বিপাকে দক্ষিণ এশিয়া, ক্ষুদ্ধ মালয়েশিয়া
ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের হাজার হাজার নাগরিক ইউরোপে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করাকে কেন্দ্র করে সেখানকার মিডিয়া এবং রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে বিতর্ক ও দ্বন্দ্ব আছে।
কিন্তু এবার ইউরোপ নয়, দক্ষিণ এশিয়া নিজেরাই নিজেদের অভিবাসীদের নিয়ে বিপাকে পড়েছে। এ অভিবাসী ইস্যু নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো দৃশ্যত কঠোর অবস্থান নিয়েছে। কোনো অবৈধ অভিবাসীকেই নিজেদের দেশের সীমানা অতিক্রম করতে দিতে স্পষ্টত বিপক্ষে অবস্খান নিয়েছে দেশগুলো, দিনের পর দিন সমুদ্রে ভাসতে থাকা হাজার হাজার নির্যাতিত ও নিরীহ মানুষ যার মাশুল গুনছে।
এ সমস্যার অন্যতম কারণ মিয়ানমারে নির্যাতিত রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমারের দীর্ঘদিনের নির্যাতনের ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দেশটির ডেপুটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ওয়ান জুনাইদি টুনাকু জাফর।
এ সপ্তাহেই মালয়েশিয়া এরকম দুটি অভিবাসীবাহী নৌকা তাদের উপকূল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, যেগুলোতে অন্তত ৬০০ অভিবাসী ছিল এবং যাদের অনেকেই শারীরীকভাবে খুবই খারাপ অবস্থায় ছিল। একই কাজ করেছে থাইল্যান্ড এবং ইন্দোনেশিয়াও। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর এ কঠোর অবস্থান পুনরায় অভিবাসী ইস্যুতে বিশ্বনেতাদের কপালের ভাঁজ আরো বাড়ছে। সাম্প্রতিক এসব ঘটনা প্রমাণ করছে, অভিবাসী সমস্যা আর বিশ্বে ছোট কোনো সমস্যা নয়।
মালয়েশিয়া সরকার অভিবাসী নৌকা ফিরিয়ে দেযার কথা স্বীকার করে সরকারি এক বিবৃতিতে বলেছে, সম্প্রতি দেশটির ল্যাঙ্কাউই ও পেনাং দ্বীপের কাছে আসা দুটি নৌকাকে পুনরায় সাগরে পাঠিয়ে দিয়েচে। এছাড়া দেশটি এ ধরনের অভিবাসীদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান জানিয়ে বলেছে, মালয়েশিয়ার আর এ ধরনের অভিবাসী গ্রহণের জন্য প্রস্তুত নয়।
মালয়েশিয়ার ফেরত পাঠানো এ দুটি নৌকা পরে থাই উপকূলে ভিড়তে চাইলে সেকানকার কর্তৃপক্ষও তাদের সাথে একই আচরণ করে। এ নৌকাগুলোতে ইংরেজিতে লেখা একটি ব্যানারে লিখা আছে, নৌকার অধিকাংশ মিয়ানমারের নির্যাতিত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম।
নৌকাটিতে থাকা একজন রোহিঙ্গা তাদের নিজস্ব ভাষায় চিৎকার করে প্রতিবেদককে বলছিলেন, আমাদের ১০ জন সঙ্গী মারা গেছে। আমরা তাদের লাশ সাগরে ফেলে দিয়েছি। দুই মাস ধরে এভাবে সাগরে বাসছি আমরা। খাবার, পানি কিছুই নেই। আমরা মালয়েশিয়া যেতে চাই।
সমুদ্রে ভাসতে থাকা এসব মানুষদের মধ্যে অনেক নারী ও শিশু আছে, যাদের অবস্থা খুবই সঙ্গীন। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে এখনো প্রায় ছয় হাজার অভিবাসী সমুদ্রে বাসমান অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে, যারা কোথাও ভিড়তে পারছে না। জাতিসংঘ বলছে, এসব অভিবাসীদের প্রতি যে অসহযোগীতা করা হচ্ছে, তা অচিরেই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
মানবাধিকার সংস্থগুলো বলছে, এ অভিবাসীরা ক্ষুধা, ডিহাইডেশন, দুর্বলতাসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভুগছে। আর এসবের জন্য দায়ি আঞ্চলিক দেশগুলো যারা এ ইস্যুতে অদায়িত্বশীলের মত আচরণ করছে এবং বিষয়টি ‘অন্যের সমস্যা’ বলে এড়িয়ে যাচ্ছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এশিয়ার ফিল রবার্টসন বলেছেন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার এসব মানুষদের নিয়ে কি করা যায় তা নিয়ে কাজ করার পরিবর্তে, তাদের নিয়ে ত্রিমুখী খেলা বন্ধ করা উচিত।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, স্রোতের টানে এসব মানুষ এখন মৃত্যুমুখে এসে দাঁড়িয়েছে। খাবার, পানিহীন এসব মানুষ নিজেরাও জানে না, তারা পৃথিবীর ঠিক কোন জায়গায় আছে।
এই সপ্তাহেই ইন্দোনেশিয়া তাদের উপকূল থেকে ৪০০ অভিবাসীবাহী যে নৌকাটিকে ফেরত পাঠিয়েছে, তার খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি। এ অভিবাসীদের ভাগ্যে কি ঘটেছে, তা এখনো নিশ্চিত নয়।
মালয়েশিয়ার ডেপুটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মনে করেন, মূলত বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক দুর্দশাই এ সমস্যার জন্য দায়ী। তিনি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, কিন্তু আমরা এতে কি করতে পারি? যারা আমাদের সীমান্ত অবৈধভাবে পাড়ি দেয়, তাদের সাথে আমরা মানবিক আচরণ করি। কিন্তু তাই বলে তো আমাদের সীমান্ত অবৈধ অভিবাসী দিয়ে ভরিয়ে ফেলতে পারি না।
তিনি বলেন, এটা ঠিক যে, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের সাথে যে ধরনের আচরণ করছে তা ঠিক নয়। আপনাকে গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলতে হবে। কিন্তু নিজেদের লোকজনদের সাথে আবর্জনা, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা বা সন্ত্রাসীসুলভ আচরণ করতে পারেন না। মালয়েশিয়া মিয়ানমারেকে অত্যন্ত পারিষ্কার একটি বার্তা দিতে চায় যে, রোহিঙ্গাদের সাথে মিয়ানমারের আরো মানবিক আচরণ করতে হবে।