৯৭,০০০ কোটি টাকার এডিপি অনুমোদন
মন্ত্রীদের দাবি বিবেচনায় নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া বরাদ্দের চেয়ে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে আগামী অর্থবছরের জন্য ৯৭ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অনুমোদন দিল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ বা এনইসি। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেওয়া হবে ৬২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আর বাকি ৩৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া যাবে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর শেরে বাংলানগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত এনইসি সভায় নতুন এডিপির আকার অনুমোদন দেওয়া হয়। সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সভাপতিত্ব করেন। রাজউক, বিমান, পেট্রোবাংলা ও শিপিং করপোরেশনের মতো সরকারের যেসব স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা আছে, আগামী অর্থবছরে সেসব সংস্থার অনুকূলে তিন হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে এনইসি। সংস্থাগুলোর নিজস্ব তহবিল থেকে এই টাকা খরচ হবে বলে এডিপিতে তাদের জন্য কোনো বরাদ্দ থাকছে না।
সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুুস্তফা কামাল এক সংবাদ সম্মেলেন বলেন, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও এডিপি মিলে গতকালের এনইসিতে মোট এক লাখ ৯৯৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি মাইলফলক।
গতকালের এনইসি সভায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ২০০৯ সালে এডিপির আকার ছিল ৩০ হাজার কোটি টাকা। ছয় বছরের ব্যবধানে তা বেড়ে এক লাখ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশের যে জায়গায় যেতে ২৭ বছর লাগে, বাংলাদেশ সেটা ছয় বছরেই করে দেখিয়েছে। এটি একটি রেকর্ডও বটে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর অদক্ষতা, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার অর্থছাড়ে অনীহা ও রাজস্ব আদায়ের অপ্রতুলতার বিষয়টি মাথায় রেখে আগামী অর্থবছরের এডিপিতে ৯২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা রাখার প্রস্তাব দেয় অর্থ বিভাগ। গতকালের এনইসি সভায় অর্থ বিভাগের প্রস্তাব উত্থাপন করেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। কিন্তু অর্থ বিভাগের এই বরাদ্দকে অপ্রতুল উল্লেখ করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ বিভাগ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিব বাড়তি বরাদ্দের দাবি জানান। বরাদ্দ করা টাকায় গৃহীত ও চলমান প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না উল্লেখ করে আগামী অর্থবছরের এডিপিতে ৯৮ হাজার কোটি টাকা রাখার দাবি জানানো হয় সভায়। মন্ত্রীদের দাবির যৌক্তিকতা মেনে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ক্ষমতাবলে অর্থ বিভাগের বরাদ্দের চেয়ে আরো সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ৯৭ হাজার কোটি টাকার এডিপির চূড়ান্ত অনুমোদন দেন। গতকাল বিকেলেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বাড়তি সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগ বাড়তি এক হাজার কোটি টাকা পেয়েছে। আর সড়ক বিভাগ পেয়েছে ৮০০ কোটি, রেলওয়ে ৩২০ কোটি, কৃষি ১৫০ কোটি, স্বরাষ্ট্র ১৬৭ কোটি টাকা।
বিতর্ক থেকেই গেল মূল এডিপিতে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর অর্থ অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে বিতর্ক রয়েই গেল। এডিপির আকার বড় করে দেখানোর জন্য বছর তিন আগে প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার অর্থ এডিপির সঙ্গে যোগ করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু অর্থ বিভাগ প্রতিবছর যে বাজেট ডকুমেন্ট তৈরি করে তাতে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার জন্য বরাদ্দকৃত টাকা যোগ করা হয় না। এসব সংস্থার অধীনে চলমান ১২৫টি প্রকল্পও মূল এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। এসব প্রকল্প পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নজরদারির বাইরে থেকে যায়। ফলে ব্যয় নিয়ে এসব সংস্থার জবাবদিহি যেমন থাকে না, তাদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের দায়িত্বও কেউ নিতে চায় না। গত দুই অর্থবছর এই বরাদ্দকে এডিপির বাইরে আলাদাভাবে দেখানো হচ্ছে।
কোন খাতে কত বরাদ্দ : পদ্মা সেতুর গুরুত্ব বিবেচনায় আগামী অর্থবছরের এডিপিতে পরিবহন খাতে সর্বোচ্চ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পরিবহন খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২১ হাজার ৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে পদ্মা সেতুর জন্য রাখা হয়েছে সাত হাজার ৫০০ কোটি টাকা। পরিকল্পনামন্ত্রী জানিয়েছেন, আগামী অর্থবছরেই পদ্মা সেতুর কাজে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আসবে।
বিদ্যুৎ খাতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিসহ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন নির্মাণের জন্য এ খাতে ১৬ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ভৌত পরিকল্পনা, পানি সরবরাহ ও গৃহায়ণ খাতে তৃতীয় সর্বোচ্চ ১১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে থাকবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সিটি করপোরেশনের অবকাঠামো উন্নয়ন।
বরাদ্দের দিক দিয়ে চতুর্থ অবস্থানে শিক্ষা ও ধর্ম এবং স্বাস্থ্য, পুষ্টি, জনসংখ্যা ও পরিবারকল্যাণ খাতে পঞ্চম সর্বোচ্চ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গতকালের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রপ্তানির ক্ষেত্রে পাটজাত পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানিতে গুরুত্ব দিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।
মোট প্রকল্প ৯৯৮টি : আগামী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের এডিপিতে বরাদ্দসহ অন্তর্ভুক্ত মোট প্রকল্প রাখা হয়েছে ৯৯৮টি। এর মধ্যে বিনিয়োগ প্রকল্প ৮৫৪টি, কারিগরি সহায়তা প্রকল্প ১৩২টি, জেডিসিএফ (জাপানি ঋণ মওকুফ তহবিল) অর্থায়িত প্রকল্প ১২টি। এ ছাড়া স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা অথবা করপোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন ১২৫টি প্রকল্প রয়েছে।
এবারের এডিপিতে বরাদ্দ ও অনুমোদনবিহীন নতুন প্রকল্পের সংখ্যা ৮৫৭।
আগামী বছরের পুরো সময়ে এসব প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হবে। অন্যদিকে এডিপিতে বৈদেশিক সাহায্যপ্রাপ্তির লক্ষ্যে বরাদ্দবিহীন অননুমোদিত নতুন প্রকল্প রাখা হয়েছে ৩৬৮টি। সরকার আশা করছে, এসব প্রকল্পে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া যাবে।
মেয়াদোত্তীর্ণ প্রকল্প : আগামী জুনের মধ্যে যেসব প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু শেষ হবে না- এ ধরনের মেয়াদোত্তীর্ণ প্রকল্পকে তারকা চিহ্ন দিয়ে এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসব প্রকল্পের মেয়াদকাল বৃদ্ধি ছাড়া অর্থছাড় ও ব্যয় করা যাবে না। গতকালের সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এডিপিতে এ রকম প্রকল্পের সংখ্যা ২০৯।
এর ফলে এসব প্রকল্পের মেয়াদ ও অর্থ দুটিই বাড়ছে।
আগামী অর্থবছরে শেষ হতে পারে- এমন প্রকল্পের সংখ্যা রাখা হয়েছে ৩২৪।
এ ছাড়া প্রতিবারের মতো এবারও ধারাবাহিকভাবে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির মাধ্যমে বাস্তবায়নের জন্য ৪০টি সংযোগ প্রকল্প রাখা হয়েছে। এসব প্রকল্প মূল পিপিপি প্রকল্পকে সহযোগিতা করবে।