বরগুনার তালতলীর পিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয় >>> জিন বধে পাঁঠা বলি
বরগুনার তালতলী উপজেলার পিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং সংলগ্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শতাধিক ছাত্রী গত এক মাসে অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এ ঘটনায় ইতিমধ্যে দুই শতাধিক ছাত্রী বিদ্যালয়ে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে জিনের আছর বলে মনে করছে। কবিরাজের পরামর্শে গত রবিবার রাতে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পাঁঠা বলি দেওয়া হয়েছে।
ছাত্রী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছাত্রীরা বিদ্যালয়ের সীমানায় ঢুকলেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। কেউ হাসে। কেউ কাঁদে। কেউ কেউ আবার নিজের চুল টেনে ছেঁড়ে। কেউ মূর্ছা যায়। আবার কেউ অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে। এ ঘটনায় বেকায়দায় পড়েন শিক্ষকরা। চরম ভীতির সৃষ্টি হয় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইতিমধ্যে ঝাড়ফুঁক এবং তদবিরের নামে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এক শ্রেণির প্রতারক চক্র।
এ রোগে অসুস্থ সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী নাহিদা আক্তারের মা মনিকা (৩০) বলেন, ‘এক মাস ধরে ওর স্কুল বন্ধ করে দিয়েছি। স্কুলে গেলেই এ সমস্যা তৈরি হয়। কখনো হাসে, কখনো কাঁদে, কখনো নিজের চুল টেনে ছিঁড়তে থাকে। এ সময় কেউ ধরতে গেলে তাকে খামচি কিংবা কামড় দেয়। তখন ওর গায়ে এত শক্তি থাকে যে চার-পাঁচজন মিলেও আটকে রাখা যায় না।’
মনিকা আরো বলেন, ‘স্থানীয় একাধিক ওঝা ও ফকিরের শরণাপন্ন হয়ে পাঁচ হাজার থেকে সাত হাজার টাকা আমার খরচ হয়ে গেছে। তবু অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। বাড়িতে যা একটু ভালো থাকে স্কুলে গেলেই পাগলামি দ্বিগুণ বেড়ে যায়।’
এদিকে রোগের গতি-প্রকৃতি বুঝে উঠতে না পেরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় এখন পিকে মাধ্যমিক ও সংলগ্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। গত কয়েক দিনে স্থানীয় ওঝার পাশাপাশি দূর-দূরান্ত থেকে ফকির এনে ঝাড়ফুঁক দেওয়া হয়েছে। গত রবিবার রাতে পাঁঠা বলিসহ নানা ফিকির-তদবিরের পরও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি।
এ বিষয়ে পিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘বুঝতে পারছি না, তাদের ডাক্তার দেখাব, নাকি ওঝা-কবিরাজ? এটা যদি নির্দিষ্ট কোনো রোগ হয়ে থাকবে তবে বাড়ি গেলেই সুস্থ আর স্কুলের সীমানায় এলেই অসুস্থ হবে কেন?’ তিনি বলেন, ‘ভূত-পেতনি অস্বীকার করলেও জিন তো আর অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ইসলাম ধর্মেই জিনের বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া আছে। এসব বিবেচনায় ইতিমধ্যে স্থানীয় ওঝা-কবিরাজসহ সর্বজন শ্রদ্ধেয় চলাভাঙ্গার পীর সাহেবের তদবির নেওয়া হয়েছে। তদবির নেওয়ার পর পরিস্থিতি খানিকটা উন্নতি হলেও এখনো অনেক শিক্ষার্থী অসুস্থ। বর্তমানে স্কুল বন্ধ রয়েছে। তাই বিষয়টি বোঝা যাচ্ছে না। স্কুল খুললে সব শিক্ষার্থী এলে বোঝা যাবে তারা সুস্থ হয়েছে কি হয়নি।’
পিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে পিকে স্কুল সুনামের সঙ্গে পরিচালিত হয়ে আসছে। মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয় মিলিয়ে প্রায় সাত শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। বার্ষিক ফলাফলের ক্ষেত্রেও অনেক এগিয়ে থাকে বিদ্যালয়টি। অথচ এ ঘটনায় এক মাস ধরে দুই শতাধিক ছাত্রী স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে এই বিদ্যালয়।’
তালতলী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘উপজেলা সদর থেকে একজন চিকিৎসক নিয়ে এ রোগের কারণ নির্ণয় করার চেষ্টা করেছি আমরা। তবে প্রকৃত বিষয়টি এখনো পুরোপুরি বোঝা যায়নি।’
আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মতিন জানান, গত ১৩ মে তিনি ওই বিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন। প্রতিটি শ্রেণির ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘ভূত, জিন বলে কোনো কথা নেই। বিষয়টি কিছুটা মানসিক, যা একেবারে সাময়িক। শুধু মেয়েরাই এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সবাইকে সচেতন হতে হবে। ইতিমধ্যে স্কুলটি গ্রীষ্মের ছুটির কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। আশা করা যাচ্ছে, ছুটির পর এ সমস্যা আর থাকবে না।’
বরগুনার জেলা প্রশাসক মীর জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘ঘটনার পর থেকে আমি নিয়মিত ওই স্কুলের খবর রাখছি। তবে আগের থেকে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে।’