মালয়েশিয়ায় গণকবর: জোর করে পাচার করে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের?
উত্তর মালয়েশিয়ার মানব পাচার শিবিরে আবিষ্কৃত ১৩৯টি অগভীর গণকবর থেকে মানুষের ব্যবহৃত কিছু পরিত্যক্ত জিনিস পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে পুলিশের এক প্রধান বলেন, পরিত্যক্ত জিনিসগুলোর মধ্যে গোলাপি রঙের খেলনা ভাল্লুক ও শিশুদের জুতাও আছে। এখন প্রশ্ন হলো- রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশি অধিবাসীরা কাজের সন্ধানেই যদি বঙ্গোপসাগর হয়ে এখানে আসে, তবে তারা ছোট ছোট বাচ্চা কেন নিয়ে এসেছিল?
এই সপ্তাহে মিয়ানমারে এর একটি ব্যখ্যা আবির্ভূত হয়েছে, অভিবাসীদের মধ্যে অনেকেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই যাত্রা আরম্ভ করে। তারা দালালের খপ্পরে পড়ে এবং জোর করে তাদেরকে সাগরে নিয়ে যাওয়া হয়।
অন্যদের ভিতরে শিশুদেরকে অপরহণ করা হয়। অপহৃত শিশুদের মধ্যে ১৬ বছর বয়সী “রাইজুন্নাহার” এখনও নিঁখোজ আছে। রাইজুন্নাহার মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের রাজধানী সিওয়ের উত্তরে দার পিয়ং ক্যাম্পে তার পরিবারের সাথে থাকত। কুখ্যাত এই ক্যাম্পটি ২০১২ সালের সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় তাড়িত মুসলমানদের থাকার জন্য তৈরি হয়।
এক মাস আগে এক শুক্রবারে রাইজুন্নাহারের ভাই তাকে বাড়িতে রেখে মসজিদে নামাজ পড়তে যায়। ২০ বছর বয়সী রাইজুন্নাহারের ভাই মারমাহ হ্যানসন বলেন, “আমরা যখন ৪ টার দিকে বাড়িতে আসলাম, তখন তাকে আর খুঁজে পেলাম না। সে একেবারেই গায়েব।”
রাইজুন্নাহারের পরিবার তাকে খোজার চেষ্টা করে। মারমাহ জানায়, বোনকে খুঁজতে সে ৫০০ ডলার খরচ করেছিল।
তারপর হঠাৎ করেই মে মাসের ৪ তারিখে রাইজুন্নাহার আন্দামান সাগরের একটি নৌকা থেকে ফোন করে। ফোনে সে জানায়, তাকে অপহরণ করা হয়েছে এবং বিক্রিও করে দেওয়া হয়েছে। ঐ ক্যাম্পেরই এক ব্যক্তির পুত্রবধূ কর্তৃক সে বিক্রি হয়। ২০০ ডলারে তাকে বিক্রি করে নারীটি। কিন্তু দালালেরা তাকে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার জন্য উল্টো ২২০০ ডলার দাবি করে।
দরিদ্র পরিবারটির এতগুলো টাকা দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। তাছাড়া নৌকা থেকে ফোন আসাও বন্ধ হয়ে যায়। এখন, মেয়েটি বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে তা তার পরিবার জানে না।
তবে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার অনুমান, এই সপ্তাহেই ৩৫০০ এর মতো অভিবাসী এখনও আন্দামান সাগরের মানুষ বোঝাইকৃত জাহাজগুলোতে ভেসে বেড়াচ্ছে।
রাইজুন্নাহারের ভাই বলে, “আমরা শুধু আশা ও প্রার্থনা করি যে, সে ভালো আছে।”
তবে মানব পাচারের এই ব্যাপারটি ব্যাপকভাবে নজরে আসার পরে কিছু পরিবার তাদের শিশুদের ফেরত পেয়েছেন। উদ্ধারকৃত শিশুদের ভিতরে রাখাইন ক্যাম্পের ১৪ বছর বয়সী এক মেয়েও আছে।
‘দ্য মায়ানমার টাইমস-এর প্রতিবেদনে আসা উদ্ধারকৃত আরেক অভিবাসী মোহাম্মদ (ছদ্ম নাম) জানায়, প্রায় ২ মাস আগে সিত্তয়ে কাজের জন্য ক্যাম্প ছেড়ে সে চলে আসে। সিত্তয়ের এক মুসলমান মহল্লায় ছুতোর দোকানে কাজও পেয়ে যায় সে। কিন্ত যখন সে কর্মক্ষেত্রে পৌছায় তখন তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বন্দী করা হয়। সে বলে, “আমি বিরোধিতা করা শুরু করলে তারা আমাকে প্রচণ্ড মারধর করে। বেধড়ক মার-ধরে আমি নড়া-চড়া করতে পারতাম না। যখন আমাকে তারা বলল- আমি বিক্রি হয়ে গেছি তখন আমি কাঁদলাম। তখন তারা আমাকে আরও বেশি মারা শুরু করল। আমি আটকা পড়ে গেছিলাম। দালালরা আমাকে বলে, আমি আর কখনোই আমার পরিবারকে দেখতে পাব না।”
সে জানায়, প্রথম দিকে পাচারকারীরা তাকেসহ প্রায় ১৫ জনকে উপকূলবর্তী এলাকায় বন্দী করে রাখে। কারণ পাচারকারীরা আন্তর্জাতিক জলসীমায় প্রবেশের জন্য সরকারের কাছ থেকে অনুমতির অপেক্ষায় ছিল।
একটি চেইন ও রঙিন ব্যান্ড তার কব্জিতে বেঁধে দেওয়া হয়। যদি তার পরিবার মালয়েশিয়ায় তাকে ছাড়ানোর জন্য মুক্তিপণ নিয়ে আসে তবে প্রথমটি খুলে নেওয়া হবে। আর সে যদি অন্য করো কাছে বিক্রি হয়ে যায় তাহলে দ্বিতীয়টি খুলে রাখা হবে।
মোহাম্মদসহ প্রায় ৩৫০ জনকে পিঠমোড়া করে বেঁধে নৌকায় তোলা হয়। তাদের হাঁটু বুকের কাছে এনে জোরে চাপ দিয়ে বাঁধা হতো। সে সাগরে ৫৬ দিন ছিল। সে বলে, “তারা সপ্তাহে একদিন আমাদের খেতে দিত। আমরা দিনে মাত্র এক কাপ পানি পেতাম। আর কেউ যদি একাধিকবার বাথরুমে যেতে চাইতো তখন তাকে বেধড়ক পেটানো হতো। সেখানে দুইজন ছিল যারা স্ব-ইচ্ছায় মালয়েশিয়ায় যেতে চেয়েছিল। বাদ বাকি আর সবাইকে জোর করে পাচার করা হচ্ছিল।” তার পরিবারের কাছে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। ৩০০ ডলার মুক্তিপণ দিয়ে তাকে তার পরিবার উদ্ধার করে।
মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ক্যাম্পটিতে মাথা গোনার কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই যে সেখান থেকে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে মানুষ চলে যেতে থাকে এটিতে অস্বীকৃতি জানায় রাখাইন প্রদেশের নির্বাহী সচিব ইউ তিন মং সুই। তিনি জোর দিয়ে বলেন, নৌকাতে থাকা সব লোকই বাংলাদেশি। কিন্তু মোহাম্মাদের বক্তব্য অনুযায়ী তাকে ধরার জন্য পাচারকারীর ফেলা ফাঁদ এবং সরকার কর্তৃক তাদের পানি সীমায় যাওয়ার অনুমতি প্রদান, মিয়ানমার সরকারের আইন সম্বন্ধে সমলোচকদের সন্দেহকে অনুরণনিত করে।
গত সপ্তাহে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থিন সেন নারীদের জন্য এক নতুন আইন চালু করেন। আইনে বলা আছে, কোনো নারী ৩৬ মাসের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে সন্তান জন্ম দিতে পারবে না। কিন্তু আইনটি কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, সে সম্পর্কে কোনো বিবৃতি দেওয়া হয়নি। মানবাধিকার কর্মীদের কোনো সন্দেহ নেই যে, আইনটি প্রণয়নের পিছনে সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হলো রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা কমানো। কারণ রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের ক্রমবৃদ্ধি সেখানকার সংখ্যালঘু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য হুমকি মনে করছে সরকার।
হিউমান রাইটস ওয়াচ’র এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস বলেন, “মুসলমান-বিরোধী এই সূচি জনসংখ্যা সম্পর্কিত আইনকে চাপের মুখে ফেলে দিয়েছে, সুতরাং এটি যে বৈষম্যমূলকভাবে বাস্তবায়িত হবে সেটি প্রত্যাশা না করার কোনো অবকাশ নেই।”
মিয়ানমারের নারী অধিকার কর্মী উ উইরথাও এই আইন সম্পর্কে বলেন, “রোহিঙ্গারা প্রধান লক্ষ্য। আইনের উদ্দেশ্যই হলো, রাখাইন প্রদেশ আয়ত্ত্বকারী রোহিঙ্গাদেরকে নিঃশেষ করা। যে কোনো মূল্যেই হোক, রাখাইনকে জাতিগতভাবে সাফ করা হবে।”