মচারীরা। তাই তাঁদের মধ্যে নতুন পে স্কেল দেওয়ার আনন্দের চেয়ে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল কেড়ে নেওয়ার বিষাদটাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
প্রায় পাঁচ মাস আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিন নতুন পে স্কেলের প্রতিবেদন জমা দেন। সেখানে তিনি সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেন। কিন্তু কর্মচারীরা যেন বঞ্চিত না হন সে জন্য যথাসময়ে তাঁদের পদোন্নতি নিশ্চিত করতে বলেন। সেই সুপারিশ বহাল রেখেছে বেতন কমিশনের প্রতিবেদন পর্যালোচনাসংক্রান্ত সচিব কমিটি। এ কমিটিই গত বুধবার অর্থমন্ত্রীর কাছে তাদের প্রতিবেদন হস্তান্তর করেছে।
সরকারি কর্মচারীদের ধারণা ছিল, পে কমিশন সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাদ দেওয়ার সুপারিশ করলেও সচিব কমিটি এ দুটি পদ্ধতি বাদ দেবে না। কারণ তারা বাস্তবতা কমিশনের চেয়ে ভালো বোঝে। যথাসময়ে পদোন্নতি দেওয়ার কথা পে কমিশন বললেও সরকার এটা নিশ্চিত করতে পারবে না। কিন্তু সচিব কমিটিও পে কমিশনের পথ অনুসরণ করায় কর্মচারীরা বিস্মিত হয়েছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার সব সরকারি দপ্তরের টেবিলে বেতন বাড়ার খবর ছাপিয়ে আলোচনায় ছিল টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাদ দেওয়ার খবর। শুধু অনানুষ্ঠানিকভাবেই নয়, আনুষ্ঠানিকভাবেও কর্মচারী নেতারা বসেছিলেন। পরবর্তী করণীয় কী হবে তার কৌশল নিয়েও আলোচনা করেছেন তাঁরা। কারণ সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাদ দেওয়ার খবর পাঁচ মাসের পুরনো। পাঁচ মাস আগে থেকেই তাঁরা বিষয়টি সরকারের নীতিনির্ধারকদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু নীতিনির্ধারকরা তাঁদের পাত্তা দিচ্ছিলেন না। সচিব কমিটির প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিষয়টি বোঝানোর জন্য তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করেছিলেন কর্মচারী নেতারা। কিন্তু সাক্ষাৎ মেলেনি। শেষ পর্যন্ত তাঁরা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে দেখা করার আবেদন করেও সময় পাননি। অর্থমন্ত্রীর দপ্তর থেকে কর্মচারী নেতাদের বলা হয়েছে, জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহের আগে মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হবে না। এতে বেজায় চটেছেন সরকারি কর্মচারী সমিতির নেতারা। এ অবস্থায় গতকাল কর্মচারী নেতারা সচিবালয়ের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিচতলার কেন্টিনে বৈঠকে বসেছিলেন। সেখানে আগামী সপ্তাহে সংবাদ সম্মেলন করে সরকারের কাছে তাদের সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল না দেওয়ার ক্ষতি তুলে ধরার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সমাধান না হলে সারা দেশের সরকারি অফিসে কর্মবিরতি পালনের কর্মসূচি আসতে পারে। এক পর্যায়ে সমাবেশ করার কথাও বলা হয়েছে গতকালের বৈঠকে।
বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি নিজামুল ইসলাম ভুঁইয়া মিলন গতকাল রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা কয়েকজন বসেছিলাম। সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা দেখা করতে চেয়েও প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ পাইনি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে। আর অর্থমন্ত্রীর দপ্তর বলেছে জুনের আগে দেখা হবে না। অথচ তার আগেই আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে। টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড এক দিনের বিষয় না। চাকরির বৈষম্য দূর করার যে পদ্ধতিটি দশকের পর দশক বহাল রয়েছে তা আপনি হুট করে বাদ দিতে পারেন না। বাদ দেওয়ার আগে কর্মচারীদের আশ্বস্ত করুন। টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের বিকল্প হিসেবে তাঁদের কী দেওয়া হবে, তা জানান। কোনো কিছু না জানিয়ে দুটি পদ্ধতির বিলোপ ঘটাতে পারেন না।
শুধু সচিবালয় নয়, সচিবালয়ের বাইরের কর্মচারী সংগঠনগুলোতেও ব্যাপক সমালোচনা চলছে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড নিয়ে। বাংলাদেশ তৃতীয় শ্রেণি কর্মচারী সমিতি আগামীকাল শনিবার তাদের তেজগাঁওয়ের দপ্তরে বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য বসবে। সেখানে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে পরামর্শ করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে।
বাংলাদেশ তৃতীয় শ্রেণি কর্মচারী সমিতির সভাপতি মাহফুজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নতুন পে স্কেল দিলে সারা দেশের কর্মচারীরা অভিনন্দন জানান। সরকার অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসে। কিন্তু আজকে কেউ অভিনন্দন জানাচ্ছে না। কারণ সবার ভয় টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডে। এ দুটি বিলোপ করা হলে সরকারি কর্মচারীরা বিপদে পড়ে যাবেন। আমরা পে কমিশনের প্রতিবেদন দেওয়ার পর যখন বিষয়টি জানতে পারি তখনই সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। আবারও করব। সরকারকে বুঝিয়েই বিষয় দুটি বহাল রাখতে হবে।’
১৯৭৭ সাল থেকে সিলেকশন গ্রেড চালু হয়। একই পদে দীর্ঘদিন চাকরি করতে বাধ্য হলে একজন সরকারি কর্মচারী তাঁর চাকরির ৮, ১২ ও ১৫ বছরে গিয়ে সিলেকশন গ্রেড পান। এতে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী পদোন্নতি না পেলেও আর্থিকভাবে লাভবান হন। আর ১৯৮১ সালে ক্যাডার সার্ভিসে টাইম স্কেল দেওয়া হলেও ননক্যাডারে দেওয়া হয় ১৯৮৩ সালে। টাইম স্কেল কখন দেওয়া হয় জানতে চাইলে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, একজন কর্মচারী যখন স্কেলের শেষ ধাপে পৌঁছে যান তখন নিয়ম অনুযায়ী তাঁকে পদোন্নতি দিয়ে পরের স্কেলে উন্নীত করা হয়। কিন্তু পদোন্নতি না দিতে পারলে তখন তাঁকে টাইম স্কেল দিয়ে তাঁর আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়া হয়।