ব্যাংকারদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামোর সুপারিশ সচিব কমিটির
বারবার আমলাতন্ত্রের ফাঁদে আটকে গেলেও ব্যাংকারদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করতে পারেনি জাতীয় বেতন কাঠামো পর্যালোচনাকারী সচিব কমিটি। তাই মুলা ঝোলানোই হোক আর মন থেকেই হোক, প্রস্তাবিত বেতন স্কেলের চেয়ে আর্থিক সুবিধাদি বাড়িয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো প্রণয়নের সুপারিশ করেছে মন্ত্রিপরিষদসচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞার নেতৃত্বাধীন কমিটি।
অর্থমন্ত্রীর কাছে জমা দেওয়া সচিব কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে দক্ষ ও যোগ্য লোক দরকার। সে জন্য জাতীয় বেতন স্কেলের তুলনায় বর্ধিত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো প্রণয়ন আবশ্যক। তবে ব্যাংকগুলো বাদে অন্য সব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জাতীয় স্কেল অনুযায়ী বেতন-ভাতা দেওয়ার সুপারিশ সচিব কমিটির।
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় বেতন ও চাকরি কমিশনের সুপারিশে বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য আলাদা বেতন কাঠামোর সুপারিশ থাকলেও খেলাপি ঋণ আদায় করে দৃঢ় আর্থিক ভিত্তির ওপর দাঁড়ানোর পরই রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে অভিন্ন বেতন কাঠামো দেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন তিনি।
ওই বেতন কাঠামোর দিকে তাকিয়ে আছেন বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের ৬১ হাজারেরও বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী।
গত নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ ব্যাংক ও রাষ্ট্রায়ত্ত চার বাণিজ্যিক ব্যাংকের বেতন কাঠামোর খসড়া চূড়ান্ত হয়েছিল। তখন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রজ্ঞাপন জারি করার দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করে ঘোষণা দিয়েছিলেন। ২০১৩ সালের নভেম্বরে প্রজ্ঞাপন জারির আগ মুহূর্তে হঠাৎ করেই আইন মন্ত্রণালয় আপত্তি তুলে বলে, ‘চাকরি পুনর্গঠন ও শর্তাবলি আইন, ১৯৭৫’ অথবা ব্যাংক কম্পানি আইন, ১৯৯১ সংশোধন না করে বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো দেওয়া যাবে না। কিন্তু কোন আইনে কিভাবে পরিবর্তন আনলে এটা সম্ভব তা জানতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান ব্যক্তিগতভাবেও আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে টেলিফোন করেন। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয় স্পষ্ট কোনো মতামত দেয়নি।
২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দিন দুপুরেও অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দেন যে দু-এক দিনের মধ্যেই ব্যাংকের নতুন বেতন কাঠামোর প্রজ্ঞাপন হবে। কিন্তু তাতে আপত্তি জানিয়ে আইন মন্ত্রণালয় বলে, তফসিল হয়ে যাওয়ায় নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারো বেতন-ভাতা বাড়ানোর সুযোগ নেই। আর চাকরি পুনর্গঠন ও শর্তাবলি আইন, ১৯৭৫ সংশোধন না করে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোও জারি করা যাবে না। এরপর নতুন সরকার আসার পর জাতীয় বেতন ও চাকরি কমিশন গঠিত হয়েছে; কিন্তু ব্যাংকের জন্য আলাদা বেতন কাঠামোর বিষয়টি আড়ালেই রয়ে গেছে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা থাকলেও খেলাপির ভারে নুয়ে পড়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে রক্ষায় গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় বেতন ও চাকরি কমিশন বলেছে, ‘এ দেশে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার স্বার্থে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর জন্য ব্যাংকিং নীতিমালার আওতায় স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রবর্তনের দাবি রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক দায়দেনা ও সম্পদের হিসাবে দেখা যায়, এসব প্রতিষ্ঠান বড় ধরনের খেলাপি ঋণে ভারাক্রান্ত। তাই কমিশন পূর্ববর্তী কমিশনের মতো মনে করে যে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যত দিন পর্যন্ত না এসব দায়ভার সম্পূর্ণভাবে পুনরুদ্ধার করে আর্থিক সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হবে এবং সম্পূর্ণভাবে নিজেদের আয়ের দৃঢ় ভিত্তির ওপর নির্ভরশীল হবে তত দিন পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতাদি সরকারি বেতন কাঠামোর অনুরূপ রাখা প্রয়োজন।’