মুক্তিপণের টাকা যায় লাইলী ও এমআর ট্রেডার্সের এ্যাকাউন্টে
মানবপাচারকারীদের দাবি করা মুক্তিপণের টাকা দু’টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পাঠান হয়। এ কাজে চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার একজন কনসালটেন্ট ইঞ্জিনিয়ার জড়িত বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এ সব চাঞ্চল্যকর তথ্য। চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার কনসালটেন্ট ইঞ্জিনিয়ার জড়িত! মালয়েশিয়া থেকে ফেরত আসা পাটকেলপোতা গ্রামের মাসুদ রানা দ্য রিপোর্টকে জানান, মেহেরপুর জেলায় মানবপাচারকারী চক্রের সদস্য হিসেবে কাজ করছেন শিংহাটি গ্রামের মালয়েশিয়া প্রবাসী ইমাদুল। এ ছাড়া ইমাদুলের শ্যালক চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার কর্মকর্তা রিপন মানবপাচারকারীদের সাথে যুক্ত। রিপন চুয়াডাঙ্গা পৌরসভায় কনসালটেন্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত। ছুটিতে মালয়েশিয়া থেকে গ্রামে ফেরা ইমাদুল অবশ্য এ সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তার দাবি, তিনি লোক পাঠানোর কাজ করেন না। তবে ইমাদুলের দাবি, তাদের এলাকার তিন-চারজন ছেলে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে দালালদের কাছে আটকা পড়লে তাদের ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করেন স্বজনরা। তাদের অনুরোধে মালয়েশিয়ার একটি ফার্মে কাজ করা বার্মার কয়েকজন লোকের সাহায্য নিয়ে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে অবস্থান করা দালালদের সাথে যোগাযোগ করে ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করেন। দালালদের দাবি করা টাকা তাদের দেওয়া লাইলী ও এমআর ট্রেডার্সের এ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়েছে বলেও দাবি করেন ইমাদুল। তিনি জানান, তিনজনের জন্য সাড়ে ছয় লাখ টাকা তার শ্যালক চুয়াডাঙ্গা পৌরসভায় কনসালটেন্ট ইঞ্জিনিয়ার রিপনের কাছে দিলে তিনি চুয়াডাঙ্গা ইসলামী ব্যাংক থেকে তাদের ওই এ্যাকাউন্টে পাঠান। মেহেরপুরের পুলিশ সুপার হামিদুল আলম জানান, মানবপাচারকারীদের কোনো ছাড় নেই। কঠোর হস্তে তাদের দমন করা হবে। এই ঘৃণ্য কাজ থেকে পরিত্রাণ পেতে জনগণকে সচেতন হবার আহ্বানও জানান তিনি। যারা পাচারকারী অনুসন্ধানে জানা যায়, জেলায় পাচারকারী চক্রের সদস্য হিসেবে কাজ করছেন গাংনী উপজেলার তেরাইল গ্রামের আব্দুল গনির ছেলে জাহাঙ্গীর হোসেন, হেমায়েতপুর গ্রামের জাহিদ হোসেন, খড়মপুর গ্রামের আলী হোসেন, সদর উপজেলার শিংহাটি গ্রামের ইমারুল, মোশারফের ছেলে সাজিবুলএবং শিংহাটি গ্রামের মালয়েশিয়া প্রবাসী ইমাদুল। অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ঢাকার আদম ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন অবৈধভাবে বিদেশ পাঠানোর মূল হোতা। তার বাড়ি যশোর জেলায়। তার সহযোগী মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার কসবা গ্রামের বদর উদ্দিনের ছেলে আব্বাস আলী। আর আব্বাস আলীর সহযোগী হয়ে কাজ করছে মেহেরপুর সদর উপজেলা ইছাখালী গ্রামের সাদের ও সিদ্দিক। এ ছাড়া শৌলমারী ও ভিটেরমাঠে কাজ করছেন জহিরুল ইসলাম, গাংনী উপজেলার খড়মপুর গ্রামের আহম্মদ আলী ও সদর উপজেলা ভিটের মাঠ গ্রামের আদম বেপারী জহিরুল ইসলাম গ্রামের যুবকদের অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় পাঠায়। লাইলী-মঞ্জু-আসলামের বন্দীশালা দালালদের খপ্পরে বাড়ি ছেড়েছিলেন শিংহাটি গ্রামেরতুহিন হোসেন। টেকনাফে দালালদের বন্দীদশা থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন তিনি। ভয়াবহ সেই যাত্রার বর্ণনা করেন তিনি। তুহিন জানান, মেহেরপুর থেকে সড়কপথে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় টেকনাফে। সেখানে যুবকদের রাখা হয় স্থানীয় দালাল লাইলী, মঞ্জু ও আসলামের বাড়িতে। বাড়িগুলো পলিথিনে ছাওয়া এবং বেড়া দিয়ে ঘেরা। এক একটি বাড়িতে ৫০ থেকে ৬০ জনকে জড়ো করা হয়। টেকনাফের ওইসব বাড়িতে ঢুকলে বেরিয়ে আসার আর কোনো সুযোগ থাকে না। অস্ত্রধারী ব্যক্তিরা বাড়িগুলো সব সময় পাহারা দেয়। এরপর একসাথে রাতের আঁধারে ট্রলারে তোলা হয়। এক একটি ট্রলারে তিন থেকে চার শ’ লোক নিয়ে যায়। ট্রলারে তোলার আগে সবার কাছ থেকে মোবাইল ফোন, ঘড়ি, টাকা-পয়সা সব কেড়ে নেওয়া হয়। ভয়াবহ সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন বন্দীদশা থেকে পালিয়ে আসা আরেক যুবক দেলোয়ার হোসেন। দেলোয়ার জানান, টেকনাফ থেকে যুবকদের ট্রলারে করে থাইল্যান্ডের পাহাড়ের উপর জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে নেওয়া হয় থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া সীমান্তে। ওই এলাকায় সবসময় তিন-চার হাজার করে লোক থাকে। সবখানেই অস্ত্রধারী লোকজন পাহারা দেয়। সীমান্ত এলাকার পাহাড়ি জঙ্গলের মধ্যে আটকে রেখে বাড়িতে ফোন করে দাবি করা হয় মুক্তিপণ। টাকা না পাঠালে চালানো হয় নির্যাতন। মারা গেলে লাশ পুঁতে ফেলা হয়। দালালদের টার্গেট অনুসন্ধানে জানা যায়, মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যরা গ্রামের নিম্ন আয়ের মানুষকে তাদের টার্গেট হিসেবে বেছে নেয়। কৃষক, রাজমিস্ত্রীও বেকার যুবকদের অল্প টাকার মাধ্যমে বিদেশ পাঠানো ও বেশী বেতনের কাজসহ বিদেশ গিয়ে কাজ করে টাকা শোধের লোভ দেখায়।
ওদের খোঁজ মেলেনি : সম্প্রতি থাইল্যান্ডসহ সাগর থেকে বাংলাদেশী উদ্ধারের খবরে নিখোঁজদের পরিবারে নিখোঁজ ব্যক্তিকে ফিরে পাওয়ার আশা জেগেছে। যারা নিখোঁজ রয়েছেন তাদের পরিবারে চলছে কান্নার রোল। মেহেরপুরের মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যদের ফাঁদে পা দিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন শতাধিক পরিবার। এদের মধ্যে নিখোঁজ রয়েছে অন্তত অর্ধশত। মারা গেছে বলে খবর প্রচার হয়েছে চারজনের। এরা হলেন— গাংনী উপজেলার তেরাইল গ্রামের মামুন (২৫), সদর উপজেলার পাটকেলপোতা গ্রামের আলামীন হোসেন (৩২), শিংহাটি গ্রামের আতিয়ার রহমান (৩৮) ও ঝাঁঝাঁ গ্রামের আনারুল ইসলাম (৪০)।