ভুলে ভুলে ডুবতে বসেছে বিএনপি
প্রতিষ্ঠার পর ৩৬ বছরে সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে বিএনপি। ঘরে-বাইরে সমস্যার মধ্যে রয়েছে দলটি। একদিকে দলের নেতাদের মধ্যে সন্দেহ-অবিশ্বাস ও বৈরিতা চরম আকার ধারণ করেছে; অন্যদিকে সরকারও ক্রমে চেপে ধরছে বিএনপিকে। এক-এগারোর পর ‘সংস্কার’ প্রশ্নে বিএনপিতে যে বিভেদ তৈরি হয়েছিল, তা এখনো দূর হয়নি। এর ওপর মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে দলটির নেতাকর্মীদের জর্জরিত করে ফেলেছে সরকার। এ অবস্থায় বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। বর্তমান নেতৃত্ব ও কাঠামো দিয়ে সামনের দিনে দলটি আর ক্ষমতায় যেতে পারবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
দলের নেতা ও সমর্থক সুধীজনরা অবশ্য এখনো নিরাশ হতে নারাজ। তাঁদের মতে, সরকারের উপর্যুপরি হামলা-মামলা সত্ত্বেও এখনো বিএনপি সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। একদিন না একদিন এই দেশে নির্বাচন হবে এবং সুষ্ঠু নির্বাচন হলেই বিএনপি ক্ষমতায় আসবে। তবে গত কয়েক বছরে, বিশেষ করে এক-এগারোর পরে দলের রাজনৈতিক কর্মকৌশল প্রণয়নে কিছু ভুল-ত্রুটি হয়েছে বলে তাঁরা স্বীকার করেন। পাশাপাশি তাঁরা বলেন, জিয়াউর রহমানের আদর্শ থেকে বিএনপি পুরোপুরি না সরলেও কিছু ক্ষেত্রে বিচ্যুতি ঘটেছে। দলীয় নেতাদের দাবি, তরুণ নেতৃত্ব সৃষ্টির পাশাপাশি সক্রিয় নেতাদের কাজে লাগিয়ে এগিয়ে গেলে বিএনপি আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।
প্রতিষ্ঠার পর বেশ কয়েকবার সংকটে পড়লেও এক-এগারোর পর উদ্ভূত পরিস্থিতির সূত্র ধরে পড়া সংকটের ধারাবাহিকতা এখনো চলছে বিএনপিতে। দলের নেতাকর্মীরা বলছে, বস্তুত ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দীনের সরকারই বিএনপির মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। ওই সময়ই বিএনপির বড় একটি অংশকে দুর্নীতির মামলায় জড়িয়ে কারাগারে পাঠানো হয়, যেসব মামলা এখনো চলছে। তাদের মতে, ওই সময়ের সরকারের সঙ্গে ‘আপসরফা’ হলে বর্তমানের এই পরিস্থিতি এড়ানো যেত। আপস হলে ২০০৯ সালের নির্বাচনে অন্তত আওয়ামী লীগের তিন-চতুর্থাংশ আসন পাওয়ার ঘটনা ঠেকানো যেত। আর এতে বিএনপিকে ধ্বংস করার এত ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ হয়তো আওয়ামী লীগ সরকার পেত না। সুযোগ হতো না পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করারও।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হওয়ার পরও বিএনপির বিশ্বাস ছিল, দেশি-বিদেশি শক্তির চাপে শেষ পর্যন্ত সরকার নতি স্বীকার করে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বাতিল করবে এবং সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে সহায়ক শক্তি হিসেবে পরিচিত তৎকালীন ভারত সরকার ওই নির্বাচন সমর্থন করে। এদিকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও শুধু সাংগঠনিক শক্তির অভাবে বিএনপি ওই নির্বাচন ঠেকাতে ব্যর্থ হয়। ফলে নির্বাচনের পর সরকার গঠন করে বিএনপি ও এর নেতৃত্বাধীন জোটের নেতাকর্মীদের ওপর ‘ক্র্যাকডাউন’ শুরু করে ক্ষমতাসীনরা। অনেকে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। এ ছাড়া গুম করা হয় বেশ কিছু নেতাকর্মীকে। বেশির ভাগ কেন্দ্রীয় নেতাকেও মামলায় জড়িয়ে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়। এভাবে এক বছর পার হওয়ায় নির্বাচনের এক বছর পূর্তিকে কেন্দ্র করে আবারও সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে বিএনপি। কিন্তু সর্বশেষ এই আন্দোলনের চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। উল্টো সহিংসতা সৃষ্টির অভিযোগে দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। বর্তমানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল পর্যায়ের শত শত নেতাকর্মী কারাগারে। এদিকে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ওপরও ঝুলছে মামলার খক্ষ। এরই মধ্যে কয়েকটিতে চার্জশিট হয়ে গেছে। এ অবস্থায় সরকারবিরোধী আন্দোলন দূরে থাক, বিএনপির টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে। গ্রেপ্তারের ভয়ে নেতাকর্মীরা ঘর থেকে বের হতে পারছে না। সব মিলিয়ে সাংগঠনিক অবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এ মুহূর্তে অনেকটাই নির্জীব হয়ে গেছে বিএনপি। দলটি সংসদেও নেই, রাজপথেও নেই।
সামর্থ্যবানরা দেশের বাইরে, অন্যরা আত্মগোপনে : বিএনপিকে এ মুহূর্তে সরকারের নানামুখী চাপ সহ্য করতে হচ্ছে। দলটির আশঙ্কা, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ প্রথম সারির সক্রিয় বেশির ভাগ নেতারই ‘সাজা’ হতে পারে, যাতে দলটি নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে। এ ছাড়া দলের প্রথম সারির বেশির ভাগ নেতার গতিবিধির ওপর নজর রাখছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এর ফলে দলীয় কর্মকাণ্ড দূরে থাক, ব্যবসা-বাণিজ্য ও নিজেদের ব্যক্তিগত কাজও তাঁরা ঠিমতো করতে পারছেন না। জানা যায়, এ কারণে দলের কেন্দ্রীয় ও গুলশান কার্যালয়েও নেতাকর্মীরা পারতপক্ষে যাচ্ছে না। দলীয় সূত্র মতে, পরিস্থিতির চাপে সামর্থ্যবান অনেক নেতাই এরই মধ্যে দেশের বাইরে চলে গেছেন। শিগগিরই তাঁদের দেশে ফেরার সম্ভাবনা নেই। আবার দেশে থাকা নেতারাও ভয়ে আত্মগোপনে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। সব মিলিয়ে দলটির সর্বস্তরে এক ধরনের হতাশা নেমে এসেছে।
১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান নিহত হলে প্রথম দফা নেতৃত্বের সংকটে পড়ে বিএনপি। ওই পরিস্থিতিতে সাময়িক সময়ের জন্য দল ও সরকারের হাল ধরেন তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার। কিন্তু ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল এইচ এম এরশাদের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান হলে সাত্তার ক্ষমতাচ্যুত হন এবং বিএনপি আরেক দফা সংকটের মুখে পড়ে। বিএনপির তৎকালীন প্রভাবশালী কয়েকজন নেতা তখন এরশাদের সঙ্গে চলে গেলে এই সংকট আরো বাড়ে। এরপর নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে দলের ওই সংকটকালে ১৯৮৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিএনপির হাল ধরেন খালেদা জিয়া।
ভেতরে-বাইরে নানা আলোচনা : বিএনপি নেতাদের মতে, জিয়াউর রহমানের মতোই খালেদা জিয়াও দলে এবং দলের বাইরে সমান জনপ্রিয়। এ কারণেই জিয়ার মৃত্যুর পরও খালেদার নেতৃত্বে বিএনপি দুবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু এক-এগারোর পর প্রায় সাড়ে আট বছর ক্ষমতার বাইরে আছে দলটি। এ কারণে বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব বা কাঠামো দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব কি না তা নিয়ে দলের ভেতরে-বাইরে নানা আলোচনা চলছে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপি সমর্থক ‘শত নাগরিক’ কমিটির নেতা ও বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের দিকনির্দেশনা ঠিকই আছে। তবে এ দেশের মানুষ তরুণ নেতৃত্বের প্রতি বেশি আস্থাশীল বলে মনে হয়। এ ক্ষেত্রে বিএনপি জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি।’ তাঁর মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রদলের সমর্থন আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। দলের পক্ষে যুবশক্তিও ততটা সংগঠিত নয়। তাই কেন্দ্রীয় বিএনপিতে প্রজ্ঞাবান নেতা সৃষ্টির পাশাপাশি শিল্প ও কল-কারখানায় শ্রমিক নেতা তৈরি করতে হবে। তা না হলে বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হবে।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, আট বছরের বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণ নিয়ে দলটির ভেতরেই এখন নানা মূল্যায়ন শুরু হয়েছে। বলা হচ্ছে, ২০০৯ সালের নির্বাচনে পরাজয় বিএনপির প্রাপ্য ছিল। কারণ ক্ষমতায় থাকতে অনেক ক্ষেত্রেই দলটি বাড়াবাড়ি করেছে। তবে গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকানোর ব্যর্থতা এবং দলের এখনকার বিপর্যয়ের জন্য যোগ্য তথা ত্যাগী নেতাকর্মীর প্রচণ্ড অভাব বলে মনে করা হচ্ছে। অনেকের মতে, নব্বইয়ের দশকে খালেদা জিয়ার পাশে ‘ক্লিন ইমেজের’ প্রভাবশালী অনেক নেতা ছিলেন, এখন আর তেমনটি নেই। সে সময়ের দক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নেতাদের মধ্যে মেজর জেনারেল (অব.) মজিদ উল হক, কর্নেল মুস্তাফিজুর রহমান, ব্যারিস্টার আবদুস সালাম তালুকদার, এম সাইফুর রহমান ও আবদুল মান্নান ভূঁইয়াসহ অনেকেই মারা গেছেন। আবার নানা ঘটনার সূত্র ধরে দূরে চলে গেছেন অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, শেখ রাজ্জাক আলী, কর্নেল (অব.) অলি আহমদসহ অনেকে। এসব কারণে একদিকে দলে প্রজ্ঞাবান নেতার অভাব সৃষ্টি হয়েছে, অন্যদিকে যাঁরা আছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছে প্রচণ্ড রেষারেষি ও বিরোধ।
এখনো আলোচনায় হাওয়া ভবন : ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে দলীয় কার্যালয় থাকা সত্ত্বেও চেয়ারপারসনের কার্যালয় হিসেবে বনানীতে ‘হাওয়া ভবন’ ভাড়া নিয়ে দলের ভেতরে ও বাইরে কিছুটা বিতর্ক সৃষ্টি করেন তারেক রহমান। নির্বাচনের পরও ওই কার্যালয় খোলা রাখা হলে ‘হাওয়া ভবন’ ঘিরে বিতর্ক আরো বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে নানা দুর্নাম ছড়িয়ে পড়ে। এক-এগারোর পর সমঝোতার মাধ্যমে তারেক রহমান বিদেশে চলে যাওয়ায় ওই কার্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। বিএনপির বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দলের অনেকেও আড়ালে হাওয়া ভবনের ভূমিকাকে দায়ী করেন।
এক-এগারোর আগে এবং গত বছরের ৫ জানুয়ারির আগ পর্যন্ত লন্ডনপ্রবাসী দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বের প্রভাব দলে অনেকটা বাড়লেও সাম্প্রতিক সময়ে তা কিছুটা কমে গেছে। বাংলাদেশে তারেকের বক্তব্য-বিবৃতি প্রচারে আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ১৯৯৭ সালে বগুড়া জেলা বিএনপির সদস্য পদ নিয়ে রাজনীতিতে নাম লেখান জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান। এরপর প্রথমে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব এবং সর্বশেষ কাউন্সিলে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের পদ লাভ করেন তিনি।
এক-এগারোর পরই দলে বিভেদের বীজ : বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী মনে করে, মূলত এক-এগারোর পর দলটির মধ্যে সন্দেহ, অবিশ্বাস ও বিভেদের বীজ বপন করা হয়েছে। এর পরিণতিতে কে ‘সংস্কারপন্থী’ আর কে নন, তা নিয়ে এখনো বিভক্ত হয়ে আছে বিএনপি। অনেকের দাবি, সাবেক মহাসচিব প্রয়াত খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের সমর্থকরা এ বিভক্তি জিইয়ে রাখতে এখনো সহায়তা করছে। ফলে অর্ধশতাধিক সাবেক সংসদ সদস্যসহ দলের বড় একটি অংশ পুরোপুরি দলীয় কর্মকাণ্ডের বাইরে। অন্যদিকে যাঁরা দলে আছেন, তাঁদের অনেককেও সংস্কারপন্থী হিসেবে অভিহিত করে দূরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। জানা গেছে, দলের মধ্যে যাঁরা এ কাজটি করছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদসহ আরো কয়েকজন। মূলত এঁদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হলেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা ও তাঁর অনুসারীরা। আব্বাসপন্থীরা দলের সংস্কারপন্থীদেরও খোকার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এদিকে আব্বাস-খোকাকেন্দ্রিক এ বিরোধ সংক্রমিত হচ্ছে কেন্দ্রীয় বিএনপিতে। সব মিলিয়ে ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে বিএনপি।
বাইরের চাপেও কাবু : এদিকে অনেক চেষ্টা-তদবির করেও প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এখনো পুরোপুরি ঠিক করতে পারেনি বিএনপি। দলীয় নেতাদের মূল্যায়ন, ওই দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও পরিবর্তন সম্ভব নয়। ভারতের গত কংগ্রেস সরকারের সময় অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও সম্পর্ক উন্নয়নে ব্যর্থ হয় বিএনপি। এরপর তারা দেশটির লোকসভা নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করে। নির্বাচনে বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় এলে বিএনপি অনেকটাই আশাবাদী হয়ে ওঠে। কিন্তু ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যের নিরাপত্তা, বিএনপি সরকারের আমলে ১০ ট্রাক অস্ত্র ধরা পড়ার ঘটনা, সর্বোপরি জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কসহ নানা সমীকরণে এখনো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থিতিশীল রেখেছে ভারত।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা কালের কণ্ঠকে জানান, প্রকৃতপক্ষে জামায়াত-বিএনপি সখ্য পছন্দ করছে না ভারত। তাই এ প্রশ্নে বিএনপি কী করবে, সে বিষয়টি নিয়ে দলে আলোচনা চলছে। তাঁদের মতে, ভারতের সমর্থন পাওয়ার আশায় শেষ পর্যন্ত জামায়াতের সঙ্গে জোট না-ও থাকতে পারে।
জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ থাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনার মুখে আছে বিএনপি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বেশ আগে থেকেই বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে আহ্বান জানিয়ে আসছে। সম্প্রতি যুক্রাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদে বাংলাদেশ বিষয়ে এক শুনানিতেও একই রকম তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
নিরাশ নন দলীয় নেতা ও বুদ্ধিজীবীরা : এদিকে বিএনপি এ সংকট কাটিয়ে উঠবে বলে মনে করেন দলের সিনিয়র নেতা ও সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা। অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের মতে, রাজনৈতিক দলের জীবনেও উত্থান-পতন আছে। আওয়ামী লীগের মতো পুরনো দলেও একসময় নেতৃত্বের অভাব দেখা গেছে। ঘটেছে নির্বাচনে ভরাডুবির মতো ঘটনাও। কিন্তু আবার তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তাঁর দাবি, বিএনপির এখনকার অবস্থা মূলত এক-এগারোর ঘটনাপ্রবাহ থেকে উদ্ভূত। ওই সময় বিএনপি তার দলীয় স্বার্থের কথা চিন্তা করে আপস করলে আজ পরিস্থিতি অন্য রকম হতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্য মনে করেন, হয়তো সেভাবে দলটির নেতৃত্ব চিন্তা করেনি। ফলে এরই ধারাবাহিকতায় দলটি আজ এই জায়গায় এসেছে। কিন্তু এখান থেকে অবশ্যই উত্তরণ ঘটবে। কারণ বিএনপি এখনো সবচেয়ে জনপ্রিয় দল।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও প্রবীণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর শুধু তাঁর প্রতিষ্ঠিত আদর্শের ওপর ভিত্তি করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি দুবার ক্ষমতায় এসেছে। এর আগে ও পরে অনেকবার মনে হয়েছে, এই বুঝি বিএনপি শেষ হয়ে গেল। কিন্তু শেষ আজও হয়নি। উপরন্তু পৃথিবীর যেকোনো সংস্থা আজ জরিপ করে দেখুক- দেখা যাবে বিএনপি সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। কিন্তু এই জনপ্রিয়তাকে সরকার শিকল দিয়ে আটকে রেখেছে।’
আদর্শচ্যুতির কারণে দলের এই অবস্থা কি না জানতে চাইলে খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘দলের সর্বস্তরে আদর্শচ্যুতি ঘটেনি। তবে কিছু কিছু জায়গায় হয়েছে, এটা অস্বীকার করব না।’ তাঁর মতে, আদর্শচ্যুতরা সময় হলে বিএনপি থেকে খসে পড়বে এবং তরুণ নেতৃত্ব সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বিএনপি আবারও ঘুরে দাঁড়াবে।
দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, প্রতিষ্ঠার ৩৬ বছরে বিএনপি এ দেশকে কিছুই দেয়নি এমন নয়। এ দল নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টির পাশাপাশি দেশের আজকের এই উন্নয়নেও যথেষ্ট অবদান রেখেছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, ১৯৪৮ সালে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে দলটির ব্যাপক ভরাডুবি হয়। এরপর ১৯৯১ ও ২০০১ সালের নির্বাচনেও বিএনপির কাছে পরাস্ত হয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু সময়ে আবার তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তেমনি বিএনপি আজ গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ করছে। তৃণমূলে বিএনপি এখনো সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। নোমান বলেন, বিএনপি বিপর্যয়ের মুখে- এ কথা নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখলে হবে না। কারণ এটি যতটা না বাস্তব এর চেয়ে বেশি সরকারের প্রপাগান্ডা। কারণ সংবিধান সংশোধন ও গণতান্ত্রিক চরিত্র বদল করে সরকার টিকে আছে। বিএনপিকে তারা দুর্বল করার চেষ্টা করছে। কিন্তু বিএনপি যে দুর্বল হয়নি এর প্রমাণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন।
দল চলছে একক কর্তৃত্বে : ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বিভিন্ন দল, মত ও পথের অনুসারীদের এক মঞ্চে এনে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। দলটির ৩৬ বছরের ইতিহাসে প্রথম চার বছর জিয়াউর রহমান এবং এরপর গত ৩২ বছর যাবৎ খালেদা জিয়াই নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। সর্বশেষ ২০০৯ সালের জাতীয় কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে তিনি দলটির চেয়ারপারসনের ম্যান্ডেট নেন। দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিন বছর অন্তর কাউন্সিল করার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। গত কয়েক বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সম্ভব হচ্ছে না দলটির নির্বাহী কমিটির সভা করাও। নির্বাহী কমিটির সর্বশেষ সভা হয়েছিল ২০১২ সালের জুলাই মাসে।
বস্তুত বিএনপি চলছে চেয়ারপারসনের একক কর্তৃত্বে। আন্দোলনের কর্মসূটি প্রণয়ন থেকে শুরু করে তা বাস্তবায়নের তদারকি, গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কাউকে পদায়ন, বহিষ্কার, এমনকি বৈঠক ডাকা পর্যন্ত চেয়ারপারসনের একক কর্তৃত্বে হচ্ছে। ফলে সব মিলিয়ে ভালো-মন্দের দায়ও চেয়ারপারসনের ওপরই বর্তায়।
সূত্র: কালের কণ্ঠ