নেতারা ছাড়া পেলেই বিএনপি পুনর্গঠন
উপযুক্ত পরিবেশ, সঠিক সময় ও কারারুদ্ধ নেতাকর্মীদের মুক্ত পরিবেশে ফিরিয়ে আনার পরই দলের পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু করবে বিএনপি।
নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ের জন্য গত তিন মাসের আন্দোলনে অনেক নেতাকর্মী আটক হয়েছেন। আইনী প্রক্রিয়ায় এ সব নেতাকর্মীকে কারাগার থেকে অতি দ্রুত বের করার বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী দলটি। নেতাকর্মীরা জেল থেকে বের হওয়ার আগে দল পুনর্গঠনে হাত দেবেন না চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সেক্ষেত্রে এক-দুই মাস সময় লাগলেও তিনি অপেক্ষা করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে দলের নেতৃত্ব নির্বাচন ও মাঠপর্যায়ের ত্যাগী নেতাকর্মীদের প্রত্যক্ষ পরামর্শে মেধাবী নেতাদের দিয়ে দল পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিচ্ছে বিএনপি। এ ছাড়া কমিটির ভারে তলিয়ে যাওয়া সংগঠন নয়, সত্যিকার দক্ষ কর্মীদের দিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্যর কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করবে দলটি। এ সব উদ্যোগে ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলসহ দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের তরুণ নেতৃত্বকে প্রাধান্য দেওয়া হবে।
দল পুনর্গঠনের আগে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে নির্দলীয় সরকারের অধীনে দেশের মানুষ ও সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন আদায়ের দাবিতে গত তিন মাসের আন্দোলনে গ্রেফতার হওয়া নেতাকর্মীদের মুক্তির বিষয়টি, যে কারণে পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় কিছুটা সময় নিতে পারে বিএনপি। সিনিয়র কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলাপ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে কারারুদ্ধ রেখে দলের পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু করতে চাচ্ছেন না দলটির হাইকমান্ড। সেক্ষেত্রে সিনিয়র নেতাদের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কারাবন্দী নেতাকর্মীদের আইনী প্রক্রিয়ায় মুক্ত পরিবেশে ফিরিয়ে আনাকেই এই মুহূর্তে গুরুত্ব দিচ্ছেন হাইকমান্ড।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, শিগগিরিই দলের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় হাত দেওয়া হবে। দলকে পুনর্গঠন ও সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার মধ্য দিয়ে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনও জোরদার করা হবে।
জেনারেল মাহবুব আরও বলেন, দল পুনর্গঠনে কিছু নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির সদস্য ও দফতরের দায়িত্ব পালনকারী যুগ্ম-মহাসচিব কারাগারে রয়েছেন। তারাসহ দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী মুক্তি পাওয়ার পর বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল হবে। দলও সঠিক পন্থায় পুনর্গঠন হবে।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, নেতাকর্মীদের মুক্ত পরিবেশে ফিরে আসার অপেক্ষায় দলের পুনর্গঠনে সময় নিচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। দল পুনর্গঠন ও সাংগঠনিক দুর্বলতা তীব্রভাবে উপলব্ধি করছেন তিনি। এর পরও তিনি বিশ্বস্ত নেতাদের বলছেন, অনেক আগেই দলকে পুনর্গঠন করা উচিত ছিল। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক এমনিতেই দেরি হয়েছে। দেরি যেহেতু হয়েছেই, এখন নেতাকর্মীদের কারাগারে রেখে পুনর্গঠনে হাত দেব না। তাতে হোক আরও কিছুদিন দেরি। সবাই মুক্ত পরিবেশে ফিরে আসুক। তার পরই দ্রুত বিএনপি পুনর্গঠনে হাত দেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, অদূর ভবিষ্যতে বিএনপির পুনর্গঠনে কোনো বলয়কে প্রাধান্য দেওয়া হবে না। মাঠপর্যায়ের কর্মীদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে তাদের পরামর্শের ভিত্তিতে বিএনপির পুনর্গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবেন দলটির হাইকমান্ড। আর ‘ইয়াং লিডারশিপ’কে বিএনপি পুনর্গঠনে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হবে। যারা গত আওয়ামী মহাজোট সরকার ও বিগত ৫ জানুয়ারির ‘ভোটারবিহীন’ বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে দেশের গণতন্ত্র, ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে মাঠে থেকেছেন, জেল-জুলুম সহ্য করেছেন, সরকারি দলের সন্ত্রাসীদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করে দলে পদ-পদবি দেওয়া হবে। তৈরি করা হবে নতুন নেতৃত্ব।
বিএনপির সূত্র আরও জানায়, আগের মতো মুখ দেখে দেখে বা কারও ছত্রছায়ায় বিএনপিতে আর কাউকে নেতা বানানো হবে না। দেওয়া হবে না পদ-পদবিও। সেক্ষেত্রে বাছাই করা ত্যাগী, সাংগঠনিক দক্ষ, মেধাবী ও আন্দোলন-সংগ্রামে সাধারণ কর্মীদের পাশে থাকা নেতাদের নেতৃত্বে আনার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি।
বিএনপির সিনিয়র এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সম্প্রতি (গত মঙ্গলবার) যুক্তরাজ্য বিএনপির কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। ওই কমিটি ১০১ সদস্যের। যুক্তরাজ্য বিএনপির বিগত কমিটি ছিল ১৭১ সদস্যের। কিন্তু সংখ্যায় কমিটি আর ভারি করার পক্ষে নন যুক্তরাজ্যে বসবাস করা দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি সাংগঠনিকভাবে দক্ষ, ত্যাগী ও কর্মীবান্ধব মেধাবী নেতাদের দিয়ে ছোট কমিটির পক্ষে তার অবস্থান কেন্দ্রীয় বিএনপিকে জানিয়ে দেন। সে কারণে লন্ডন বিএনপির নেতৃত্ব প্রত্যাশী নেতাদের ব্যাপক চাপ ও আবদার সত্ত্বেও নতুন কমিটি ১০১ সদস্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। অবশ্য তিনি (তারেক রহমান) ৭১ সদস্যের কমিটির পক্ষে অবস্থান নিয়েও ব্যাপক চাপের কারণে তা ১০১ পর্যন্ত করার পরামর্শ দেন। সেই অভিজ্ঞতায় তারেক রহমানের পরামর্শে আগামীতে বিএনপির কেন্দ্রীয় জাতীয় নির্বাহী কমিটি (বর্তমানে যা প্রায় ৪শ’ ছুঁই ছুঁই করছে) সর্বোচ্চ ১৫১-এর মধ্যে রাখার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দলের হাইকমান্ড।
তিনি জানান, এ কথা আমাদের মানতেই হবে, আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে এমন অনেক নেতা আছেন, যাদের সাধারণ নেতাকর্মীরা তো বটেই, অনেক সিনিয়র নেতাও চেনেন না। তারা কোনো না কোনো অনৈতিক পন্থায় শহীদ জিয়ার আদর্শে গড়া বিএনপির মতো একটি বৃহৎ ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের নেতায় পরিণত হয়েছেন। এটা কোনোভাবেই একটি গণভিত্তির রাজনৈতিক দলের জন্য শোভনীয় ও মঙ্গলজনক নয়। তাই নেতৃত্বের প্রতিযোগিতাকে উৎসাহ দিয়ে তরুণ ও মেধাবীদের দলে স্থান দেওয়া হবে।
বিএনপির অন্যতম যুগ্ম-মহাসচিব মোহাম্মদ শাহজাহান দলের পুনর্গঠনের বিষয়ে বলেন, ‘আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির সদস্য, যুগ্ম-মহাসচিবসহ অনেক সিনিয়র নেতা বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) চান, শুধু সিনিয়র নেতারাই নন, দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক হাজার হাজার নেতাকর্মী আইনী প্রক্রিয়ায় মুক্ত হয়ে আসার পর দল পুনর্গঠনে হাত দেবেন। তাতে দু-এক মাস সময় লাগলে লাগুক।’
শাহজাহান বলেন, অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে বিএনপি পুনর্গঠনে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হবে। তরুণ, ত্যাগী ও সাংগঠনিকভাবে দক্ষরাই পুনর্গঠিত বিএনপির নেতৃত্বে আসবে। আর এতে ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলসহ বিভিন্ন অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের সাবেক নেতারা প্রাধান্য পাবেন।