লাল টুকটুকে জামালপুরের শ্রীরামপুর
জামালপুর জেলা শহর থেকে আট কিলোমিটার দূরের গ্রাম শ্রীরামপুর। এটি সদরের শরিফপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত। শহরের প্রতিনিয়ত কোলাহল ও দূষিত পরিবেশের বাইরে অবস্থিত শ্রীরামপুর গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই সারি সারি লিচুগাছ। প্রতিটি গাছে থোকায় থোকায় লাল টুকটুকে লিচু ঝুলছে। এ যেন কৃষ্ণচূড়ার লাল পাপড়ি বিছানো চাদর। এমন দৃশ্য যেকোনো মানুষের নজর কেড়ে নেয়।
সরেজমিনে ওই গ্রামে গেলে কথা হয় অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক মো. আব্দুল মোতালেবের সঙ্গে। তিনি জানান, চাকরিজীবনের শুরুতেই আমি শখের বসে বাজার থেকে একটি লিচুগাছ কিনে বাড়িতে রোপণ করেছিলাম। সেই গাছ বড় হয়ে এখন বিরাট আকৃতি ধারণ করেছে।
তিনি জানান, প্রথম দিকে শখের বসে হলেও পর্যায়ক্রমে বাণিজ্যিকভাবে লিচু আবাদে মনোযোগী হই। বাড়ির সামনে-পিছনে, ডানে-বাঁয়ে মিলিয়ে বর্তমানে আমার দুই বিঘা জমিতে ১২০টি লিচুগাছ রয়েছে। চলতি ভরা মৌসুমে লাগানো প্রতিটি গাছেই লাল টুকটুকে লিচু ঝুলছে। বাড়ির চারপাশে পরিত্যক্ত জমি ফেলে না রেখে পরিকল্পিতভাবে এবং স্বল্পপরিশ্রম ও অল্পখরচে লিচুসহ অন্য ফলের চাষ করলে ধান-পাটের চেয়ে বেশি লাভবান হওয়া সম্ভব।
আব্দুল মোতালেব মাস্টার আরও জানান, গত বছর লিচু বিক্রি করে তিনি প্রায় দুই লাখ টাকা আয় করেছিলেন। এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় লিচুর ফলন ভালো হয়েছে। গতবারের চেয়ে লাভ কিছুটা বেশি হবে বলে তিনি আশাবাদী।
শ্রীরামপুর গ্রামের পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা পল্লীচিকিৎসক খাদেমুল ইসলাম বলেন, ‘বাড়িতে আমার ৪০টি লিচুগাছ রয়েছে।’ ওই গ্রামের কৃষক দুলাল উদ্দিনের ৪৫টি, অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য হযরত আলীর ৫০টি, কৃষক মোজাম্মেল হকের ২৫টি, লিটন মিয়ার ১০টি, চান মিয়ার ৩০টি লিচুগাছ রয়েছে।
স্থানীয় সাংবাদিক শাহ আলী বাচ্চু জানান, বাড়িতে আমার ১০টি লিচুগাছ রয়েছে। তাছাড়া চায়না-৩ জাতের লিচুর একটি নার্সারিও রয়েছে তার। নার্সারিতে বর্তমানে তিন শতাধিক লিচুর চারা রয়েছে।
গ্রামের শিক্ষিত বেকার কর্মহীন সেলিম মিয়া তার পৈতৃক সূত্রে পাওয়া তিন বিঘা জমিতে ছয় বছর আগে চায়না-৩ জাতের একটি বাগান করেছেন। বর্তমানে তার বাগানে শতাধিক লিচু গাছে ফলন হয়েছে। এই এখান থেকে মোটা অংকের অর্থ আয় করবেন বলে তিনি প্রত্যাশা করছেন। সাদেক আলী নামে এক ব্যবসায়ী চার বিঘা জমিতে লিচু বাগান করেছেন। বাণিজ্যিকভাবে লিচু আবাদ করে এলাকার বহু বেকার আজ লাভের মুখ দেখেছেন। অনেকেই লিচু আবাদের প্রতি উৎসাহী হচ্ছেন।
লিচু আবাদে মূল সমস্যা হচ্ছে কটাবান্দর (কাঠবিড়ালী), বাদুড় ও চোরের অত্যাচার। লিচু পাকা, আধাপাকা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব প্রাণী খাওয়ার জন্য লিচুগাছে এসে হামলা চালায়। কটাবান্দর, বাদুড় ও চোর তাড়াতে চাষীরা স্থানীয় নানা পদ্ধতি অবলম্বন করা ছাড়াও লাঠিসোটা নিয়ে দিনরাত পাহারা বসিয়েছেন।
শ্রীরামপুর গ্রামের এমন কোনো বাড়ি নেই যে বাড়িতে লিচুগাছ নেই। প্রতিটি বাড়িতেই একাধিক লিচুগাছে থোকায় থোকায় লিচু। গত পাঁচ-সাত বছর ধরে অনেকেই লিচুর চারা উৎপাদনের নার্সারি গড়ে তুলেছেন। বাণিজ্যিক চিন্তা মাথায় রেখে শুধু এ গ্রামে বর্তমানে ২০ থেকে ২৫টি লিচু বাগান ও নার্সারি গড়ে উঠেছে বলে স্থানীয়রা জানান।
চাষীরা জানায়, চলতি ভরা মৌসুমে রিকশা, ভ্যান, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ইত্যাদি যানবাহনে করে জেলা শহর ছাড়াও দূরদূরান্ত থেকে পাইকাররা লিচু ও নার্সারি থেকে চারা কিনে নিচ্ছেন। চলতি ভরা মৌসুমে জাতভেদে প্রতি হাজার লিচু (পাইকারি মূল্য) এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চায়না-১, ২ ও ৩ জাতের এক হাজার লিচুর পাইকারি বাজার মূল্য তিন থেকে চার হাজার টাকা।
এদিকে, শ্রীরামপুর গ্রামবাসীর দেখাদেখি আশপাশের বহু গ্রামের মানুষ বাণিজ্যিকভাবে লিচু আবাদে ঝুঁকছেন। এর মধ্যে রঘুনাথপুর, গোদাশিমলা, রাঙ্গামাটিয়া, শরিফপুর, ছোট জয়রামপুর, বড় জয়রামপুর, রনরামপুর, খলিশাকুড়ী, বেড়াপাথালিয়া, হামিদুপর, কানিল, রানাগাছাসহ ২০-২৫টি গ্রামে হাজার হাজার লিচুগাছ ও বাগান গড়ে উঠেছে।
জামালপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তা ড. রফিকুল ইসলাম জানান, এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় লিচুর বাম্পার ফলন হয়েছে। লিচু আবাদে খরচ কম, লাভ বেশি, বিধায় এর চাষ দিন দিন বাড়ছে।