দিনে গড়ে ৫০ জনের বেশি নারী নিপীড়ন হচ্ছে দেশে
সারাদেশে গত এক বছরে প্রায় ১৮ হাজার নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সাড়ে চার মাসে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৭ হাজারের বেশি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতিদিন গড়ে দেশের বিভিন্নস্থানে ৫০ জনের বেশি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। ধর্ষণ ছাড়াও এসিড নিক্ষেপ, যৌতুক, পরকীয়া, প্রেমের ফাঁদসহ নানা ধরনের নারী
নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। পুলিশ ও মানবাধিকার সংগঠনের দেয়া তথ্যানুযায়ী নারী নির্যাতনের এই পরিসংখ্যান জানা গেছে। তবে নারী নির্যাতনের সংখ্যা আরও বেশি হবে বলে ধারণা করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকগণ। কারণ, বহু নারী নির্যাতনের বিষয়ে পারিবারিক মানসম্মানের কথা বিবেচনা করে থানায় অভিযোগ করে না। পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
রাজধানীতে বৃহস্পতিবার চলন্ত মাইক্রোবাসে এক গারো নারী পাশবিকতার শিকার ও পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে নারী লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনায় নারী নির্যাতনের ঘটনাটি প্রতিবাদে, উদ্বেগের বহির্প্রকাশ ঘটেছে। এ ছাড়াও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় ৫ ছাত্রকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে। এর আগে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে চলন্ত বাসে এক গার্মেন্টস কর্মী গণধর্ষণের শিকার হন। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে এই ধরনের পাশবিক ঘটনায় নারী নির্যাতনের ঘটনা এখন মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। দেশের বিভিন্নস্থানে প্রায় প্রতিদিনই এই ধরনের নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে।
পুলিশ ও মানবাধিকার সংগঠনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ’১৪ সালে সারাদেশে ১৯ হাজার ৫শ’ ১টি নারী নির্যাতনের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। ’১৩ সালে ১৯ হাজার ৬শ’ ৫১টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছরের গত সাড়ে ৪ মাসে ৭ হাজার ১শ’ নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী নারী নির্যাতন তুলনামূলকভাবে কমছে বলে হিসেবে ধরা হয়েছে। কিন্তু কিছু কিছু নারী নির্যাতনের ঘটনা ব্যাপক চাঞ্চল্য ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। প্রতিবাদী নারী সমাজের আন্দোলন ও রাজনৈতিক কারণে দু’একটি নারী নির্যাতনের ঘটনা প্রতিকারহীন থাকার কারণে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধের সম্মুখীন হচ্ছে।
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, বহু নারী নির্যাতনের বিষয়ে পারিবারিক মানসম্মানের কথা বিবেচনা করে থানায় অভিযোগ করে না। আবার অনেক ঘটনা প্রমাণের অভাবে ধামাচাপা পড়ে যায়। দেশের জেলা ও গ্রাম পর্যায়ে নারীদের নানাভাবে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে নির্যাতন করা হয়। অনেকেই মোবাইল প্রতারণার খপ্পরে পড়ে নির্যাতিত হচ্ছে। অসহায় ও দরিদ্র অনেক নারী নির্যাতনের শিকার হয়ে পূর্ণ নির্যাতনের ভয়ে মামলা করার সাহস পায় না। তাই অনেক ঘটনা থানা পর্যন্ত পৌঁছে না। অনেক ক্ষেত্রে গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে নারী নির্যাতনের মীমাংসা করা হয়। এমনও দেখা যাচ্ছে, নারী নির্যাতিত হয়ে আবার সেই নারীই ফতোয়ার শিকার হচ্ছেন।
পুলিশ ও মানবাধিকার সংগঠনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গেল বছর ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত রাজধানীসহ সব বিভাগীয় শহর, জেলা শহরে প্রতিনিয়ত নারী নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নারী ধর্ষণ, এসিড সন্ত্রাস, যৌতুক, পরকীয়া, প্রেমের ফাঁদ ইত্যাদির কারণে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। নির্যাতনে আহতসহ নানাভাবে তারা নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হওয়ার পর পুলিশী তদন্তে নারী নির্যাতনের কারণসমূহ বের হয়ে এসেছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি ’১৫ সালের সাড়ে চার মাসে সারাদেশে দেড় শতাধিক নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর আগের বছর ’১৪ সালে কেবলমাত্র রাজধানীতে ১৩০ জন ধর্ষণের শিকার, নির্যাতনে গুরুতর আহত ৩০ জন। অন্যভাবে আহত ৫২৭ জন। সব মিলিয়ে মোট মামলা হয়েছে ৬৮৭টি। একইভাবে চট্টগ্রামে ৩০ নারী ধর্ষণের শিকারসহ অন্যভাবে নির্যাতিত ১০৫ জন। সব মিলিয়ে ১৩৫টি মামলা হয়েছে। খুলনা শহরে ১৮টি ধর্ষণের ঘটনাসহ ৯৬টি, রাজশাহীতে ১২টি ধর্ষণের ঘটনাসহ ৬৩টি, বরিশাল মেট্রোপলিটনে ৯টি ধর্ষণের ঘটনাসহ ৪৭টি, সিলেট মেট্রোপলিটনে ২০টি ধর্ষণের ঘটনাসহ ৬৯টি। এছাড়াও ঢাকা জেলায় ৫৬টি ধর্ষণের ঘটনাসহ ১৮০টি, গাজীপুরে ৫৫টি ধর্ষণের ঘটনাসহ ২২৯টি, নারায়ণগঞ্জে ২৫টি ধর্ষণের ঘটনাসহ ৭২টি, মুন্সীগঞ্জে ১০টি ধর্ষণের ঘটনাসহ ৫৪টি, মানিকগঞ্জে ১১টি ধর্ষণের ঘটনাসহ ৮০টি, ময়মনসিংহে ২৭টি ধর্ষণের ঘটনাসহ ২৩৯টি, নেত্রকোনায় ৬৬টি ধর্ষণের ঘটনাসহ ২৪৫টি, কিশোরগঞ্জে ৩৫টি ধর্ষণের ঘটনাসহ ১৪০টি, জামালপুরে ২৫টি ধর্ষণের ঘটনাসহ ১৭৬টি, গোপালগঞ্জে ৩৬টি ধর্ষণের ঘটনাসহ ৬৯টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৫৫টি ধর্ষণের ঘটনাসহ ৪৯২টি ঘটনা ঘটেছে। এভাবে দেশের বিভিন্ন জেলায় নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।
পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পরিসংখ্যানে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ’১৪ সালে সারাদেশে নারী নির্যাতন নিয়ে মোট ৯ হাজার ২শ’টি ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু নারী ধর্ষণের ঘটনা ১৭৮৭টি ঘটেছে। তবে বেসরকারী হিসেবে এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। পুলিশ প্রতিটি নারী নির্যাতনের ঘটনা তদন্ত করে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেন। এছাড়াও যারা শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে তাদের অনেককে পুলিশী তত্তাবধানে চিকিৎসা শেষে মামলা দায়ের করা হয়েছে। আবার নির্যাতিত শিশুদের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে চিকিৎসাসহ আইনী সহায়তা দেয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, বহু অভিযোগ পুলিশ পর্যন্ত পৌঁছে না।
পুলিশ সদর দফতরের উর্ধতন এক কর্মকর্তা বলেন, নারী নির্যাতন মামলার একাধিক কারণ আছে। কাউকে বিপদে ফেলার জন্য মামলা করে। আর সেই মামলা নেয়া হয়। সামাজিক প্রেক্ষাপট ও নারী নির্যাতন মামলার অপব্যবহার হচ্ছে। এর পরও পুলিশ প্রতিটি ঘটনার তদন্ত করে আইনী ব্যবস্থা নেয়। গত বছরগুলোর তুলনায় নারী নির্যাতন কিছুটা কমলেও কিছু কিছু ঘটনা ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি করছে। তবে প্রতিটি নারী নির্যাতনের ঘটনার সঠিক তদন্ত করে দায়ী ও দোষীদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে দাবি করেন পুলিশ কর্মকর্তা।
সৌজন্যে: জনকণ্ঠ