দুবাইয়ে দেহ ব্যবসার শিকার নারী : সাত আসামির বিচার শুরু
দুবাইয়ে দেহ ব্যবসার শিকার হয়ে দেশে ফেরা এক নারীর দায়ের করা মানবপাচার এবং নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় সাত আসামির বিচার শুরু হয়েছে।
ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক জেসমিন আরা হক বৃহস্পতিবার আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে জামিনে থাকা তিন আসামির জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। বাকি চারজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
ভুক্তভোগী ওই নারীর মামলা তদারকিতে ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সালমা আলী।
বাদীর আইনজীবী ফাহমিদা আক্তার শিমু বৃহস্পতিবার বিকেলে বলেন, ‘তদন্তকারী সংস্থা সিআইডির অভিযোগপত্র দেওয়ার পর আদালতে বৃহস্পতিবার প্রথম শুনানি ছিল। সংশ্লিষ্ট মিনার এয়ার ট্র্যাভেলস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেন, তার দুই সহযোগী দেলোয়ার হোসেন ও মোতালেব হোসেনের নাম অভিযোগপত্রে থাকলেও বাকি চারজনের নাম বাদ দেওয়া হয়েছিল। অভিযোগপত্র দেওয়ার আগেই জামিনে থাকা মূল অভিযুক্ত আনোয়ার হোসেনসহ তিনজন আজ (বৃহস্পতিবার) জামিন বৃদ্ধির জন্য আদালতে উপস্থিত হন। কিন্তু আদালত তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। অপর আসামিদের বিরুদ্ধেও বাদী সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করেছেন তাই আদালত বাকি চারজনের অপরাধও আমলে নিয়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘সাত আসামির বিরুদ্ধে নারীপাচারের ৭ ও ৮ ধারায় এবং ৯/১ ধারায় নারী ও শিশু নির্যাতনের পৃথক দুটি মামলার অভিযোগ আদালত আমলে নিয়েছেন। এর মধ্যে ট্রাভেল এজেন্সির মালিক আনোয়ার হোসেন দুটি মামলারই এক নম্বর আসামি। বাকি ছয়জন শুধু মানবপাচার মামলার আসামি। মানবপাচার মামলায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এবং নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলায় শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।’
ফাহমিদা আক্তার শিমু আরও বলেন, ‘পরোয়ানা জারি হওয়া আসামিদের গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করতে হবে। তা না হলে পলাতক ধরেই তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হবে।’
গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়া চারজনের মধ্যে সাইফুল ইসলাম অভিযুক্ত মিনার এয়ার ট্রাভেলসের স্বত্ত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেনের নিকটাত্মীয়। তিনি দুবাইয়ে থাকেন এবং সেখানে বাংলাদেশী নারীদের নিয়ে দেহব্যবসা করান বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে। বাকি তিনজন হলেন- ঢাকার দালালচক্রের সদস্য সাঈদ হোসেন, শহিদ হোসেন ও শেখ নিজামুল কবির (নিজাম)।
গত বছর (২০১৪) কুষ্টিয়ার ‘এস’ আদ্যক্ষরের ওই নারীকে পাচার করে দুবাই নিয়ে গিয়ে দেহ ব্যবসায় বাধ্য করা হয়। শুধু তাই নয়, সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশী ট্রাভেল এজেন্সির স্বত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেনের পাশবিকতারও শিকার হন তিনি। আর দুবাইয়ে গিয়ে প্রথম আনোয়ার হোসেনের আত্মীয় সাইফুল ইসলামের পাশবিকতার শিকার হন ওই নারী। এর পর তার ওপর নেমে আসে ধারাবাহিক পাশবিক নির্যাতন।
নির্যাতনের শিকার হতভাগ্য এ নারী ও তার পরিবার এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মিনার এয়ার ট্র্যাভেলস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেনসহ বাকি দালালচক্রের বিরুদ্ধে পল্টন থানায় মামলা করতে গেলেও তা প্রথমে নেয়নি পুলিশ। পরে আদালত পল্টন থানাকে মামলা নেওয়ার নির্দেশ দেন এবং পরবর্তীতে মামলার তদন্তভার সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়।
মামলার এজাহার এবং ভুক্তভোগী হতভাগ্য ওই নারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ৯ জুন (২০১৪) তার দুবাইয়ে যাওয়ার দিন নির্ধারিত হয়। এর আগের দিন ৮ জুন মিনার ট্রাভেলসের মালিক আনোয়ার হোসেনের কথামতো স্বামী কবির হোসেনকে নিয়ে বিকেলে ফকিরাপুলে ওই ট্রাভেলসের অফিসে হাজির হন। সন্ধ্যার দিকে আনোয়ার কবিরকে বলেন, ‘অনেক দূর থেকে এসেছেন, আপনি চলে যান। আপনার স্ত্রী এখানেই অন্যদের সঙ্গে থাকবে। বিদেশে যাচ্ছে, ভাষাসহ আরও অনেক কিছু জানা দরকার তার। কাল ফ্লাইট (৯ জুন-২০১৪), রাতের মধ্যে এ সব শেখাতে হবে। আনোয়ারের কথায় চলে যান ‘এস’ আদ্যক্ষরের ওই নারীর স্বামী কবির। রাতে ওই নারীকে ধর্ষণ করেন আনোয়ার হোসেন।
পরদিন দুবাই পাঠিয়ে দেওয়া হয় ওই নারীকে। সাইফুল ইসলাম নামে আনোয়ার হোসেনের নিকটাত্মীয় (শ্যালক/সমন্ধী) দুবাই বিমানবন্দর থেকে তার অফিসে নিয়ে যান। রাতে ওই নারীকে সাইফুল ধর্ষণ করেন এবং পরদিন নাইজেরিয়ার নাগরিক এক দালালের কাছে তাকে বিক্রি করে দেন। সেখানে এক পতিতালয়ে রেখে তাকে দিয়ে টানা ৮ দিন দেহ ব্যবসায় জড়িত হতে বাধ্য করা হয়। এ কয়েক দিন তাকে ঠিকমতো খেতে দেওয়া হয়নি।
ওই নারী জানান, তার মতো পাখি, সুমি, রাজিয়াসহ আরও সাত বাংলাদেশী নারীকে সেখানে দেহ ব্যবসায় বাধ্য করা হচ্ছিল। তিনি আট দিনের মাথায় গোপনে দেশে যোগাযোগ করে বেঁচে আসতে পারলেও বাকিরা সেখানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
আনোয়ারের মাধ্যমেই ওই দেশে সাইফুল মেয়েদের নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেয় বলে ‘এস’ আদ্যক্ষরের ওই নারীর দাবি।
তিনি বলেন, ‘আনোয়ার বাংলাদেশ থেকে যে সব নারীকে দুবাইয়ে পাঠায় সাইফুল তাদের প্রথমে অফিসে নেয় এবং উপভোগ করে। এর পর বিভিন্ন পতিতালয়ে ওই সব নারীকে বিক্রি করে দেয়। আর এ কাজে সাইফুলের স্ত্রী পরিচয়দানকারী এক মহিলা সহযোগিতা করে।’
‘এস’ আদ্যক্ষরের ওই নারীর স্বামী ঝালকাঠি জেলার কবির হোসেন বৃহস্পতিবার বিকেলে বলেন, ‘ট্রাভেল এজেন্সির মালিক আনোয়ারের সঙ্গে আমাদের কোনো চেনাজানা ছিল না। পরিচয় ছিল ধোলাইপাড়ের দেলোয়ার ওরফে কালা দালালের সঙ্গে। সে আমার স্ত্রীকে আনোয়ারের মাধ্যমে দুবাইয়ে নিতে ক্লিনার ভিসা করে দেয়। বাকি আসামিরাও আনোয়ারকে সাহায্য করে। সরকারিভাবে আমার স্ত্রী এক মাস ট্রেনিংও দেয়। তাকে সার্টিফিকেটও দেয়। সরকারিভাবে গেল, এর পরেও তারে…।’
তিনি বলেন, ‘আদালত আমাদের সব অভিযোগ আমলে নিয়েছেন। এ জন্য আমরা খুশি। আশা করি ন্যায়বিচার পাব।’
তবে মিনার এয়ার ট্র্যাভেলসের স্বত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেন গত ৫ জুলাই তার বিরুদ্ধে ‘এস’ আদ্যক্ষরের ওই নারীর সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘ও’ (‘এস’ এর স্বামী কবির) কি আসলে বিদেশ পাঠানোর জন্য এ সব করে নাকি মানুষকে ব্লেইম দিয়ে টাকা পয়সা উদ্ধারের চেষ্টা করে। ওই মহিলার হাজব্যান্ডকে না দেখলে আপনি বুঝতে পারবেন না। ওর হাজব্যান্ড ঝালকাঠির আওয়ামী লীগের নেতা। এতবড় নেতা হয়ে তার ওয়াইফকে বিদেশে পাঠায় কেন?’
তিনি বলেন, ‘আমাকে ব্লেইম দিয়ে চক্রান্ত করে টাকা নেওয়ার ষড়যন্ত্র করছে তারা। সঠিক তথ্য নেওয়ার থাকলে নেন। আর কোনো মহিলা ধর্ষণ হলে গোপন রাখতে চায়। সে এভাবে প্রচার করছে যে, তার মান-সম্মানও নেই। দরকার হলে আমি জেলে যাব। তবে আমি আমার পথে সঠিক আছি।’
দুবাইয়ে অবস্থানরত সাইফুল ইসলাম আপনার আত্মীয় কিনা- জানতে চাইলে আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘না, তিনি ওখানে ব্যবসা করেন।’
প্রসঙ্গত, গত ৯ জুন সংযুক্ত আরব আমিরাতে যান কুষ্টিয়া সদরের হতভাগ্য ওই নারী। তিন দিনের মাথায় স্বামী কবির হোসেনকে ফোনে তার ওপর নির্যাতনের কথা জানিয়ে দেন। পরে কবির পল্টন থানা পুলিশের মাধ্যমে মিনার এয়ার ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেনকে চাপ দিয়ে ‘এস’-কে দেশে আনার ব্যবস্থা করেন।
গত বচরের ২৭ জুন ‘এস’ আদ্যক্ষরের ওই নারী দুবাই থেকে দেশে ফিরে আসেন। ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ১ জুলাই তাকে রিলিজ দেন চিকিৎসক। ডাক্তারি ছাড়পত্রে দুবাই ফেরত এই নারী ‘সেক্সুয়াল এ্যাসাল্ট’র শিকার বলে উল্লেখ করা হয়।