তিন বছরে ৩০৬ মানবপাচার মামলা: গ্রেফতার কম, হয়রানির শিকার প্রতিবাদকারীরা
সাগরপথে বা অবৈধভাবে কক্সবাজারের বিভিন্ন রুট হয়ে মানবপাচার পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। তবে মানবপাচারকারী চক্রের সদস্য বা দালালদের নামে স্থানীয়ভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মামলা করতে চায় না ভুক্তভোগীরা। আবার মামলা করলে অদৃশ্য কারণে ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যান মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যরা।
মাঝে মধ্যে প্রশাসন অভিযান পরিচালনা করে কিছু দালালকে ধরলেও মূল হোতারা থেকে যান আড়ালেই। আবার গ্রেফতার হলেও প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের চাপে বা তদবিরে এবং প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের যোগসাজসে সহজেই বেরিয়ে যান তারা। এরপর আবার নতুন করে পুরানো কাজে ফিরে যান মানবপাচারকারী সদস্যরা।
এদিকে কক্সবাজারে মানবপাচার রোধে জনসচেতনতা তৈরির কাজে যারা কাজ করেন তারাও নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এমনকি মিথ্যা মামলায় জর্জরিত হচ্ছেন বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকেও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পান না তারা। বরং অনেক সময় হয়রানির শিকার হন।
কক্সবাজারে জেলা পুলিশের তথ্য মতে, জেলার উখিয়ার সোনারপাড়া, রেজুরখাল, ইনানী, ছেপটখালী, মনখালী, টেকনাফের বাহারছড়া, সাবরাং, শাহপরীর দ্বীপ, ঘোলারপাড়া, মাঝরপাড়া, পশ্চিমপাড়া, কাটাবনিয়া, খুরেরমুখ, হাদুরছড়া, জাহাজপুরা, কচ্ছপিয়া, শামলাপুর, সদরের ঈদগাঁও, খুরুশকুল, চৌফলদন্ডী, পিএমখালী, চকরিয়া, পেকুয়া এবং নুনিয়াছটা, ফিশারিঘাট, নাজিরাটেক, সমিতিপাড়া, মহেশখালীর সোনাদিয়া, গোরকঘাটা, কুতুবজোম, ধলঘাটাসহ মোট ৬০টি পয়েন্ট দিয়ে মানবপাচারের ঘটনা ঘটে।
সরেজমিনে এবং সংশিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সমুদ্রেপথে মানবপাচারের সঙ্গে কক্সবাজারের স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা থেকে শুরু করে অনেক জনপ্রতিনিধিও জড়িত। বিশেষ করে টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলার প্রভাবশালী মহল মানবপাচার চক্রের সদস্যদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা এবং অনেক ক্ষেত্রে নিজেরাও এ চক্রের সক্রিয় সদস্য। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্তা ও সদস্যরাও মানবপাচার চক্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মানবপাচার চক্রের সঙ্গে প্রভাবশালীরা জড়িত হওয়ায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা মামলা করতে থানায় যান না। আবার মামলা করলেও নানাভাবে হয়রানি ও জীবনাশের হুমকি আসে বিভিন্ন মহল থেকে। এমনকি মানবপাচার রোধে কক্সবাজারে গড়ে ওঠা মানবপাচার প্রতিরোধ কমিটির সদস্যদের নামেও মিথ্যা মামলা ও হয়রানির অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে মানবপাচারের বিরুদ্ধে জেলার বিভিন্ন জায়গায় মানববন্ধনসহ বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করেছে এ সংগঠনটি। সংগঠনটির সভাপতি আবুল কাসেম হয়রানির কথা স্বীকার করে বলেন, মানবপাচার বিরোধী কর্মসূচি পালন করায় তার সংগঠনের সদস্য সচিব আব্দুল হামিদ খানসহ ৭ জনের নামে মিথ্যা মামলা দিয়েছে পাচারকারীরা।
এ ব্যাপারে আব্দুল হামিদ খান বলেন, গত বছরের ৬ মার্চ মানবপাচার প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়। ১৮ মার্চ উখিয়ার সোনারপাড়ায় জনসচেতনায় আমরা মানববন্ধন করি। সেখানে কয়েকজন মানবপাচারকারীর নাম ধরে মিডিয়াতে বক্তব্য দেওয়ার পরপরই ফোনে জীবনাশের হুমকি আসতে থাকে। এমনকি এক প্রভাবশালী মানবপাচারকারী তার মেয়েকে দিয়ে ধর্ষণ চেষ্টা মামলাও দেয় আমার বিরুদ্ধে। পরপর আমার নামে চারটি মামলা দেওয়া হয়।
মানবপাচারের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণেই তাকে এ হয়রানি বলে অভিযোগ তার।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানা যায়, অবৈধভাবে সাগরপথে বিদেশে যাওয়ার সময় গত ৩ বছর ৪ মাসে কক্সবাজার জেলায় দুই হাজার ৯৪৫ জনকে উদ্ধার করেছে প্রশাসন। একই সময়ে মানবপাচার আইনে মামলা হয়েছে ৩০৬টি এবং এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে এক হাজার ৫৩১ জনকে। এদের মধ্যে আটক হয়েছে ৪৭৭ জন। এর সাথে সম্প্রতি যোগ হয়েছে থাইল্যান্ড ও মালায়েশিয়ায় গণকবরে বাংলাদেশীদের লাশ উদ্ধারের ঘটনা। থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়শিয়া উপকূলে হাজার হাজার মানুষ উদ্ধারের ঘটনাও ঘটছে।
মানবপাচার রোধের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলেও তোয়াক্কা নেই পাচারকারীদের। এ আইনে এখনো কারো মৃত্যুদণ্ড সাজার ঘটনাও ঘটেনি। মানবপাচার বিরোধী সচেতন মহল বলছেন আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকা বা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের ঢিলেঢালাভাব থাকার কারণেই মূলত অপরাধীরা অপরাধ করে বেড়াচ্ছেন। প্রশাসনের মাঝে মাঝে সক্রিয়তার ফলে অপরাধীরা কিছু সময়ের জন্য নিষ্ক্রিয় হলেও বা মানবপাচার কম হলেও, প্রশাসনের অভিযান বন্ধ হলেই আবারও জেগে ওঠে মানবপাচার চক্র।
এ ক্ষেত্রে জনসচেতনা তৈরি হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন কক্সবাজার বিজিবির সেক্টর কমান্ডার কর্নেল খালেকুজ্জামান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একার পক্ষে পাচার রোধ সম্ভব নয়। এটি রোধ করতে হলে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে মানবপাচারের ক্ষতিকর বিষয়গুলো জনসম্মুখে তুলে ধরতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে মানবপাচারের ঘটনাটি নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় হৈ চৈ হওয়ায় প্রশাসন সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় দালালরা গাঁ ঢাকা দিয়েছে। যখন পরিস্থিতি একটু অনুকূলে আসবে আবারও দালাল চক্র সক্রিয় হয়ে উঠবে। যা আগেও হয়েছে। মূলত দালালদের প্রধান টার্গেট অল্প ও অশিক্ষিত মানুষ। এক্ষেত্রে উপকূল বা নদী ভাঙন এলাকা দালালদের বড় টার্গেট। তাদেরকে ভাল বেতনে বিনা খরচে মালয়েশিয়া বা অন্য কোনো দেশে পাঠানোর কথা বলে ছোট নৌকায় বা জাহাজে করে সাগরে নিয়ে যায়। এরপর তাদের গভীর সমূদ্রে বা থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়ার উপকূলে বা জঙ্গলে আটকে রেখে পরিবারের কাছে বড় অঙ্কের মুক্তিপণ আদায় করে পাচারকারীরা। বিশেষ করে কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফের মানুষই সবচেয়ে বেশি পাচারের শিকার হয়েছেন। আবার এ দু’টি উপজেলাতেই সবচেয়ে বেশি মানবপাচারকারী রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহমদ বলেন, পুলিশসহ আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা মানবপাচার রোধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে।জেলার সকল পাচারকারী ও গডফাদারদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। পাচারকারীদের গ্রেফতারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, পাচারকারীরা যেই দলেরই হোক না কেন কিংবা যত বড় ক্ষমতাশালী হোক তাদের অবশ্যই গ্রেফতার করা হবে।