লাদেন বেঁচে থাকলে হয়তো আমাদের জন্য এখন ভালোই হত: রবার্ট ফিস্ক
গলা কর্তনকারী আইএস সদস্যদের চেয়ে কতই নরম-সরমই না ছিলেন তিনি! কালো ব্যানারধারী শিরোশ্ছেদকারীরা রামাদি আর পালমিরাতে নিজেদের কার্যসিদ্ধির জন্য ফেরত গেছে এবং এখনও সে কর্মসাধন অব্যাহত রেখেছে। যদি মৃত্যু থেকে আরেকবার তিনি ফিরে আসতেন, ভারত মহাসাগ থেকে উঠে আসতেন (যদি সত্যিই তাকে সেখানে ভাসিয়ে দেয়া হয়ে থাকে) শেষ উপস্থিতির জানান দিতেন। তিনি আবারও তার স্ত্রীকে ভালোবাসতেন, চাইতেন তার ছেলে আল-কায়েদার হাল ধরবে, ইংরেজি পড়তে পারলে তিনি নোম চমস্কি পড়তে থাকবেন হয়তো!এককালে যুক্তরাষ্ট্রের কথিত সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধের লক্ষ্যবস্তুদের অন্যতম, বিনা বিচারে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে মার্কি ন বাহিনীর হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া সেই বিন লাদেনকে নিয়ে এসব বলছেন সাড়া জাগানো মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক, সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ইন্ডিপেন্ডেন্ট-এর জন্য লেখা এক নিবন্ধে এসব কথা বলেন তিনি। আমরা রচনাটির ইষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ পাঠকের সামনে তুলে ধরছি।-
শত্রুপক্ষকে যখন ঘায়েল করতে ব্যর্থ হোই, তখন আমরা মধ্যপন্থী কাউকে খুঁজি, যার মাধ্যমে সংলাপ চালিয়ে নেয়া যায়। আর অদম্য আইএস সদস্যের সঙ্গে আলোচনার জন্য আমরা অবশ্যই সেই মধ্যপন্থী হিসেবে লাদেনকে ব্যবহার করতে পারতাম। কিন্তু আলজেরিয়ার সঙ্গে আলোচনার জন্য ফ্রান্স যখন মধ্যস্থতাকারী খুঁজছিল তখন তারা দেখলো সম্ভাব্য মধ্যস্থতাকারীদের সবাই হত্যার শিকার হয়েছে। সে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমরা বিন লাদেনের ক্ষেত্রেও দেখেছি। এখন বিশ্ব শয়তান রাজত্বের এমন কোনো মূল হোতা (Fountainhead of World Evil) নেই যার সঙ্গে আমরা আলোচনায় বসতে পারি।
কিন্তু আমার মনে হয় লাদেনের মৃত্যু এবং এর পরবর্তী কর্মকাণ্ড দিয়ে মূলত আমাদের বোকা বানানো হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সিআইএ-এর প্রকাশ করা বই এবং অন্যান্য নথিপত্র দেখে আমি যারপরনাই বিস্মিত হয়েছি। এতদিন পরে চিঠিগুলো কেন এখন প্রকাশ করা হলো? সিমোর হার্শ বলেন, লাদেন পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে অ্যাবোটাবাদে বসবাস করছিলেন এবং মার্কিন সেনাদের ব্রাশফায়ারে ছিন্নবিছিন্ন হয়ে যায়। এবং তার শরীরের ছিন্নবিচ্ছিন্ন কিছু অংশ হিন্দু কুশে নিক্ষেপ করা হয়। তার লাশ সাগরে ভাসিয়ে দেয়ার ঘটনাটি ছিলো একদমই মিথ্যা।
অভিযানের ভিডিওটি কেন একদম নির্বাক ছিলো? এবং তার কাছে পাওয়া নথিপত্রগুলো কেন সেন্সর করে প্রকাশ করা হলো। সিআইএ’র কেনো মনে হলো যে তার কাছে পাওয়া বইপত্রের তালিকা সম্পূর্ণ প্রকাশ করা যাবে না। অবাক করা বিষয় হলেও সত্যি এমন প্রশ্ন কেউই তোলেন নি। জার্নাস এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করতেও সক্ষম হননি। কি এমন ছিলো যা শুধু সিআইএ এবং বিন লাদেন জানতো যা আমাদের জানা ঠিক হবে না।
১৯৯৩, ১৯৯৬ এবং ১৯৯৭ সালে বিন লাদেনের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎগুলো ছিলো আমার কাছে আশীবার্দস্বরুপ। একজন রিপোর্টার এর জীবন বৃত্তান্তে এমন সাক্ষাতকার থাকা সবসময়ই বিশেষ কিছু। যদিও লাদেন ২০০১ সালে বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালায়। কিন্তু তার সঙ্গে ১৯৯৬ সালে আমার দ্বিতীয় সাক্ষাতের বিষয়বস্তু ছিলো একদমই অন্যরকম। সেসময় তিনি জানান, তিনি সৌদি আরবের দুর্নীতিতে খুবই বিরক্ত। কিভাবে তাদের রাজপরিবার ইসলামকে ত্যাগ করে। আমি পরে জানতে পারি সৌদি আরব তাকে রিয়াদে ফিরে আসার জন্য তাকে মিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব দিয়েছিলো।
সিমর হার্শের লেখায় লাদেন হত্যার এক অন্যরকম চিত্রই তুলে ধরা হয়। এক সাবেক কর্মকর্তা হার্শকে জানান, পাকিস্তানে লাদেনের বাড়িতে অভিযানের সময় সৌদি আরব নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায়ই ছিলো মার্কিন সরকার। কারণ নাইন-ইলেভেন এর পর সৌদি রাজপরিবার লাদেনকে পাকিস্তানের মাধ্যমে অর্থায়ন করতে থাকেন। ওই কর্মকর্তা জানান, সৌদি রাজপরিবার যথেষ্টই ভীত ছিলো যে চাপে পরে পাকিস্তান যেন আল-কায়েদার সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্কের কথা ফাঁস না করে দেয়। এজন্য তারা প্রচুর পরিমাণ অর্থ খরচ করতে শুরু করে।
সম্প্রতি প্রকাশিত হওয়া লাদেনের চিঠি নিয়ে আমার অনেক প্রশ্ন রয়েছে। আমরা জানি না তার চিঠিগুলো কে অনুবাদ করেছে কিংবা সেন্সর করেছে। কিছু চিঠি নিয়ে আমার সন্দেহ নেই। যেমন স্ত্রীকে লেখা লাদেনের চিঠি। কিংবা হামজার ব্যাপারে লেখা যাকে পরবর্তীতে আল-কায়েদার প্রধান হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন লাদেন। লাদেন তার শাহাদাতবরণের পর স্ত্রীকে পুনরায় বিয়ে করার অনুমতি দিয়েছিলেন। তিনি স্বর্গে তার স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হতে চেয়েছিলেন।
তবে মার্কিন ড্রোন হামলা থেকে বাঁচতে মেঘলা আকাশের নিচে চলাচলের পরামর্শ দিয়েছিলেন লাদেন। তিনি বিশ্বাস করতেন বিপ্লব ঘটানোর জন্য আসলে প্রকৃত শিক্ষাই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। তিনি বারবারই যুক্তরাষ্ট্রকে হামলা করতে চেয়েছিলেন, মধ্যপ্রাচ্যকে নয়। এসব থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে অ্যাবোটাবাদে তার বাসভবন আসলে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ঘাঁটি ছিলো না।
তাহলে এই চিঠি ও নথিপত্রগুলো এতটা খণ্ডিত হয়ে কেন আসলো এবং কেন এগুলোকে একটা কর্তন ও সেন্সরশিপের মধ্য দিয়ে যেতে গেলো। ১০৩ বর্ণে প্রকাশিত হওয়া রিপোর্ট ও ভিডিওগুলোকে তিন বছর ধরে গবেষণা করা হয়। এর আগেও প্রকাশিত ১৭৫ পৃষ্ঠার একটি কথোপকথের নথির উপর বেশ কয়েকবার কাঁচি চালানো হয়।
যেমন লাদেনের কোনো এজেন্ট যখন তাকে আমার কোনো লেখা পাঠায় তখন দুটো অংশে পাঠানো হয়। একটি সম্পূর্ণ আরবি ভাষায় এবং আরেকটি ইংরেজিতে অনুবাদ। যে ইংরেজি আসলে আমরা দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট এ দেখতে পাই এমন। কিন্তু আরেকটি অংশ ঠিকই শুদ্ধ আরবিতে থাকে এবং একে অনুবাদ করে পাঠানোর কোনো চেষ্টা করা হয় না।
এরপর আমাদেরকে বলা হচ্ছে যে আরো বেশকিছু নথিপত্র প্রকাশ করা হবে যা এখন গবেষণা করা হচ্ছে এবং উপযুক্ত সেন্সর করেই তবে ছাড়া হবে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কোন বিষয় আসলে গোপন রাখা প্রয়োজন? সরকারি কাগজ হলে তা গোপনীয়তার প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে। কিন্তু বিন লাদেনের নথিপত্র গোপনীয়তার প্রয়োজনটা কি? এর মানেটা কি? সৌদি আরবের কোনো তথ্য হয়তো?
অ্যাবোটাবাদে পাওয়া নথিপত্র যা প্রকাশ করতে সিআইএ’র চার বছর লেগেছিলো তা খুঁজতে আমি মাটি খোড়া শুরু করতে চাই না। আমার প্রশ্ন হচ্ছে সিআইএ কি শালীন হওয়ার একটু বেশিই ভান করছে না? এবং দেখা গেছে বাড়িটিতে নোম চমস্কি এবং উডওয়ার্ডের বই পাওয়া গেছে যা সম্পূর্ণ ইংরেজিতে লেখা। বিন লাদেন কি ইংরেজি পড়তে পারতেন? কারণ আমি যখন তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি তখন তিনি একদমই ইংরেজি বলতে পারতেন না। তাহলে কি অ্যাবেটাবাদে তার ইংরেজি শিক্ষক ছিলো। তিনি আরবি বইও পড়েছেন। সেগুলো কি মার্কিন বাহিনীরা খুজে পায়নি? নাকি সেগুলোতে সৌদি আরব নিয়ে অনেক বেশি লেখা ছিলো যা প্রকাশ করা যাবে না।
এর আগে প্রকাশিত হওয়া চিঠিগুলোতে দেখা যায় লাদেন ব্রিটিশদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত হওয়া লেখায় এর কোনো উল্লেখ নেই। তিনি কি বর্তমানে বিশ্বে প্রভাবশালী সন্ত্রাসী সংগঠন আইএস এর সৃষ্টিতে কোনো ভুমিকা রেখেছিলেন। এটা হয়তো আইএস এর আর্কাইভে পাওয়া যাবে। কিন্তু সেটাও তো আামদের কাছে সেন্সর হয়ে আসবে। তাই বিন লাদেনের মৃত্যুর পরও আইএস কে থামাতে আমি অন্তত একজন মধ্যস্থতাকারী খুঁজে বের করার পরামর্শ দেবো।