এনবিআরের নজরদারিতে বেসরকারি স্কুল-কলেজ
বেসরকারি স্কুল-কলেজগুলো প্রকৃত আয় গোপন করে আয়কর ফাঁকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এ সব প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয় খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
এ জন্য মাঠ পর্যায় থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
এনবিআরের তথ্য মতে, ১৪০টি বেসরকারি স্কুল ২০১৪-১৫ আয়কর বর্ষে রিটার্ন জমা দিয়েছে। এর বিপরীতে কর দিয়েছে ৫৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা। ২৮টি কলেজ দিয়েছে ৬ কোটি ৭৩ লাখ আয়কর। এ ছাড়া বেসরকারি ৫২টি বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েছে ৮৪ কোটি টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে প্রায় ১৮ হাজার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল রয়েছে। নীতিমালা না থাকায় এ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনোটির ফি লাখ টাকার বেশী। এর সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ফি।
এনবিআর সূত্র জানায়, বেসরকারি স্কুল-কলেজের অধিকাংশ বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত হলেও নিয়ম মেনে কর দিচ্ছে না। আবার এ সব প্রতিষ্ঠানের একাধিক শাখা থাকলেও সে সব শাখার আয় ঠিকমতো রিটার্নে প্রদর্শন করছে না। তাই এ সব প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত আয়-ব্যয় খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর।
সম্প্রতি বেসরকারি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল এবং ‘স্কুল এ্যান্ড কলেজ’কে তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে নীতিমালা তৈরী করা হচ্ছে। ‘এ’ ক্যাটাগরির প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে মহানগর এলাকায় সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা ভর্তি ও সেশন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। মহানগরের বাইরে তা হবে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা। ‘এ’ ক্যাটাগরির প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বেতন মহানগর এলাকায় তিন হাজার টাকা ও মহানগরের বাইরে সর্বোচ্চ দেড় হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ৭০০ বা তার বেশী শিক্ষার্থী এবং মানসম্মত শিক্ষক, শিক্ষা উপযোগী অবকাঠামোসহ আনুষঙ্গিক সুবিধা থাকলে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘এ’ ক্যাটাগরিতে পড়বে।
‘বি’ ক্যাটাগরির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও সেশন ফি মহানগর এলাকায় সর্বোচ্চ ১৮ হাজার টাকা এবং মহানগরের বাইরে সর্বোচ্চ সাত হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। মহানগর এলাকায় সর্বোচ্চ বেতন দুই হাজার টাকা এবং মহানগরের বাইরে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা, ৪০০-৬৯৯ শিক্ষার্থী এবং মানসম্মত শিক্ষক, শিক্ষা উপযোগী অবকাঠামোসহ অন্যান্য সুবিধা থাকলে ‘বি’ ক্যাটাগরি ধরা হবে।
চার শ’র নীচে শিক্ষার্থী থাকলে ওই প্রতিষ্ঠান ‘সি’ ক্যাটাগরিতে পড়বে। এ ক্যাটাগরিতে মহানগর এলাকায় সর্বোচ্চ আট হাজার টাকা ভর্তি ও সেশন ফি এবং মহানগরের বাইরে সর্বোচ্চ চার হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ‘সি’ ক্যাটাগরির প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মহানগর এলাকায় সর্বোচ্চ বেতন দেড় হাজার টাকা এবং বাইরের জন্য সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। শিগগিরই এ নীতিমালা চূড়ান্ত করে পরিপত্র আকারে প্রকাশ করা হবে।
সূত্র আরও জানায়, গণমাধ্যমে এ সব ইংলিশ মিডিয়াম ও বেসরকারি কলেজের আয়ের খবর প্রকাশিত হলেও সে অনুযায়ী আয় দেখানো হচ্ছে না। ছাত্র প্রতি যে পরিমাণ সেশন ফি ও ভর্তি ফি আদায় করা হয় তার প্রতিফলন প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়কর রিটার্নে দেখানো হচ্ছে না। ধারণা করা হচ্ছে, এ খাতে বিপুল পরিমাণ আয়কর ফাঁকি দেওয়া হয়। তাই কর ফাঁকি বন্ধে এ সব স্কুলগুলোকে মনিটরিংয়ের চিন্তা করা হচ্ছে। প্রয়োজনে ওইসব স্কুলগুলোতে সরেজমিনে পরিদর্শনের মাধ্যমে অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনা করে স্কুলগুলোর আয় নির্ধারণ করা হবে। পরবর্তী সময়ে সেই আয়ের ওপর কর নির্ধারণ করা হবে।
এ প্রসঙ্গে কর প্রশাসন ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার সদস্য আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘করজালের বাইরে রয়েছে এমন সব প্রতিষ্ঠান শনাক্ত করে করের আওতায় আনা হচ্ছে। আর যারা করজালের আছে তাদের অডিটের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘করদাতা স্কুল-কলেজের সংখ্যা আরও বাড়ানোর সুযোগ আছে। এ খাত থেকে আরও বেশী রাজস্ব আদায় সম্ভব। এ জন্য মাঠ থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তালিকা সংগ্রহ করা হচ্ছে।’
ঢাকার অভ্যন্তরে কার্যক্রম পরিচালনাকারী স্কুল-কলেজ, কোচিং সেন্টার, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ্যাসোসিয়েশন অব পারসন (এওপি) হিসেবে কর অঞ্চল-১১ এর অধিক্ষেত্রভুক্ত। অর্থাৎ কর অঞ্চল-১১-এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আয়কর রিটার্ন দাখিল করে। এ সব প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিশ্রেণীর করহারে আয়কর দিয়ে থাকে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, বছরে ২ লাখ ২০ হাজার টাকার নীচে আয় হলে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কর দিতে হবে না। শুধু রিটার্ন দাখিল করলেই চলবে। পরবর্তী ৩ লাখ পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ১০ শতাংশ, পরবর্তী ৪ লাখ পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ, পরবর্তী ৫ লাখ পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ২০ শতাংশ, পরবর্তী ৩০ লাখ পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ২৫ শতাংশ এবং আয় ৪৪ লাখ টাকার বেশী হলে ৩০ শতাংশ আয়কর দেওয়ার বিধান রয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ আয়কর দিতে হয়।
একই সূত্রে জানা যায়, ২০১৪-১৫ করবর্ষে সর্বোচ্চ আয়কর প্রদানকারী ৫টি স্কুলের সবচেয়ে বেশী কর দিয়েছে এসটিএস এডুকেশন গ্রুপ। ৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা। সানিড্যাল প্রাইভেট লিমিটেড আয়কর দিয়েছে ৩ কোটি ৯২ লাখ টাকা। স্কলাসটিকা লিমিটেড ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা। স্যার জন উইলসন স্কুল দিয়েছে ১ কোটি ২৭ লাখ টাকা। সাউথ ব্রীজ স্কুল আয়কর দিয়েছে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশী আয়কর দিয়েছে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি। ৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি দিয়েছে ২ কোটি ৮৫ লাখ, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউভার্সিটি দিয়েছে দেড় কোটি, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ দিয়েছে ১ কোটি ৪২ লাখ। গণবিশ্ববিদ্যালয় আয়কর দিয়েছে ৮৬ লাখ ৬৩ হাজার টাকা।