বাংলাদেশি যুবকরা আইএসে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে যে কারণে
বাংলাদেশ থেকে শতাধিক যুবক ও তরুণ সিরিয়াভিত্তিক উগ্রপন্থী জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেটে (আইএস) যুক্ত ও যোগদানের চেষ্টা করার সময়ে শনাক্ত করেছে গোয়েন্দারা। গত ছয় মাসে বিশজনকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সিরিয়া অথবা ইরাকে গিয়ে আইএস-এ যুক্ত হয়ে জিহাদে অংশ নিতে ব্যাকুল ছিলেন আটক হওয়া যুবক ও তরুণরা। উচ্চ শিক্ষিত ও প্রযুক্তিবিদ্যায় পারদর্শী আমিনুল ইসলাম বেগ (৪৫) ও সাকিব বিন কামাল নামের দুজনকে রবিবার রাজধানী ঢাকা থেকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে সিরিয়াভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন আইএস-এ যোগ দিতে যুবক ও তরুণরা মরিয়া কেন সেই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা।
জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের আকাশ কুসুম কল্পনায় জিহাদে অংশ নিতে প্রলুব্ধ করে উচ্চ শিক্ষিত ও প্রযুক্তিবিদ্যায় পারদর্শীদের যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করছে উগ্রপন্থী সিরিয়াভিত্তিক সশস্ত্র জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটারের মাধ্যমের ছদ্মনামের বিভিন্ন ধরনের পেজ খুলে বিশ্বের অন্তত ৮০টি দেশের ১৫ হাজার যোদ্ধার নামের সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। ইসলামিক রাষ্ট্রের কাল্পনিক রাজনীতির প্রলোভনের টোপে পড়ে আইএস-এ যোগ দিচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের মেয়েরাও। আইএস-এ যোগদানে উদ্বুদ্ধ করে জঙ্গী কর্মী সংগ্রহ করার অভিযোগে গ্রেফতারকৃত মোঃ আমিনুল ইসলাম বেগ ও সাকিব বিন কামালকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে এ ধরনের তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা।
গোয়েন্দা সূত্র জানান, বহুজাতিক কোম্পানি কোকাকোলার বাংলাদেশের আইটি প্রধান মোঃ আমিনুল ইসলাম বেগ (৪৫) মালয়েশিয়া থেকে প্রযুক্তিবিদ্যায় উচ্চতর ডিগ্রীধারী নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জামা’তুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর আঞ্চলিক সমন্বয়ক। তাকে গ্রেফতার করার পর তার দেয়া তথ্যানুযায়ী গ্রেফতার করা হয় রাজধানীর একটি নামকরা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রযুক্তিবিদ্যায় ও ইংরেজী মাধ্যম থেকে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনকারী একটি নামকরা ইংরেজী মাধ্যম স্কুলের শিক্ষক আইএস-এর বাংলাদেশের অপর সমন্বয়ক সাকিব বিন কামালকে (৩৮)। জিজ্ঞাসাবাদে গোয়েন্দারা এ দুজনের কাছে জানতে চায়, সিরিয়াভিত্তিক উগ্রপন্থী জঙ্গী সংগঠন ইসলামী স্টেট (আইএস) এ যোগ দিতে উচ্চ শিক্ষিত, প্রযুক্তিবিদ্যায় পারদর্শী ও মেয়েরা পঙ্গপালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ছে কেন?
জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, ইউটিউবে প্রকাশিত এক ভিডিওতে দেখা গেছে, ইসলামিক স্টেট (আইএস) প্রধান আবু বকর আল বাগদাদির কাছে জিহাদের শপথ নিচ্ছেন পাঁচ ‘বাংলাদেশী’ যুবক। তারা শপথ নেন বাংলায়। সুন্নিপন্থী সশস্ত্র সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর সঙ্গে বাংলাদেশের যুবক ও তরুণরা মূলত ফেসবুক আর টুইটারের মাধ্যমেই যোগাযোগ করে। আর এখন এই পেজগুলো থাকে ছদ্মনামে। থাকে ব্যক্তিগতও। আর যোগাযোগের ভাষায়ও এসেছে পরিবর্তন। গত বছর আইএস বাংলাদেশ নামে একটি ফেসবুক পেজ শনাক্ত করার পর এখন তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সেই পেজে লাইক ছিল দেড় লাখেরও বেশি। এই যুবক ও তরুণদের একাংশ জেএমবি’র সঙ্গে জড়িত যারা আইএস-এর উত্থানে উদ্বুদ্ধ হয়ে সেদিকে ঝুঁকছে। আর কিছু রয়েছে যারা আইএস-এর ভাবধারা এবং নানা টেক্সট পড়ে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সূত্র ধরেই বাংলাদেশের এদের শনাক্ত করা শুরু করেন গোয়েন্দারা। গত ছয় মাসে এ পর্যন্ত কমবেশি ২০ জনকে আইএস-এর সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে আটক করা হয়েছে। তারা সিরিয়া অথবা ইরাকে গিয়ে আইএস-এ যুক্ত হয়ে ‘জিহাদে’ অংশ নিতে ব্যাকুল ছিলেন। গত বছরও ১১ জনকে আটক করেন বলে জানান গোয়েন্দারা।
গোয়েন্দা সূত্র জানান, ঢাকার মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র আশেকুর রহমানের সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটে যোগদানের খবর নিয়ে বাংলাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
সিরিয়ায় যাওয়ার লক্ষ্যে তিনি টার্কিশ এয়ারের একটি ফ্লাইটে ঢাকা থেকে তুরেস্ক গিয়ে নিরুদ্দেশ হন। তাকে খুঁজে পেতে তুরস্ক সরকারের সাহায্য চাওয়া হয়েছে। ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে গত ১১ মার্চ চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানানো হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ দেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়, ঢাকার মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র আশেকুর রহমান গত ২১ ফেব্রুয়ারি একটি সম্মেলনে অংশগ্রহণের কথা বলে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে যান। ২৭ ফেব্রুয়ারি তার ঢাকায় ফেরার কথা ছিল। কিন্তু তিনি দেশে না ফিরে ইস্তাম্বুল থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যান।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়, পূর্বাপর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে ধারণা করা হচ্ছে যে তুরস্কের পার্শ্ববর্তী সিরিয়ায় জঙ্গী-সন্ত্রাসবাদী সংগঠনে যোগদানের অভিপ্রায়ে ম্বুলে গিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নিরুদ্দেশ হয়েছেন। এই তরুণের সন্ধান লাভের জন্য পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশ দূতাবাস ইতোমধ্যে তুরস্ক সরকারকে অনুরোধ করেছে।
বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, একটি সম্মেলনে অংশগ্রহণের কথা বলে ঢাকার তুরস্ক দূতাবাস থেকে আশেকুর ভিসা নিয়েছিলেন। ভিসা আবেদনের সঙ্গে দেয়া কথিত সম্মেলনের সব কাগজপত্র ছিল ভুয়া। পরে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, আশেকুর যে তুরস্ক গেছেন, তা পরিবারের সদস্যরা জানতেনই না। সম্ভবত তিনিই হবেন প্রথম বাংলাদেশী যিনি বাংলাদেশ থেকে গিয়ে সরাসরি আইএস-এ যোগ দিয়েছেন বলে অভিযোগ।
গোয়েন্দা সূত্র জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নানা মাধ্যমে অন্তত ১০০ যুবক ও তরুণকে শনাক্ত করার পর তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে। বিশ্বের অন্তত ৮০টির বেশি দেশের ১৫ হাজারের বেশি আইএস যোদ্ধা রয়েছে বলে তথ্যানুযায় প্রকাশ। বাংলাদেশের কোমলমতি যুবক ও তরুণদের মগজ ধোলাই (ব্রেন ওয়াশ) করা হচ্ছে, তাদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। তারা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ও প্রযুক্তিবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী। বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদে অংশ নিতে ইচ্ছুক। গত রবিবার গভীররাতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি দল রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম মডেল থানাধীন ১৪ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর সড়কের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় আমিনুল ইসলাম বেগকে (৪৫)। তার দেয়া তথ্যানুযায়ী রবিবার রাতেই রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানাধীন লালমাটিয়া এলাকার একটি বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে আইএস-এর বাংলাদেশের অপর সমন্বয়ক সাকিব বিন কামালকে (৩৮)। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে জঙ্গী তৎপরতায় জড়িত থাকার জিহাদী বই ও ডায়েরিসহ নানা ধরনের আলামত উদ্ধার হয়। তাদের বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানান, একই সঙ্গে জেএমবি ও আইএস-এর হয়ে বাংলাদেশে কাজ করছিল তারা। সারাদেশের জেএমবির নেটওয়ার্র্ক কাজে লাগিয়ে তারা আইএস-এর জন্য সদস্য সংগ্রহ করছিল বলে জানতে পারে জিজ্ঞাসাবাদে অংশগ্রহণকারী গোয়েন্দারা।
ইরাক ও সিরিয়ার মতো গণতান্ত্রিক দেশের সরকার ব্যবস্থাকে উৎখাতের মাধ্যমে আইএস নির্দেশিত খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য আটককৃতরা ইন্টারনেটে কর্মী সংগ্রহ করছিল। ইতোমধ্যেই ২০ জনকে তারা যোগাড় করে। যারা আইএস-এ যোগদানের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। তাদেরই একজন গ্রেফতারকৃত সাকিব। যদিও সাকিব আগ থেকেই জেএমবির সঙ্গে জড়িত ছিল। আইএস ইসলামী খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে যা করছে, তা সঠিক বলে মনে করেন গ্রেফতারকৃতরা। নতুন এক বা একাধিক খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর সেইসব রাষ্ট্রের মাধ্যমে অনান্য রাষ্ট্রেও খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব বলে গ্রেফতারকৃতদের ধারণা। বাংলাদেশকেও তারা খিলাফত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আইএস-এ যোগদান করতে ইচ্ছুকরা সবাই স্বচ্ছল পরিবারের সদস্য। তারা নিজ খরচে ইরাক ও সিরিয়া বা অন্য কোন দেশে গিয়ে আইএস-এ যোগদানসহ জঙ্গী সংগঠনটির হয়ে কাজ করার মতো আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান। তারা নিজস্ব অর্থায়নেই ইরাক ও সিরিয়া গিয়ে আইএস-এ যোগ দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
সৌজন্যে: জনকণ্ঠ